দুপুর থেকেই আকাশে বেশ মেঘ করেছে। যদিও সেটাই বর্ণের দৌড়ানোর কারণ নয়। বর্ণকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। বিকেল প্রায় হয় হয়। ইতিমধ্যেই দেরী হয়ে গেছে কিনা কে জানে। বর্ণের হাতে ঘড়ি নেই। গতসপ্তাহে ক্রিকেট বল লেগে হাতঘড়িটা ভেঙ্গে গেছে। বাবাকে বলার সাহস পায়নি বর্ণ। এখন টিফিন খরচা বাঁচিয়ে টাকা জমাচ্ছে। ঘড়িটা মেরামত করতে হবে। ঘড়িটা থাকা এখন খুবই প্রয়োজন ছিল। সে সময় দেখতে পারছে না। সময়টা জানা জরুরী। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওকে বাসায় পৌঁছাতে হবে। ঠিক বাসায় না, বাসার ছাদে। স্যার খামোখা ক্লাসে একটা অংক বেশি করাতে গিয়ে দেরী করিয়ে দিল। বর্ণের তখন খুব রাগ হচ্ছিল। সে রাগে এক্সট্রা অংকটা খাতায় তোলে নি। রাতে অংকটা ভোগাবে অনেক।
বর্ণ ইতিমধ্যেই হাঁপিয়ে উঠেছে। পিঠের ভারি ব্যাগটা আরো ভারি মনে হচ্ছে। তবু থামার উপায় নেই। ওদের চারতলার ছাদটা দেখা যাচ্ছে।
মাথার চুলটা একটু হাত বুলিয়ে ঠিকঠাক করে ছাদে উঠে এল বর্ণ। এদিক ওদিক তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল একটা। যাক এখনো আসেনি। ওপাশের ছাদে বেশ কয়েকটা কাপড় হালকা বাতাসে দুলছে। বর্ণ একটু হাসে। পেটে খিদেটা মোচড় দিয়ে আসছে। কিন্তু মাকে বলে এসেছে খিদে নেই। খেতে বসলে দেরী হয়ে যেতে পারত। সে রিস্ক নেয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। যেকোন সময় চলে আসতে পারে। সামন্য এগিয়ে ছাদের রেলিংয়ের কাছে দাঁড়ায় বর্ণ। আকাশটা আরো কালো হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামতে পারে। বর্ণের বৃষ্টি খুব ভালো লাগে। তবু এখন ও মনে মনে চাইছে না বৃষ্টি নামুক। বৃষ্টি নামলে মেয়েটা নাও আসতে পারে। তখন বর্ণের মনটা আরো খারাপ হয়ে যাবে।
আনমনা হয়ে আকাশ দেখছিল বর্ণ। হঠাৎ তাই মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠল ও। প্রার্থিত কিছু হঠাৎ চোখের সামনে পেলে মানুষ ঠিক হয়তো এমনটাই চমকায়। তবে বর্ণ বেশ চতুর ছেলে। ঠিকই সামলে নিল ধাক্কাটা। মেয়েটা ছাদের কাপড়গুলো গুছোচ্ছে। বর্ণ জানে এরপর মেয়েটা রেলিংয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। দুবার কপালের চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরাবে। তারপর দু’মিনিট পনের সেকেন্ড আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। এরপর একপলক এদিকে ফিরে বর্ণকে দেখবে তিন সেকেন্ড, চোখের ভুরুটা একটু কুঁচকাবে। সাথে সাথে একজন মহিলার কন্ঠ শোনা যাবে, বৃষ্টি, কি হল। তাড়াতাড়ি আয়। মেয়েটা আরেকবার ওর দিকে তাকিয়ে আরেকবার ভুরু কুঁচকিয়ে কাপড়গুলো নিয়ে চলে যাবে। এই সময়টুকু বর্ণ সরাসরি ওদিকে তাকায় না। আড়চোখে দেখে। সরাসরি তাকাতে ওর সংকোচ লাগে।
টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি কাপড় গুছাচ্ছে। এখন বর্ণের সবই ভাল লাগছে। খিদেটাও এখন আর মালুম হচ্ছে না। কাপড় উঠানো হয়েছে, বর্ণ আড়চোখে লক্ষ্য করে। এখন নিশ্চয়ই মেয়েটা রেলিংয়ের দিকে যাবে। কিন্তু, বৃষ্টি কাপড় গুছিয়ে আজ আর রেলিংয়ের দিকে গেল না। সরাসরি সিঁড়ির দিকে রওনা হল। বর্ণের সব এলোমেলো হয়ে গেল। বৃষ্টি আজ একবারও ওর দিকে তাকাল না!
বর্ণ একটু ভাল করে দেখার জন্য সামান্য বামে সরতে গেল। আর তখনই হঠাৎ একটা পড়ে থাকা ইটের টুকরোয় হোঁচট খেয়ে বিকট শব্দে আছাড় খেল।
যখন ও উঠে বসছে তখন বৃষ্টির বেগ অনেকটা বেড়েছে। ওর বিভিন্ন জায়গায় কেটে ছড়ে রক্ত পড়ছে। আর মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটা মাথার ভেতর বনবন করে ঘুরছে। বর্ণ ভাবতে লাগল মারা যাচ্ছি নাতো! হঠাৎ পাশের বাড়ির ছাদে চোখ যেতেই চমকে উঠল বর্ণ।
মেয়েটা উদ্বিগ্ন চোখে ওর দিকে চেয়ে ঝুম বৃষ্টিতে ভিঝছে। আর এই বৃষ্টির জলের মাঝেও ওর চোখের জল আলাদাভাবে চেনা যাচ্ছে।
বর্ণের সে জল মুছে দিতে খুব ইচ্ছে হল।।
বর্ণবৃষ্টি ~ ০২
।।সা।ত।কা।হ।ন।।