somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কীট : শেষ পর্ব

১৮ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কীট : প্রথম পর্ব

আজকের দিনটি আনন্দের। সচরাচর ওদের জীবনে এতোখানি আনন্দের দিন আসে না। আজকে এসেছে , আজ মিলির জন্মদিন।

জন্মদিনে ওদের কখোনোই কিছু করা হয় না। মিলিটা আগে কেক কাটার বায়না ধরতো , এখন ধরে না। অনেক বড় হয়ে গেছে , অনেক কিছু বোঝে। জীবন মাত্র ১৩ বছর বয়সেই অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। শিখিয়ে দিয়েছে ক্ষুধা পেটে কিভাবে স্কুলে যেতে হয় , কিভাবে ছেলেরা রাস্তায় বাজে মন্তব্য করলে চুপচাপ মাথা নিচু করে ঘরে ফিরে আসতে হয় , কিভাবে কষ্টের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে মাঝরাতে নিঃশব্দে কেঁদে বুক ভাসাতে হয়।

প্রতীতি আজকে এসেছে। সাদা রঙের একটা সালোয়ার-কামিজ পরণে। বেশ-ভূষা আহামরি কিছু না , তারপরও মন্টুর কাছে ওকে কেন জানি সবার চেয়ে আলাদা লাগে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে ফেলে। মেয়েদের বুদ্ধি ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি , কি জানি চোখ দেখেই হয়তো ধরে ফেলবে। ইতোমধ্যে ধরেও ফেলেছে কিনা কে জানে , তা হলেই তো সর্বনাশ।

ক্লাস শেষে মন্টু ফাঁকা একটা ক্লাসরুম খোঁজে। নতুন একটা কাজ পেয়েছে। কোচিং সেন্টারের পরীক্ষার খাতা দেখার কাজ। প্রতিটা খাতার জন্য সাড়ে তিন টাকা করে পায়। এই ব্যবস্থাটা এক দিক দিয়ে ভালো , টাকাটা সাথে সাথে পাওয়া যায়। টাকাটা পেলে আজকে মিলির জন্য এক পাউন্ডের একটা কেক নিয়ে যাবে। জীবনে ছোটবোনটাকে এক বুক ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি , বছরের একটা দিন , গরীব বলে কি একটা সামান্য কেক ও কিনে দিতে পারবে না ! সে একটা দিনমজুর , দিনে কাজ করে দিনে টাকা আনে , এই সত্যটা যেন কিছুতেই ক্লাসের ছেলেরা না ধরতে পারে সেজন্য লোকচক্ষুর আড়ালে যাবার জায়গা খোঁজে। এমন সময় নির্ঝরের ডাক শোনে "এই মন্টু শোন"
: বল।
: তোর এলগরিদম খাতাটা একটু দে তো।
: কেন ?
: আগের চারটা লেকচার তুলিনি। আমি এখানেই থাকবো , ঘন্টাদুয়েক পরে আইসা নিয়া যাইস।

মন্টু না বলতে পারে না। গরীবদের কখনো না বলতে হয় না। নিতান্তই অনিচ্ছায় খাতাটা তুলে দেয়। মনে এক ধরনের আশঙ্কা , নির্ঝর যদি ....

সবগুলো খাতা দেখে দু ঘন্টা পরে ফিরে আসে। এখানে এখনো এতো ভীড় কেন বুঝতে পারেনা। ক্লাসের কমবেশী সবাই ব্যালকনিতে দাড়ানো , মেয়েদের হাসাহাসির চাপা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সবাই ওর দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন চিড়িয়াখানার জন্তু দেখছে। কেন বুঝতে একটু দেরি হয়।

এলগরিদম খাতার যেখানে "প্রতীতি" শব্দটা একশো এক বার লিখে রেখেছিলো সেই ছেড়া পৃষ্টাটা হাতে নিয়ে নির্ঝর দাড়িয়ে আছে , মন্টুর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। সাথেসাথে মন্টুর প্রতীতির দিকে চোখ পড়ে। রাগে কাঁপছে। একসময় মন্টুর সামনে এসে দাড়ালো। মন্টু নিষ্পলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে , মানুষের নিষ্পাপ দুটি চোখ যে এতো খানি ঘৃণা ধারণ করতে পারে কে জানতো। যে মেয়েটিকে সে তার জীবনের চেয়ে ও বেশী ভালোবেসেছে তার চোখে নিজের জন্য এতোটা ঘৃনা দেখে ক্ষণিকের জন্য কিছু অনুভব করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

