somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"ভিক্টোরিয়া"

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অভিজ্ঞতা সকলেরই হয়ে থাকে, আমারো তার ব্যতিক্রম নয়। তবে সেবার কলকাতায় আমার সাথে হওয়া এক ঘটনা আমাকে পুরোপুরি নির্বাক করে দেয়, এখনো যখনই সেই কথা মনে পড়ে যায় স্তম্ভিত হই।
তখন গ্রীষ্মকাল, প্রচন্ড দাবদাহ, গরমে নাজেহাল। তবে উপায় নেই কাজে যেতেই হবে। শহরের উত্তপ্ত পথ ধরে হাঁটছিলাম, চারিদিকে রুগ্নতা খাঁ খাঁ করছিলো। একটু যেতেই হাঁটার গতি মন্থর হলো, খানিক দূরে সমস্ত রুগ্নতার শাসানিকে উপেক্ষা করেই স্বমহিমায় বিরাজ করছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। আকার, আয়তন, শৈল্পিক কাজ সব দেখে আশ্চর্য হতে হয়। রানী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিতে এই প্রাসাদপ্ৰম বিল্ডিংটি বানানো হয়, যার দায়িত্বে ছিলেন স্যার উইলিয়াম ইমারসন, যিনি খোদ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট এর প্রেসিডেন্টও ছিলেন। তবে বর্তমানে সেটি এখন মিউজিয়াম, যেখানে সংগ্রহে আছে তিরিশ হাজারেরও উপরে নানান সামগ্রী।
সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে গোটা প্রাসাদটি একবার দেখলাম; মনে হচ্ছিল রানী ভিক্টোরিয়া যেন স্বয়ং হাসি মুখে আমাদের ডাকছে! মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। যেখানে আমাদের কাজ ছিল সেখানে যেতে গেলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল অতিক্রম করতেই হয় কিন্তু কোনোবার সময় নিয়ে ভালোভাবে দেখার অবকাশ পাইনি।
ঢুকতেই নজরে আসলো বহু মানুষের সমাগম ভেতরে ও বাইরে, দেশ বিদেশ; জাতি ধর্ম একসাথে মিশে যেন একাকার। ভাবলাম বছরের পর বছর কত মানুষ আসছে যাচ্ছে, কতো পরিবার, কখনো সুখী যুগল কখনো বা অভিমানে জর্জরিত একাকী কেউ! কতই না স্মৃতি জড়িয়ে আছে যুগের পর যুগ ধরে। তবে সেদিন হঠাৎ জরুরী এক ফোন আসায় চলে আসতে হয়। কিন্ত পরদিন আবার যাই। সেই প্রতিদিনের মতোই এক ছবি। তবে ভেতরে না গিয়ে একটা গাছের নীচে বসলাম বাইরে থেকে রূপ উপভোগ করবো বলে। একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিলাম, কত ভিনদেশি লোকেরা এসেছে, ফোটো তুলছে। প্রেমিক প্রেমিকাদের সংখ্যাও যথেষ্ট! ভাবছি উঠে ভিতরে যাবো এমন সময় হঠাৎ পেছনে একজন এসে ঘাড় ছুঁয়েছে, অনুভব করলাম। ফিরতেই দেখি পিঠে ঝোলা নিয়ে একটি বাচ্চা মেয়ে। মিস্টি অথচ রোদে পোড়া মুখ, চুলগুলো উস্ক-খুস্কো, দৃষ্টি একাগ্র। বয়স আন্দাজ খুব বেশি হলে নয়। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, "কি নিবি ?"
কিছু বললো না। আমি একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, "কোথায় থাকিস?" তাও কোনো উত্তর নেই! অদ্ভূত তো; ভাবলাম মেয়েটি হয়তো বোবা; কথা বলতে পারে না।
আমি পকেট থেকে কিছু টাকা বার করছি দিবো বলে হঠাৎ সে আমার অন্য হাতে থাকা জলের বোতলটি নিয়ে সব জল খেয়ে খালি বোতলটি আমাকে দিয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম করছে; আমি থামতে বলায় সে দাঁড়ালো। টাকা বের করে দিতেই সে আবার মুখ ফিরিয়ে নিলো। আমি এবার একটু সংকোচের সাথেই জিজ্ঞেস করলাম, "তুই কি কথা বলতে পারিস না ?" দেখে খুব মায়া হচ্ছিল...জিজ্ঞেস করতেই সে বললো, " আমি এখানেই থাকি আঙ্কেল, আর আমি কারো কাছ থেকে টাকা নেই না।" আমি লজ্জিত বোধ করলাম সাথে অবাকও হলাম; কি মিষ্টি গলা। আমি বললাম, "তোর বাড়িতে কে কে আছে ?" সে আবার চুপ, যেন চলে যেতে পারলেই বাঁচে! আবার বলাতে সে বললো, "কেউ নেই।" আরো অবাক হলাম তার কথা শুনে। মনে মনে ভাবলাম এইটুকু বাচ্চা মেয়ে থাকে কোথায়, কিই বা করে ! আমি বললাম, "কেন তোর বাবা, মা এরা কোথায়; আর তুই এইটুকু মেয়ে কোথায় থাকিস , কি করিস?" সে বললো, "মা নেই, বাবাও নেই ; দুজনেই চাঁদে। আমার বাবাকে কালী পূজোর দিন রাতে দুজন বাইরে নিয়ে যায় কিন্তু বাবা আর ফেরে নি। আর মা সেদিন আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল, সকালে উঠে কতো ডাকলাম কিন্তু উঠলো না তার পর থেকে মাকেও আর দেখি না । সবাই বলে তারা চাঁদে ঘুরতে গিয়েছে। কবে আসবে কে জানে।"
