somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"ভূতুড়ে অ্যাডভেঞ্চার"

১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভ্রমন, সঙ্গীত, লেখালেখি- তিনটি শখের কোনোটিই সেভাবে পরিপূর্ণতা পায়নি। একেবারেই যে ফ্লপ তাও বলা চলে না ঠিকই; তবে দাগ কাটার মতো হয়ে উঠেনি। ম্যারমেড়ে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটছিল সময় নষ্ট করেই! আমরা পাড়ার যে কটা বন্ধু ছিলাম, তারা একসাথে হতাম সন্ধ্যার দিকে দিনু দার চায়ের দোকানে। চায়ের দোকানটি ছিল এক বাঁশ বাগানের পাশে বহু পুরোনো এক মিলের ধারে। মাটির ভাড়ে চা আর দিনু দার হরেক রকমের জমাটি গল্প শুনে আমরা যে যার মতো বাড়ি ফিরতাম। গুরুতর কোন অসুবিধে না থাকলে কেউই তেমন আড্ডা মিস করতাম না। এক একদিন গল্প, আড্ডা এমন রূপ নিত যে ঘড়ির কাঁটা কখন ১০টা অতিক্রম করে গেছে তা বুঝবার খেয়ালি হতো না। শেষমেশ বাড়ি থেকে ফোনে ধমক খেয়ে হুড়মুড়িয়ে ছুটতে হতো।
নভেম্বরের শুরুর দিকে, শীত পড়তে শুরু করেছে। গায়ে কম্বল চাপিয়ে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়ার এর চেয়ে ভালো সময় হয় না। তবে দিনু দার গল্পও কম যায় না। যথারীতি সময় মতো আমরা সকলে দিনু দার দোকানে হাজির হতাম।

তেমন এক সন্ধ্যায় দিনু দার দোকানে গিয়ে পলাশ বললো, "দিনু দা আজ কি শোনাবে বলো, ভূতুড়ে কিছু না কোনো দুঃসাহসিক অভিযান?" দিনু দা বললো, "সবাই এসেছিস? দাঁড়া, একটা কথা আছে।" "কি কথা দিনু দা?" পলাশ বললো। "বলছিলাম, অনেক তো থ্রিলিং গল্প শোনা হলো, এবার নিজেরা একটু বেরিয়ে আসলে কেমন হয়?" আরিফ বললো, "দিনু দা কি বলো! সত্যি না ইয়ার্কি ?" তার কথা শেষ না হতে হতেই রূপক বললো, "এডভেঞ্চার! মানে কোনো লোমহর্ষক মুহুর্তের সাক্ষী... দিনু দা, প্লিজ প্ল্যানটা আবার ক্যানসেল করো না।" বলে রাখি আমার আগাগোড়াই ভ্রমণ পিপাসু। তবে কোন সাধারণ ভ্রমণ না, যদি তাতে কোন রোমাঞ্চকর ব্যাপার নাই থাকলো তবে সেই ভ্রমণ আমাদের কাছে বৃথা! দিনু দা বললো, "শোন, ছোটো বেলায় আমিও কম ছিলাম না। রহস্যময় কোনো ঘটনা দেখলেই ঝুঁকে পড়তাম। তোরা আর কি, কতো ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর জায়গায় একাই চলে গিয়েছে জানিস! থাক সে সব কথা; কে কে যাবি বল, সেরম একটা জায়গা আছে। ভাবছি কালই বেরিয়ে পরবো। তোরা বাড়িতে কথা বলে নিয়ে আমায় জানা।"

আমি বললাম, "সে কোনো ব্যাপার না দিনু দা, ও ঠিক আমরা ম্যানেজ করে নেবো, আর আমরা সকলেই যাবো। এসবে আমাদের না নেই। তুমি তো জানোই।"

"তবে শোন, সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলে কাল ঠিক দুপুর ২ টার গাড়ি ধরবো। তোরা যা যা দরকার সঙ্গে নিয়ে নিস।" পলাশ বললো, " আচ্ছা দিনু দা, জায়গাটির নাম কি?" একটু চুপ করে থেকে গম্ভীর হয়ে দিনু দা বললো, "কর্কটগ্রাম।"

