সাংবাদিকদের বাজারমূল্য অনুসারে ন্যায্য মজুরি পাওয়া নিয়ে ভাবাটাও অনেক হাউজে দৃষ্টিকটু বলে বিবেচিত হয়। ভাবটা এমন যে- অন্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করবে সাংবাদিক, তার নিজের কোনো অধিকার থাকতে নেই। অনেকে যা বেতন পান তা’ দিয়ে সংসার চলে না! তারপরও বিনা বেতনে, অনিয়মিত বেতনে অথবা পাওনা বুঝিয়ে না দিয়ে হঠাৎ চাকরিচ্যুত করা হয় তখন ভুক্তভোগীর জীবন চালানো সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে, জীবন হয় কষ্টেগাথা।বাংলাদেশে অনেক মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে নানা ধরণের প্রভাব খাটিয়ে একটা সাইনবোর্ড জোগার হয়, কিন্তু সেখানে কর্মীদের বেতন-ভাতা দেয়ার আন্তরিক চেষ্টা বা সাধ্য থাকে না৷ প্রাণান্ত পরিশ্রম করে, পেশার জন্য জীবন বাজি রেখেও অনেক সংবাদকর্মীর যে দেশে আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং জীবনের নিরাপত্তা মেলে না; সেই দেশে ‘সাইনবোর্ডসর্বস্ব' প্রতিষ্ঠানের তথাকথিত কিছু সাংবাদিকের জীবন কাটে মহাসুখে৷
এই দেশে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশায় থেকে বেতন না পেতে-পেতে এক পর্যায়ে দেশান্তরী হবার ঘটনাও ঘটেছে, আনমনা চলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় কিংবা রোগে অকালমৃত্যুও ঘটেছে। কাউকে ভাবের ওপরে আর কাউকে হাওয়ার ওপরেও চলতে হয়। অনেক মিডিয়া হাউজের ভেতরের অবস্থা বাস্তবে এমন যে ওপর দিয়ে ফিটফাট ভেতর দিয়ে সদরঘাট। এমনও হাউজ আছে যেখানে কিছু সাংবাদিককে বেতন দেয়া হয়, বাকিরা বেতন ম্যানেজ করে চলেন! নিয়মিত বেতন না পাওয়ায় মানসিক যন্ত্রণায় অনেকে অসুস্থ হয়। অনেক সাংবাদিক বেতন না পাওয়ায়, ন্যায্য বেতন না পাওয়ায় অথবা নিয়মিত বেতন না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে অপরাধে জড়ান! অনেক সাংবাদিকের চাকরি বড় অদ্ভুত। ‘এ যুগের দাস’-এর চাকরিতে উপস্থিতিতে বিলম্ব হলে বেতন কর্তন হয়, বছরের পর বছর গেলেও চাকরি কনফার্ম করে না, কোন ছুটি-ছাটা থাকে না। দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, মায়ের অসুস্থতায় গ্রামের বাড়ি যাওয়া এমনকি বিয়ে করতে গিয়েও ছুটি মিলে না।
অনেকে সাংবাদিকদের বিনা বেতনে কাজ করাতে পারলে এই বসুন্ধরায় জন্ম নেয়া স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করেন। যারা ওপরে থেকে বেশ ফুরফুরে আমেজে থাকেন তাদের পর্যন্ত পৌঁছে না অধঃস্তন সাংবাদিকদের সংসারের কান্না! এখন পর্যন্ত অষ্টম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়িত হয়নি অধিকাংশ পত্রিকায়। এমনও পত্রিকা আছে যারা বিস্তর সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার পরও সেখানকার সাংবাদিক কর্মচারীদের নিয়মিত বেতনভাতা দেয় না! বাস্তবতা হচ্ছে অধিকাংশ পত্রিকাই সাংবাদিকদের উপযুক্ত বেতন দেয় না অথবা নিয়মিত দেয় না! কয়টা টিভি চ্যানেল তার সাংবাদিক-কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন দেয়? অনলাইন পত্রিকাগুলো কি তার স্টাফদের উপযুক্ত অথবা নিয়মিত বেতন দিচ্ছে? অস্ট্রেলিয়ায় একজন জুনিয়র রিপোর্টারকে সপ্তাহে সাড়ে সাতশ ডলারের নিচে বেতন দেওয়া যায় না। এজন্যে কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে পত্রিকা-টিভি চ্যানেলের সংখ্যা হাতে গোনা। একজনকে ন্যায্য বেতন দিতে না পারলে উল্টো মোটা জরিমানা দিতে হয়!