আমি জড় বস্তুর মতো নির্বাক হয়ে তার কথা শুনছিলাম, বুঝতে বাকি রইল না যে তার বাবা, মা কেউ নেই; দুজনেই মৃত, তাঁরা আর কোনদিনও ফিরে আসবে না। বাচ্চা মেয়েটির চোখ ছল ছল করছিল। এই পৃথিবীতে তার কেউ নেই, সারা দিন হয়ত এই শহরের বুকে ঘুরে বেড়ায়, ঠিককরে দুবেলা খেতেও হয়তো পায় না, কি করে ওই একের পর এক দিন পার করছিল আমি কল্পনাও করতে পারছিলাম না। সে অনাথ, সে নিজেই জানেনা সে কতো বড়ো লড়াই লড়ছে এই প্রতিকূল প্রকৃতির সাথে! আমি দুহাত দিয়ে তাকে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, "তুই রাতে কোথায় থাকিস?" সে বললো,"এক কাকু আমাকে নিয়ে গিয়েছিল তাদের বাড়িতে, কাকুটা ভালোবাসতো কিন্তু কাকিমা আমাকে খুব বকতো, কাকু চলে গেলেই আমাকে কাপড় কাচঁতে বলতো, বাসন মাজতে বলতো, আমি তো ছোট তাই পারতাম না, সেদিন একটা কাপ ভেঙে যায় মাজতে গিয়ে, খুব করে মারলো সেদিন, পরদিন রাতে আমি পালিয়ে যাই।" ততক্ষণে সে হাঁটু গেড়ে বসেছে। ওর দিকে যতবার তাকিয়েছি ভালোবাসা তত বেড়েছে। আমি শুধু পাথরের মতো দাঁড়িয়ে তার কথা শুনছিলাম। সে আরো বলে, "জানো জানো কাকু, কাল কাঠ কুড়োতে গিয়েছিলাম, সেখানে ৫০০ টাকা পাই কুড়িয়ে, আমি ভয় পাই এত টাকা কি করবো, কাকে দিবো, পাশে রাস্তার ধারে একটা তোমার মতোই কাকু দাঁড়িয়ে ছিল; আমি তাকে বললাম এই টাকা গুলো পেলাম আঙ্কেল, কার যে টাকা কি করি, তুমি জানো এগুলো কার টাকা?; সে আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললো ওগুলো ওর টাকা। আমি বললাম, না এগুলো তোমার নয়, আমি কাঠ কুড়োতে গিয়ে পেয়েছি। সে আমাকে জোরে করে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেল। কাল খুব লেগেছে কোমরে। কি দুস্টু কাকুটা।" আমি বিস্ময়ের সাথে তার কথা শুনছি। অনেকদিন পর চোখে জল চলে এসেছিল সেদিন। কিছু বলার ক্ষমতা টুকু ছিল না। বুক কে যেন পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। ভাবলাম সে শুধু একাই না পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায়ও বটে। নিজেকে একটু সামলে তার গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "তোর নাম টাই শোনা হয় নি রে, কি নাম তোর?" সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, "আমি অনেক বড়ো স্কুলে পড়তাম জানো, অনেক বন্ধু ছিল, এখন কেউ নেই। তবে সেদিন তুন্নি কে দেখলাম মায়ের সাথে গাড়িবকরে যাচ্ছিল, কতো বড়ো পুতুল ওর হাতে, আমি কত ডাকলাম, শুনতেই পেলো না, গাড়িটা চলে গেল। বাবা বলতো তুই আমার একমাত্র রাজকন্যা, তোর এরকম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের মতো প্রাসাদে বিয়ে হবে, আর মা বলতো আমি রানী ভিক্টোরিয়ার মতো দেখতে। মা আমাকে কতো ভালোবাসতো জানো। ওই যে ঐ বাড়িটা দেখছো ওটা আমাদের বাড়ি ছিল। এখন যে করা এসেছে আমাকেই ঢুকতে দেয় না। বাবা আসুক মা আসুক আমি সব বলবো। কেউ আমাকে ভালোবাসে না আর।"
কখন যে আকাশে মেঘ করে এসেছে লক্ষই করি নি। এই বুঝি বৃষ্টি আসবে। মেয়েটির দিকে তাকাতে পারছিলাম না। হয়তো গোটা ব্রহ্মাণ্ড তার কথা শুনছে আর কান্না চেপে রাখতে না পেরে বৃষ্টি হয়ে পড়বে!
আমি তার গালে হাত দিয়ে বললাম, "তুই খুব মিষ্টি, তুই অনেক বড় হবি, অনেক বড়, কখনো খারাপ দিকে যাবি না কেমন... আচ্ছা, তুই কিন্তু এখনো নাম বলিস নি!" ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে এখনই ঝমজমিয়ে পড়বে। সে আলতো হেসে কিছুক্ষণ চুপ কিরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর নামটি বলেই দৌড় দিলো... সে বলল, "আমি ভিক্টোরিয়া!"
আমি নির্বাক স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকলাম, প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে, প্রকান্ড কালো মেঘ। এক দৌড়ে সে যে কোথায় মিলিয়ে গেলো আর দেখতেই পেলাম না। যখন প্রাসাদের দিকে আবার ঘুরে তাকালাম তখন আবার প্রথম দিনের মতো অনুভূতি হলো, রানী যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, কিন্তু এ হাসি সেদিনের মতো নয়, এ এক অন্য হাসি! তবে কি বোঝাতে চাইছে রানী ভিক্টোরিয়া! খেয়াল হলো আমি পুরো ভিজে গিয়েছি। সবাই ছোটাছুটি করছে। কিন্তু সেই ঘোর আমার কয়েকদিন ধরে ছিল। এখনো মনে আছে সেদিন রাতে প্রচন্ড জ্বর এসেছিল!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামানের উপর আল-জাজিরা-র অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:২৮