সেদিন আর তেমন আড্ডা হলো না। সবাই তাড়াতাড়ি যে যার মতো বাড়ি ফিরলাম। যেতে যেতে যা কথাবার্তা চললো আমাদের মধ্যে, তা থেকে এটুকু পরিষ্কার; আমাদের এখন থেকেই উত্তেজনার পারদ চড়তে শুরু করেছে। আজ রাতের ঘুম যে মাটি তা সকলেই জানতাম।

পরদিন দিনু দার কথা মতো ঠিক সময়ে সবাই বাস স্টপের কাছে পৌঁছলাম, দেখি দিনু দা আগের থেকেই দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। দিনু দা বললো, "গ্রাম টিতে যেতে হলে বাস থেকে নেমে আরো বেশ খানিক পথ ভিতরে যেতে হয়। এমনিতেই পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে তার পর রাতের অন্ধকারে অচেনা গ্রামে প্রবেশ, যেখানে আমাদের পরিচিত কেউ নেই! এডভেঞ্চার কিন্তু জমতে চলছে" বলে হো হো করে হেসে উঠলো।

আমরা সবাই বাসে উঠে বসলাম। আরিফ বললো, "কতক্ষণ লাগবে দিনু দা পৌঁছতে।" দিনু দা বললো, "রাস্তা ঘাটের যা অবস্থা কম করে ৪ ঘন্টা লেগে যেতে পারে।" রূপক বললো, "আচ্ছা দিনু দা আমরা তো যাচ্ছি, কিন্তু থাকা; খাওয়া কোথায় কি হবে কিছু ভেবেছো ?" দিনু দা বললো, "ওসব কিছু চিন্তা করতে হবে না রে রূপক, গেলেই বুঝতে পারবি। তবে শোন, গ্রামটির এক বিশেষত্ব আছে, গ্রামটি দিনের বেলায় যেমন সুন্দর তেমনি মনোরম তবে রাত্রি হলেই সব উল্টো! বেশ বদনামও কিন্ত এজন্য গ্রামটির। তোরা সবাই সতর্ক থাকবি।" আমি বললাম, "আরে দিনু দা এরকমই তো চাই, এরম না হলে জমবে কি করে। অভিযান তো তবে বৃথা !" পলাশ বললো, "জয় মা কালী, আমরা আসছি!"

এভাবে না না কথা হলো। সাথে গল্প, আড্ডা তো আছেই, আমাদের সঙ্গে সাথ দিয়েছিল বাসের এক যাত্রীও, কথা বলে জানলাম তিনি আমাদের গ্রামের আগের স্টপেজ এ নামবেন। আমরা কোথায় যাচ্ছি শুনে একটু ভুরু কুঁচকোলেন, তবে কিছু বললেন না। মাঝে দেখলাম দিনু দা দিব্যি ঘুমিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ বাদে বসের কন্ডাক্টর কর্কটগ্রাম বলে চেঁচিয়ে উঠলো। ঘড়িতে দেখলাম ৬ টা পার হয়ে গিয়েছে। শীতের সময়, হালকা কুয়াশার চাদর মেখে আমরা নামলাম। মনে হচ্ছে যেন রাত ১০ টা বাজে। বাস আমাদের নামিয়ে চলে গেল। সেখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নামলো না। বসে গল্প করার সময় সেই যাত্রীর কাছে শুনেছিলাম এই গ্রামে লোকজন খুব কম। আগে ভালোই জনবসতি ছিল, কিন্তু দিন কে দিন লোকজন কমছে। কেন জিজ্ঞেস করাতে তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছিলেন।