অথচ বাংলাদেশে দেশব্যাপী খোলা হয়েছে মিডিয়া! ব্যাংক সলভেন্সি দেখিয়ে ডিক্লারেশন নেওয়া হয়, পত্রিকার অফিস ভাড়া দিতে টাকা লাগে, কাগজ কিনতে প্রেসে টাকা লাগে কিন্তু প্রোডাক্ট যারা তৈরি করেন, সেই সাংবাদিকদের বেতনের খবর নেই। সারা দুনিয়াতে সংবাদপত্র তথা মিডিয়া একটি ব্যবসা, এর পেছনে বিনিয়োগ জড়িত। অথচ এদেশে ধান্ধাবাজ ও ধূর্ত প্রকৃতির অনেকে অপরাধ ও অন্যায়কে ধামাচাপা দিতে মিডিয়া চালু করেন। আশা দিয়ে এসবে জড়িত করেন হাজার হাজার সাংবাদিককে। ঢাকার লোকজন অফিস থেকে বেতনসহ কিছু পায় ঢাকার বাইরের ৯৯ ভাগ অথবা এরচেয়ে বেশি সাংবাদিক তা পায় না! এমন একটি পন্থা বের করা দরকার যাতে দেশে একজন সাংবাদিকও বাজারমূল্য অনুসারে ন্যায্য মজুরি ছাড়া কাজ করতে না হয়। বাজার চাহিদা অনুসারে দেশে কতটি সংবাদপত্র, টিভি, অনলাইন চলা সম্ভব সেটিও ঠিক করে এমন একটি অবস্থা নিশ্চিত করা দরকার, যেন নির্ধারিত বেতনভাতা দিতে না পারলে, কেউ কোনও মিডিয়া দোকান খুলতে ও চালাতে না পারে। অপ্রয়োজনীয় ধান্ধাবাজ মিডিয়া প্রতিষ্ঠান কাম্য হতে পারে না।
বেশ ক'মাস আগে এক বিবাহিত সাংবাদিক বন্ধু জানালেন: ছয় মাসের বেতন বকেয়া, বউ চাকরি না করলে উপোসে মরতাম৷ আর এক অবিবাহিত সাংবাদিক বন্ধুর কথা, আমার পত্রিকায় তিন মাস ধরে বেতন বন্ধ। সংসার করলে এখন কাপড় খুলে রাস্তায় হাঁটতে হতো৷ এসব সঙ্কটের সাথে ভুয়া সাংবাদিকতার বিশাল নেটওয়ার্ক যোগ হয়ে অবস্থা আরও খারাপ করেছে৷ আসল সাংবাদিকের জীবন যেখানে শঙ্কিত সেখানে ভুয়া সাংবাদিকরা চাঁদাবাজি, নারী কেলেঙ্কারি, জমি দখল থেকে শুরু করে হেন অপরাধ নেই যা করে না৷আর নামকাওয়াস্তে মিডিয়া খুলে বসা মালিকরাও ওয়েজ বোর্ডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে নিজস্ব নিয়মে নিয়োগপত্র প্রদানসহ দাসদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নিয়মগুলোকে সাংবাদিকদের মানতে বাধ্য করে থাকেন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:০৮