ধীরে ধীরে অনেক চোর-বাটপারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। তবে আল জাজিরা রীতিমত কুমির খুঁজে পেয়েছে। তাদের প্রতিবেদনটি দেখার আমন্ত্রন থাকছে। এরা নাকি দেশ-প্রেমিক, ৭১-এর চেতনাধারী, তাই তেনাদের চেতনার গরমে টেকা যাচ্ছিলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আরাফাতের ড্রাগ তত্ত্ব বিশ্লেষন

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৪৭



আওয়ামীলীগের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন আরাফাত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের বিষয়ে মন্তব্য করতে যেয়ে বলে “ আন্দোলনকারীদের অনেকে ড্রাগড ছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেশীর ভাগ হিন্দু আওয়ামী লীগে ভোট দেয় বা সমর্থন করে – এই কথাটা কতটা সত্য

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:৫৯

ভোট কেন্দ্রে গিয়ে কে কাকে ভোট দিচ্ছে এটা জানার কোন উপায় নেই। কারণ প্রকাশ্যে ব্যালট পেপার ব্যালট বাক্সে ফেলা হয় না। যদিও আওয়ামী লীগ আমলে বিভিন্ন সময়ে অনেক কেন্দ্রে বাধ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড: ইউনুস দেশের বড় অংশকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ভোর ৫:২০



ড: ইউনুসের ১ম বদনাম হলো, তিনি 'সুদখোর'; ধর্মীয় কোন লোকজন ইহা পছন্দ করে না; যারা উনার সংস্হা থেকে ঋণ নিয়েছে, তারাও উনাকে সুদের কারণে পছন্দ করে না; ধর্মীয়দের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগে তো পানি দিতনা মারার আগে। এখন ভাত পানি খাওয়াইয়া মারে।

লিখেছেন আহসানের ব্লগ, ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪


আগে তো পানি দিতনা শেষ নিস্বাশের আগে। এখন ভাত পানি খাওয়াইয়া মারে। আর শামীম মোল্লা ভাইয়ের কপালে অবশ্য অত্যাচার ছাড়া কিছু জোটে নাই। “ভাই আমারে আর মাইরেন না বলে অনুনয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×