যাই হোক আমরা নেমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম, কোনো কিছু পাওয়া যায় নাকি। এমনিতেই শীতের রাত, কোনো জনপ্রাণী নেই রাস্তায়, দিনু দার চিন্তা একটু বাড়লো। দিনু দা বললো, "দিনের আলো থাকতে পৌঁছালে ভালো হতো। নতুন জায়গা; কোন দিকে কি কিছুই তো ঠাহর করতে পারছিনা।" হঠাৎ রূপক বললো, "দিনু দা, দেখো ওই যে বট গাছটা, ওখানে কে যেন বসে আছে মাচার ওপরে।" একটু ভালো করে তাকাতেই দেখতে পেলাম, আরে তাই তো; আমরা কেউ লক্ষই করিনি। দেখে মনে হচ্ছিলো কোনো বন্য পশু ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। দিনু দা এগিয়ে গেলো, পেছনে পেছনে আমরা। দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে দিনু দা ডাকদিলো ওহ মশাই, ওহ মশাই বলে। বয়স্ক লোকটি কচ্ছপের মতো ধীর গতিতে মাথা তুলে বললো, "কি চাই?" দিনু দা বললো, "মশাই, আমরা এ গ্রামে ঘুরতে এসেছি। এই প্রথমবার, তাই একটু অসুবিধা হচ্ছে, দেখছি দুটো রাস্তা দু দিকে চলে গিয়েছে, কোন রাস্তা নিলে পুরোনো জমিদার বাড়ি যাওয়া যাবে বলতে পারেন?" দিনু দার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বয়ষ্ক লোকটি বললো, "জমিদার বাড়ি যাবেন? আপনার সাহস তো মন্দ না। যারা আসে দিনের আলো থাকতে জমিদার বাড়ি ঘুরে যায়...।" তার কথা শেষ না হতে হতেই রূপক হেসে বললো, "ভূত আছে বুঝি ? ওসব ভাবতে হবে না দাদু, আমরা ওই জন্যই এসেছি। আপনি শুধু বলুন কোন দিক দিয়ে যাবো।" বয়স্ক লোকটি এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা নিচু করে বললো, "বেশ, যখন তোমরা যাবেই; সোজা গিয়ে ডান দিকের রাস্তা নাও। জমিদার বাড়ি এখান থেকে আরো ২ কিলোমিটার।" পলাশ বললো, "ওরে বাবা, আরো ২ কিলোমিটার! পায়ে হেঁটে যেতে হবে নাকি !" বয়স্ক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, "আমার ঠেলা গাড়ি আছে, আমি দিয়ে আসতে পারি।" আরিফ বলে উঠলো, "কই ঠেলা, আপনি তো একাই বসে আছেন।" বয়স্ক বললো, "আছে গাছের পেছনে।" আমরা উঁকি মেরে ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, আসলে এতো অন্ধকার; তার উপর কুয়াশা, সব কিছু ঝাপসা দেখাচ্ছিল। চারিদিকে যেন থমথমে ভুতুড়ে পরিবেশ।

বুড়ো ঠেলা নিয়ে আসলে, আমরা সবাই উঠে বসলাম। রূপক কে দেখে বোঝা যাচ্ছিল; সে এডভেঞ্চারের সমস্ত স্বাদ নিতে তৈরি। বুড়োর ঠেলা মন্থর গতিতে চলতে শুরু করলো। যত গ্রামের ভেতরের দিকে যেতে থাকলাম, তত অন্ধকার ঘন হয়ে এল। চারিদিকে নজরে পড়ছে কেমন ধোঁয়া-ধোঁয়া, নিষ্প্রভ। প্রথমে রাস্তার দু ধারে বড়ো বড়ো ইউক্যালিপটাস গাছের বন দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছিল আমরা মাঝরাতে গ্রামে ঢুকছি। লোকজন কেনো একটা কুকুর পর্যন্ত নেই কোথাও। পলাশ সবার শেষে বসেছিল। দেখে বুঝলাম একটু হলেও ভয় ভয় পাচ্ছে। বেশ আঁটোসাঁটো হয়ে চুপ করে বসে আছে। আরিফ বললো, যতই বলো দিনু দা, এমনিতেই আনকা জায়গা, তার উপর রাত্রিবেলা। চেনাজানাও কেউ নেই এ গ্রামে। তারমধ্যে কেমন ভূতুড়ে পরিবেশ। গায়ের রোম কিন্তু শিরসিরিয়ে উঠছে!" দিনু দা একটু হেসে উত্তর দিলো, "ঠিক বলেছিস, তা এমনটা না হলে আর কিসের এডভেঞ্চার পাগলা!" রূপক বললো , "ভালো জায়গায় নিয়ে এসেছ দিনু দা। আমার কিন্তু দারুন লাগছে।" বুড়ো কিছু বলছিলো না, এতক্ষনে বললো, "জমিদার বাড়িতে একটু সাবধানে থাকবেন। যে কয়েকজন বাড়ির দেখাশোনার কাজে আছে, ওসব তাদের সয়ে গিয়েছে। কিন্তু আপনারা নতুন এসেছেন। ভিমরি খেতে পারেন।" দিনু দা একটু গম্ভীর ভাবে বললো, "সে জন্যই তো আসা।"