খানিকক্ষন বাদে মন্টুর নিথর দেহটা নতুন বিল্ডিং এর সিড়ি বেয়ে নেমে আসে। পা চলতে চাইছে না , খুব কষ্ট হচ্ছে। সে যে আসলে একটা কীট , মানুষের ভালোবাসা পাওয়া তো দূরের কথা , কাউকে ভালোবাসার অধিকার পর্যন্ত তার নেই , এই সামান্য উপলব্ধিটা এতোদিন কেন করতে পারেনি তার জন্য নিজেকে ধিক্কার দেয়।

বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। শ্রাবন মাসের অঝোর বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে অনেক প্রেমিক প্রেমিকার হাত প্রথম বারের মতো ধরবে , হাতে হাত ধরে ভিজবে , অনেকে প্রথম কদমফুলটা জোগাড় করে নিয়ে আসবে প্রিয়াকে মুগ্ধ করার জন্য। বৃষ্টি মানুষকে দেয়া সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে বড় উপহার। মানুষ বৃষ্টির সময় কাঁদতে পারে , চোখের জলের সাথে বৃষ্টির জল একাকার হয়ে যায়। মন্টু বুকফাটা কান্না আটকাতে চায় , খুব ইচ্ছে হয় বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বুকের বোঝাগুলো কমিয়ে ফেলতে , বৃষ্টির পানিতে বুকের সব কষ্টগুলো ধুয়ে ফেলতে। পারে না। ওর পড়নে তৌফিকের দেয়া শার্টটা , এটা পড়ে বৃষ্টিতে ভেজা যাবেনা , তিলা পড়ে যাবে।

বৃষ্টি থামলে ফেরার প্রস্তুতি নেয়। মেঘহীন আকাশের দিকে তাকায়। দূর আকাশের উপর জগতের সবচেয়ে বড় গল্পকার বসে আছেন। ইচ্ছে মতো চরিত্রগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। মন্টু নামের একটা কীটের সামান্য কষ্টের বিনিময়ে উনার অনেকগুলো সৃষ্টি নির্মল আনন্দ পেয়েছে , নতুন বিল্ডিং এর ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। সৃষ্টির আনন্দ মানে স্রষ্টার আনন্দ। আজকের দিনটি আনন্দের।

একটা এক পাউন্ডের কেক নিয়ে মন্টু বাসায় ফেরে। অপ্রত্যাশিত উপহারটি পেয়ে মিলি কেঁদে ফেলে । একটু পরে দেখে মন্টুর চোখে ও পানি। চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে
: কাঁদছো কেন ভাইয়া ?
: এমনি রে বুড়ি , আনন্দে কাঁদছি।

আজকের দিনটি আসলেই আনন্দের। সচরাচর ওদের জীবনে এতোখানি আনন্দের দিন আসে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:০০
৭২টি মন্তব্য ৭২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বামী-স্ত্রী'র সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনে মরিয়া বিএনপি

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৩ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১০:১৪



আপনাদের আওয়ামী স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলগা মোমেনের সেই যুগান্তকারী বাণীর কথা মনে আছে? উহা বলেছিল, ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রী'র সম্পর্কের মতো। আবার বলেছিল, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নাকি রক্তের সম্পর্ক।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেনাপ্রধান ভয় পাননি, ভয় দেখিয়েছেন।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৩ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১০:২৯


ভাইয়েরা এখনই এত আনন্দিত হইও না। সাবধানে থেকো। তোমাদের নেতারা তাঁকে 'ভারতের দালাল'সহ এতকিছু বলার পরেও তিনি কুল আছেন, তোমাদের দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছেন, এটা সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে কার্টেসি দায়িত্ব... ...বাকিটুকু পড়ুন

অন্তর্দাহ

লিখেছেন মুনতাসির রাসেল, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১২:৫০


তোমার নীরবতা আজ মহাকালের মতোই ভারী,
তোমার চোখের গভীর অশ্রুধারা
আমার প্রতিটি শ্বাসে জীবন্ত এক অভিশাপ হয়ে জেগে থাকে।
তোমার হৃদয় ভাঙার শব্দ আমি শুনিনি,
তোমার ব্যথার সুর আমি বুঝিনি—
তোমার সেই বোবা যন্ত্রণাগুলো
আমার হৃদয়ের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১:০১

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

ছবি: অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের একটি 'সংশোধিত' অংশকে রাজনৈতিকভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তবু তো ফাল্গুন রাতে এ গানের বেদনাতে আঁখি তব ছলছলো....আমার দুঃখভোলা গানগুলিরে ......

লিখেছেন ইন্দ্রনীলা, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫



মাঝে মাঝে আমার বুকের গহীনে এক ব্যথার নদী উথলে ওঠে। উথাল পাথাল ঢেউগুলো পাড়ে এসে আছড়ে পড়ে। উত্তাল বেগে ধেয়ে এসে ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ে বুকের মাঝে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×