: জুতোগুলো পালিশ হল?
: আমার সকালবেলার চা কই ??
: আমার স্কুলের দেরী হয়ে গেল, ওয়াটার বটল কই ??
এক গ্লাস পানি আনতো… আধোয়া কাপড়গুলো… বারান্দাটা মুছতে হবে ভালমত কিন্তু… তরকারিতে লবণ যেন ঠিকমতো…
এইসব শুনেই দিনটা শুরু শিউলি বেগমের। অবশ্য এখন তিনি বেগম নন। নাম থেকে বেগমটা সেই কবেই উড়ে গেছে। এখন পড়ে আছে শুধুই শিউলি। তাও অবশ্য ডাকার জন্য নিতান্ত দরকার বলেই হয়ত এখনো জুড়ে আছে। নয়তো মানুষটার সাথে সাথে নামটাও উড়ে যেত ছেঁড়া দুটাকার নোটের মত। ছেঁড়া নোট যেমন তালি টালি লাগিয়ে কোনমতে ঠেলেঠুলে চালানো হয়, শিউলি বেগমকেও এখন ওরকমই ঠেলেঠুলে চালানো হচ্ছে। শুধু পার্থক্য হল ছেঁড়া পুরনো নোটকেও মানুষ মানিব্যাগেই সাজায়, আর পুরনো মানুষকে আস্তাকুঁড়ে। শিউলি বেগম অবশ্য এখনো আস্তাকুঁড়ে ফেলার মত অকেজো হননি, তাই হয়তো এখনো রান্নাঘরে ঠাঁই মিলেছে। শুধু কানে একটুখানি কম শোনেন এখন এই যা। এই যেমন সেদিন তাকে বলা হল পানি এসেছে, আর তিনি শুনলেন নানী এসেছে। তিনি অবাক হয়ে নানী খুঁজতে লাগলেন পুরো ঘরে, আর এই অবসরে পানি শেষ! তারপর আর কি, সেদিনের মত তার ভাত বন্ধ হয়ে গেল, এই যা! অবশ্য তাতে তেমন কিছুই যায় আসে না। তিনি আজকাল পানি খেয়ে বেশ কাটিয়ে দিতে পারেন। অনেক অভ্যাসের ফসল বলে কথা।
রমজান সাহেব আজ অনেকগুলো ছোট মাছ এনেছেন। শিউলি বেগম সেগুলো নিয়ে কুটতে বসলেন। আগে এতসব মাছ তিনি নিমেষেই কুটতে পারতেন। তখন তার নুতন বিয়ে, কিশোর বয়স। এখন তিনি চোখে ঠাহর পাননা। তাকে চশমা এনে দেবে এমন কেউও বোধহয় তিনকূলে নাই। তাই তিনি বয়সের ভারে কুঁতকুঁতে চোখজোড়া যতদূর সম্ভব বড় বড় করে মাছ কুটতে শুরু করেন। অনেক সময় লাগছে। হাত দুটো না কাঁপলে এত সময় লাগত না। তার ভয় হচ্ছে। না জানি দেখা যাবে রমজান সাহেব যখন হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে গেছেন তখনও তিনি মাথা গুঁজে একমনে মাছ কুটেই যাচ্ছেন! সেটা বড় বিশ্রী ব্যাপার হবে। তাই তিনি মাছগুলো তাড়াতাড়ি কুটতে গেলেন, আর তখনই ব্যাপারটা ঘটল।
মাছ কাটার বটিতে তার আঙ্গুল অনেকটাই কেটে গেল। বটির নিচে বাসনে রক্ত পড়ে জমাট হচ্ছে মৃত মাছগুলোর ওপর। শিউলি বেগম একমনে চেয়ে আছেন সেদিকে। আবছা চোখে সারি সারি মরা মাছের ওপর লাল রক্তের ছিঁটে দেখে তিনি ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। তিনি ফিরে গেছেন বিয়াল্লিশ বছর আগে! তাদের বাড়ির উঠোনে এভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল লাশ, আর লাশের ওপর জমাট রক্ত! কত মানুষের লাশ! পাশের বাড়ির দীনু চাচা, চাচার দুই ছেলে, তার দেবর সুমন, উত্তরপাড়ার করিম, জব্বার, গেদুর বাপ, মতির বাপ, আরও কত! সে তখন নুতন বউ, সবাইকে কি আর চেনে! মিলিটারি সরতেই বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে শিউলি বেগম। তার স্বামীর লাশটা খুঁজে পেতে সময় লাগেনা শিউলি বেগমের। নদীতেই ঝাঁপ দিতেন তিনি। তখনই তার চোখ পড়ে লাশের মধ্যে, জমাট রক্তের মাঝে হামাগুড়ি দিচ্ছে একটা বছর দেড়েকের বাচ্চা! কার বাচ্চা, কার আদরের ধন, চোখের মনি জানেন না তিনি। মরলেন না শিউলি বেগম, ওই বাচ্চাকেই বুকে করে পাড়ি দিয়ে দিলেন জীবনের বাকিটা সময়, তার কলিজা- তার অতি আদরের রমজান, আজকের রমজান সাহেব !!!
রক্ত পড়া থামছেই না। সেদিকে খেয়াল নেই শিউলি বেগমের। তিনি এখনও মাছ কুটেই চলেছেন। ভেতর থেকে রমজানের বউয়ের গলা শোনা যাচ্ছে- “মরার বুড়ি, মরিসও না! এইকটা মাছ কুটতে এতক্ষণ লাগে! ঘরের বাকি কাজগুলো কে করবে শুনি ??”
জানালার ওপাশে তখন একটা নিঃসঙ্গ শকুন ভাসছে শরতের নির্মেঘ আকাশে ।।
যে শিউলি ফোটে না শরতে / অংকনের সাতকাহন ।।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:২০