ঠেলায় কোনো প্রকার আলো ছিলো না। অন্ধকারে রাস্তার খানাখন্দে চাকা পরে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল। বুড়ো বললো, "রাস্তার দু ধারেই শ্মশান। তার পাশে বিশাল আমবাগান। আরেকটু গেলে হাতের বাঁদিকে বিশাল কালী মন্দির, জমিদার বাড়ির। পুজোর দিন যত বলী হয় চারিদিক রক্তে ভেসে যায়। মেলাও বসে গ্রামে। দূর দূর গ্রাম থেকে লোক আসে, মানত করে।" কিছুক্ষণ পর ঠেলা সেই মন্দির টি অতিক্রম করলো। কুয়াশা ও অন্ধকারে ঠিক মতো দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছিল মন্দির টি বেশ পুরানো। বুড়ো জানালো, আর মিনিট তিনেকের মধ্যে জমিদার বাড়ি পৌঁছে যাবে। হঠাৎ পলাশ চমকে উঠে বললো; "মাথায় কি যেন পড়লো!" "ভয় পেয়েছো বুঝি? হাহাহাহা... ও কিস্যু নয়; গাছের পাতা বেয়ে কুয়াশার জল পড়েছে" বুড়ো বললো।

ইতিমধ্যে আমরা জমিদার বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলাম। দেখলাম, দুজন দারোয়ান লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ পুরোনো জমিদার বাড়ি, দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো পড়ো ভূতুড়ে বাড়ি! দিনু দা নেমে তাদের সাথে একটু কথা বলে ফিরে এলো। বললো ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে, চল ভিতরে। বুড়ো আমাদের ডেকে বললো, "একটু সাবধানে থাকবেন, জমিদার বাড়ির কিন্তু বদনাম আছে!" এই বলে সে চলে গেল। একটা দারোয়ান দাঁড়িয়েই থাকলো, আরেকজন আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলো। জমিদার বাড়িটি দোতলা। দারোয়ানটি আমাদের একটি ঘরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেলো, দেখলাম একটি বয়স্ক লোক, মাথার চুল সাদা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। কথা বলে জানলাম, এই বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্বে তিনিই আছেন। তিনি আবার বেশ রসিক গোছের লোক। তিনি আমাদের সিঁড়ি দিয়ে উপরের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন, বললেন, "দরদস্তুর একখানা বড়ো ঘরও পেয়ে গেলেন, এখানে আপনারা সকলে আরাম করেই থাকতে পারবেন।" তিনদিকে জানলা, বাইরে ঘরের বাইরে টবে নানা ধরণের গাছ। উপরে ঘুরে বেড়ানোর মতো ঘেরা ছাদ। রাতের খাবারের সময় দারোয়ান এসে ডেকে যাবে, একথা বলে তিনি চলে গেলেন।

আমরা একেবারে ফ্রেস হয়ে ঘরে ঢুকলাম। ঘরে পা দিতেই ঝনঝন করে আলগা শব্দ হলো। কেউ কোনই রিয়্যাক্ট করলো না দেখে ভাবলাম হয়তো আমারই শোনার ভুল। ঘরের মধ্যেকার শৌখিন আসবাবপত্র গুলো দেখে মনে হচ্ছিলো কোনো প্রাচীন রাজবাড়ি, কেননা তার উপর ধূলোর পুরু স্তর জমে আছে। অনেকদিন কেউ এ ঘরে ঢোকেনি তা বুঝতে পারলাম। রূপক বললো, "ঘর টা কিন্তু বেশ, কি বলো দিনু দা?" "তা বটে" বললো দিনু দা। বিছানায় বসে আমি ভাবলাম তাদের বলা কথা, বললাম; "শোন আরিফ, ঠেলাওয়ালা বুড়োই বল, আর বাসের সেই অচেনা যাত্রী, তাদের সবার কথা কিন্তু একই ছিলো, বাড়ির বদনাম আছে। কেউ এ বিষয় টাকে হালকা ভাবে নিস না। যা কিছু করি বা যেখানেই যাই না কেনো, আমরা সবাই একসাথে থাকবো।

