প্রায় ষোল কোটি মানুষের এই দেশে যারা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত তারা হচ্ছেন প্রতিবন্ধী মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধীতার সম্মুখীন প্রায় আড়াই কোটি প্রতিবন্ধী মানুষের বসবাস এদেশে। আর এই মানুষগুলো বারবার বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্ত অধিকার থেকে। শুধু পরিবার, সমাজ, কিংবা সরকারই নয়, যারা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারের কথা বলে হাত তালি কুঁড়িয়ে নেন, আবার যে নেতাদের জীবিকা ও জীবন পরিচালিত হচ্ছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়নের অর্থে তারাই বেশির ভাগ সময় হরণ করছেন প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিদের অধিকার গুলো।
মূল কথাটি বলার আগে একটু পিছন থেকে শুরু করতে চাই। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিদের জন্য প্রথম আইন প্রণয়ন হয় ২০০১ সালে। যা "বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১" নামে পরিচিত ছিল। আর বিধি প্রণীত হয়েছিল আইন পাশ হবারও প্রায় ৭ বছর পরে। কিন্তু আইনটিতে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারের বিষয়টি এক্কেবারে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২০০৬ সালের ১৩ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক "প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিবর্গের অধিকার সনদ" গৃহিত হয়। বাংলাদেশ ২০০৭ সালে ৯১ তম দেশ হিসেবে সাক্ষর ও ৮ম তম দেশ হিসেবে অনুসাক্ষর করে। আর এর ফলেই ২০০১ সালের আইনটি যুগপোযুগী করার প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষের দাবির ফলে সরকার ২০০১ সালের আইনটি যুগপোযুগী করার বদলে সম্পূর্ণ একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়। ২০১৩ সালের ৩শরা অক্টোবর "প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন – ২০১৩" নামে একটি অধিকার ভিত্তিক আইন প্রণয়ন হয়। কিন্তু শুধু আইন প্রণয়ন করলেই তো চলবে না। আইনের বাস্তবায়নের জন্য চাই বিধি প্রণয়ন।
আইন পাশ হবার পাঁচ মাস পরে গত ৩ মার্চ জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিধি প্রণয়ন কমিটির সভাপতি জনাব নুরুল কবির এর সভাপতিত্বে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে খসড়া বিধি প্রণয়নের জন্য ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেড় মাস সময় বেধে দেয়া হয়। উল্লেখ্য, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর ধারা ৪১ অনুযায়ী বিধি প্রণয়নের লক্ষ্যে সাত সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটির আহবায়ক জনাব এস এম সুলতান মাহমুদ, যুগ্মমহাসচিব (প্রতিষ্ঠান), সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, এবং সদস্য সচিব অ্যাড. মোশাররফ হোসেন মজুমদার, সভাপতি, ভিপস। সদস্যরা হলেন জওয়াহেরুল ইসলাম মামুন, সভাপতি, সুইড বাংলাদেশ, জনাব এ এইচ এম নোমান খান, নির্বাহী পরিচালক, সিডিডি, ডাঃ নাফিসুর রহমান, পরিচালক, জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরাম, জনাব নব কুমার ঘোষ, সমন্বয়কারী, বিপিকেএস, জনাব মোঃ জাহিদুল কবীর, সমন্বয়কারী, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবণমান উন্নয়নের এতগুলো নেতা ওয়ার্কিং কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত থাকা শর্তেও এই আইনের বিধি যেন আটকে গিয়েছে দীর্ঘসূত্রিতার অদৃশ্য জালে। ঠিক পরিপত্র জারি করার আগ মুহূর্তে আরো একমাস বাড়িয়ে ১৫ মে পর্যন্ত করা হয়। কোন এক অদৃশ্য সুতার টানে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন তা আবার তৃতীয় দফায় আরও দেড় মাস সময় বৃদ্ধি করে। মূলত ৭ সদস্য বিশিষ্ট এই ওয়ার্কিং কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা নিজেদের কর্ম ব্যস্ততার অজুহাতে একটি বৈঠকেও অংশ নিতে পারেন নি। অথচ ওনারাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলে হাততালি কুড়াচ্ছেন এবং আইন বাস্তবায়নে দাতা সংস্থার কাছে থেকে বড় অংকের ফান্ডও আনছেন। আবার সরকার বিধি প্রণয়নের জন্য ওয়ার্কিং কমিটি করার পর সেখানেও নিজেদের নেতৃত্ব জাহির করতে সেই কমিটির সদস্য হলেন। এটা খুবই দুঃখজনক। এই সব বড় বড় নেতা আর সরকারী আমলাদের অবহেলার ফলে "প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন – ২০১৩" এর বিধির খসরা প্রণয়নের কাজ জলে যেতে বসেছে। অথচ এই আইনের এক মাস পরে পাশ হওয়া নিউরো ডেভলাপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩ এর বিধি প্রণয়ন কোন এক জাদুমন্ত্রবলে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়াই তড়িৎ গতিতে এগিয়ে বর্তমানে প্রায় সমাপ্তির পথে।
আজ যারা বিধি প্রণয়ন কমিটির নেতা, গত এক যুগ ধরে তাদের অভিযোগ ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতার অভাবে প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন বাস্তবায়ন করা যায় নি এবং বিধি প্রণীত হয়েছে আইন পাশ হবারও প্রায় ৭ বছর পরে। প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়ন ও অধিকার অর্জনে সোচ্চার এই নেতারাই আজ দায়িত্ব পেয়ে সেই পথেই হাঁটছেন। কোন কারণে যদি বিধি প্রণয়নের কাজ বন্ধ হয়ে যায়, এই নেতারাই তখন কি সকল দায় রাজনৈতিক দলগুলোর উপর চাপাবেন না?
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে এই বিষয়টি নিয়ে লেখালিখি শুরু করলে ওয়ার্কিং কমিটির তিনজন সদস্য জানান জুন মাসের মধ্যেই খসরার কাজ শেষ করে মূল কমিটির কাছে খসরা জমা দিবে। কিন্তু আজ জুন মাস শেষ হতে চলেছে কিন্তু খসরা জমা দেবার নাম গন্ধ নেই। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার নিয়ে দেশে এইসব তামাশা কবে বন্ধ হবে? এই কর্মব্যস্ত নেতাদের কমিটির সদস্য কেনই বা করা হচ্ছে, আবার সব জেনেও প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন তাদের মাসের পর মাস সময় বৃদ্ধির অন্যায় আবদার কিভাবে মেনে নিচ্ছে, তা সত্যিই প্রতিবন্ধী মানুষের বোধগম্য নয়। আজ প্রতিবন্ধী মানুষ সরকারের কাছে, বিধি প্রণয়ন কমিটির কাছে, বিধি প্রণয়ন কমিটি কর্তৃক গঠিত ওয়ার্কিং কমিটির কাছে জানতে চায় তাদের অধিকার নিয়ে এই খেলার শেষ কোথায়? পারবেন কি জবাব দিতে?
এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত
ডিজেবিলিটি এক্টিবিষ্ট
ই-মেল: [email protected]
ফেসবুক: [email protected]