কিছুক্ষণ পর একজন দারোয়ান এসে আমাদের খেতে ডাকলো। আমরা ঘর বন্ধ করে সবাই নিচে গেলাম। বয়স্ক লোকটি খাবার ঘরে বসে ছিল। আমরা যেতেই "আসুন, আসুন, খেয়ে নিন" বলে আমাদের আপ্যায়ন করলো। রকমারী খাবারের আয়োজন। আমরা খেতে বসে সেই বয়স্কের মুখে অনেক গল্প শুনলাম। নানা ঘটনা আশ্চর্য করে দেবার মতো। এই গ্রামের যিনি জমিদার ছিলেন তিনি অনেক ধনী জমিদার ছিলেন। প্রচুর ধনসম্পদ ছিল তার। তাই স্বাভাবিকভাবেই ডাকাতদের দৃষ্টিতে ছিল এই জমিদার বাড়ি লুঠ করা। এক রাতে ডাকাতের দল জমিদার বাড়ি ঢুকে, জমিদার ছিলেন খুব সাহসী ব্যক্তি, তিনি বুঝতে পেরে নিজে বেরিয়ে আসেন মোকাবিলা করার জন্য। কিন্তু ডাকাত দল জমিদারের গলায় চাকু মেরে পালায়। ডাকাত দল বাড়ির কোনো জিনিস নিয়ে যেতে পারে নি কিন্তু জমিদারের প্রাণ চলে যায়। কিছুদিন পর থেকে গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় নানা ভূতুড়ে ঘটনা ঘটতে থাকে কিন্তু কারো কোনো ক্ষতি হয় না। এই যেমন কারো বাড়ির কুয়োর জল একদিন সম্পূর্ন শুকিয়ে যায় তো পরের দিন আবার ফুলে ফেঁপে উঠে। ঝড় বৃষ্টি না হতেও গাছ উপরের পরে থাকে। আবার কারো বাড়ির আসবাব পত্রের স্থান বদল হয়ে যায়। তবে লক্ষ করার বিষয় যারা গ্রামে অসৎ লোক হিসাবে পরিচিত তাদের সাথেই এমন হতো।

বয়স্ক আরো বললো, জমিদার ভাবতেন যারা তার ভালো চায় না তারা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে খুন করতে চায়। জমিদার কখনো তাঁর এলাকায় কোনো খারাপ কাজ হতে দিতেন না। এর ফলে গ্রামের অসাধু লোকেরা জমিদারের খারাপ করার চেষ্টা করতো।

আমাদের সবার খাওয়া অনেক্ষন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সবাই চুপ করে গল্প শুনছিলাম একমনে। ঘরের পরিবেশও ছিল সেরকম। চারিদিকে অন্ধকার, টেবিলে একটিমাত্র বড়ো মোম জ্বলছে। আলোর ছটা চারিদিকে আবছা করে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরের পুরনো অথচ দামি শৌখিন জিনিস গুলো যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সব কিছুর মধ্যে একটা পুরনো পুরনো গন্ধ!

তারপর আমরা খাওয়ার পর্ব শেষ করে উপরে উঠলাম। বয়স্ক জানালো, রাতে ভয় পেলেও ভয় পাবেন না। জমিদার আপনাদের কিছু করবে না ! তিনি বললেন, কাল সকালে গ্রাম তা ঘুরে এসো, কিছু ভালো ভালো জায়গা আছে। আমরা তার কথায় সম্মতি জানিয়ে শুভ রাত্রি বলে উপরে চললাম।

দিনু দা বললো "কিরে, কেমন লাগছে তোদের? বেশ কিন্তু একটা রহস্য রহস্য ব্যাপার আছে। এসে মন্দ করিনি।" রূপক বললো, "একদম তাই দিনু দা, গল্প গুলো শুনতে বেশ লাগলো, কিরে আরিফ; জমিদার মশাই আমাদের সাথে আবার কিছু করবে না তো ? পলাশ বলে উঠলো, "করলে তো মন্দ হয় না, একটা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে, এরকমই তো চাই কিন্তু কোনো দিনো অনুভব করিনি। আমি বললাম ,"হুম, আর উনি তো বললেনি জমিদার ভালো লোকেদের সাথে খারাপ কিছু করেন না, কিনি ভয় নেই।

আমরা সবাই শুয়ে পড়লাম। ঘরে দুটো জানলা। একটি জানলা আমার মাথার কাছে। অল্প খুলে রেখেছিলাম। জানলা দিয়ে তারা ভরা আকাশ টাকে দেখে মনে হচ্ছিলো জোনাকির মেলা। আরিফ হঠাৎ হেসে বললো, "ও দিনু দা; ভয় পাচ্ছো নাকি?" ওর কথা শুনে দিনু দা হো হো করে হেসে উঠে বললো, "আমি ভয় পাই না, বলতে পারিস ভয় আমাকে ভয় পায়!"

সবাই এবার চুপচাপ, হয়তো ঘুমের ঘোরে। হঠাৎ পায়ের শব্দে আমার তন্দ্রা কাটলো। হ্যাঁ শব্দ হচ্ছে! ছাদের উপর দাপাদাপি করছে কারা! একের বেশি পায়ের শব্দ। সত্যিকারের ভয় মানুষের বুদ্ধিনাশ করে। আমার আর চোখ বন্ধ হলো না। দেখলাম সবাই বেশ ঘুমোচ্ছে। দিনু দাও; তারপর মনে হলো কারা যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলছে! কেমন অদ্ভুত আওয়াজ। এবার বেশ ভয় ভয় লাগলো, ভাবলাম দিনু দাকে ডাকি; হঠাৎ স্পষ্ট শুনতে পেলাম তরোয়ালের আওয়াজ। চমকে উঠলাম! নিজেকে বেশ সাহসী বলেই মনে হতো কিন্তু এবার বুক ধড়ফর করে উঠলো। চেঁচিয়ে উঠলাম দিনু দা বলে! দিনু দা ধপ করে উঠে বসে বাতি জ্বালালো। আর তার সাথে সবাই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো। সবাই কৌতূহলের সাথে আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। দিনু দা বললো, "পায়ের শব্দ? তরোয়ালের আওয়াজ?...কি তাইতো? আমিও পেয়েছি। ভয় পাসনা। এবাড়ি এরকমই। আর এ জন্যই তো এখানে আসা। রহস্য রোমাঞ্চের স্বাদ ভরপুর। আমি এতক্ষন চুপচাপ শুয়ে শুয়ে এসব উপভোগ করছিলাম।" রূপক বললো, "কই আমার তো কিছু শুনতেই পেলাম না। কিরে আরিফ, পলাশ তোরা?" ওরাও মাথা নাড়িয়ে না বললো। দিনু দা বললো, "ঘুমিয়ে কাদা হলে কি করে বুঝবি? একটু সজাগ থাকলেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিস টের পাবি, এমনি কি আর এখানে আসা...রহস্য রোমাঞ্চ প্রেমীদের জন্য সেরা জায়গা। চল এবার ঘুমিয়ে পর, অনেক রাত হলো।"

পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙলো দেখলাম এক আমাদের জন্য জলবখাবার রাখা। পলাশ বললো, "দিনু দা, কাল কি তবে জমিদার এসেছিল নাকি! ওরে বাবা তবে সত্যি সত্যিই..." দিনু দা হেসে বললো, "জমিদারের বাড়ি, জমিদার আসবে না তো কে আসবে। চল গ্রামটা একটু ঘুরে আসি।"

আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম, দিনের বেলা বুঝবার জো নেই, কিন্তু রাত হলেই অন্যরূপ। ঘুরে ঘুরে আমরা অনেক পুরোনো বাড়ি, চন্ডীমন্ডপ, কালী মন্দির, নদীর ধার ঘুরে এলাম। বেশ মনোরম ও সৌন্দর্যে ভরা। দেখলাম গ্রামে লোকজন খুব কম। বাড়ি রয়েছে অনেক কিন্তু বেশিরভাগি তালা বন্ধ অবস্থায়।

ফিরে আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেল। ভারপ্রাপ্ত বয়স্কটি আমাদের দেখে বললেন, "আপনারা কি আজি চলে যাবেন?" দিনু দা বললো, "হ্যাঁ, রহস্য রোমাঞ্চের স্বাদ পেয়ে গিয়েছি!" বয়স্ক বললো, "রাতে সেরম কিছু ঘটেছে?"

"হুম, বেশ শিহরিত হয়েছি মশাই। আরো একবার আসার ইচ্ছে থাকলো।" বয়স্ক বললো, "অবশ্যই অবশ্যই চলে আসবেন।"

আমরা ঘরে গিয়ে ব্যাগ পত্র নিয়ে রেডি হলাম। দিনু দা বললো, "সব কিছু দেখে নে ঠিকঠাক, কিছু আবার ফেলে যাস না।" পলাশ বললো, "দিনু দা, আমি আর রূপক কিন্তু তেমন কিছু অনুভব করিনি, আজ রাতটা থেকে গেলে কেমন হয়।" সাথে সাথে আমাদের সবাইকে আশ্চর্য করে উপরে রাখা বেতের ঝুড়িটি পলাশের ঘাড়ে এসে পড়লো। আমরা সবাই হতভম্ব, পলাশ দৌড়ে আমাদের দিকে এসে হাঁফাতে লাগলো। সবাই কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর নিজেকে একটু সামলে আমি বললাম, "হয়েছে অনুভব করা? আর বেশি কিছু অনুভব করতে চাও? তো তুমি থেকে যাও, আমরা চললাম।" রূপক এর চোখ ভয়ে ছল ছল করছে। আমরা সবাই নীচে নেমে এলাম। বয়স্ক কে ঘরের চাবি দিয়ে আমরা বাস ধরার জন্য পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। কারো মুখে কোনো কথা নেই। তবে দিনু দা সেই রসিক স্বরেই বললো, "তবে কেমন লাগলো বল, জমিদার কিন্তু খুব ভালো লোক বটে, তুই কিছু টের পাসনি শুনে তৎক্ষণাৎ টের পাইয়ে দিলো, হাহাহা... কি আরিফ বাবু এতো চুপচাপ কেনো?"

"দিনু দা, এই ঘটনা আমৃত্যু মনে থাকবে, একদম চাক্ষুস! উফফ... এখনো গায়ের রোম গুলো শিরসিরিয়ে উঠছে", আরিফ থেমে থেমে বললো। রূপক আর পলাশ কে দেখলাম, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দিকজ্ঞান শুন্য ভাবে, যেন কিছুর ভয় গ্রাস করেছে! আমাদের কর্কটগ্রাম অভিযান যে সার্থক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৩৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামানের উপর আল-জাজিরা-র অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:২৮


ধীরে ধীরে অনেক চোর-বাটপারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। তবে আল জাজিরা রীতিমত কুমির খুঁজে পেয়েছে। তাদের প্রতিবেদনটি দেখার আমন্ত্রন থাকছে। এরা নাকি দেশ-প্রেমিক, ৭১-এর চেতনাধারী, তাই তেনাদের চেতনার গরমে টেকা যাচ্ছিলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আরাফাতের ড্রাগ তত্ত্ব বিশ্লেষন

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৪৭



আওয়ামীলীগের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন আরাফাত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের বিষয়ে মন্তব্য করতে যেয়ে বলে “ আন্দোলনকারীদের অনেকে ড্রাগড ছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেশীর ভাগ হিন্দু আওয়ামী লীগে ভোট দেয় বা সমর্থন করে – এই কথাটা কতটা সত্য

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:৫৯

ভোট কেন্দ্রে গিয়ে কে কাকে ভোট দিচ্ছে এটা জানার কোন উপায় নেই। কারণ প্রকাশ্যে ব্যালট পেপার ব্যালট বাক্সে ফেলা হয় না। যদিও আওয়ামী লীগ আমলে বিভিন্ন সময়ে অনেক কেন্দ্রে বাধ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড: ইউনুস দেশের বড় অংশকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ভোর ৫:২০



ড: ইউনুসের ১ম বদনাম হলো, তিনি 'সুদখোর'; ধর্মীয় কোন লোকজন ইহা পছন্দ করে না; যারা উনার সংস্হা থেকে ঋণ নিয়েছে, তারাও উনাকে সুদের কারণে পছন্দ করে না; ধর্মীয়দের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগে তো পানি দিতনা মারার আগে। এখন ভাত পানি খাওয়াইয়া মারে।

লিখেছেন আহসানের ব্লগ, ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪


আগে তো পানি দিতনা শেষ নিস্বাশের আগে। এখন ভাত পানি খাওয়াইয়া মারে। আর শামীম মোল্লা ভাইয়ের কপালে অবশ্য অত্যাচার ছাড়া কিছু জোটে নাই। “ভাই আমারে আর মাইরেন না বলে অনুনয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×