অলিভার বার্তিন- প্যারিসে নিজের স্টুডিওতে বসে একের পর এক সৃষ্টি করে যায় অমূল্য সব মাস্টারপিস। সবাই মজে আছে তার দক্ষ তুলির আঁচড়ে। আর পাঁচজন শিল্পীর মতই তার উত্থান মসৃণ ছিলো না। সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে অনবরত। আর সেই সংগ্রামকে সফল করে দিয়েছিলো তার তুলির নিখুঁত আঁচড়! তার মায়াময় পোট্রেটের আবেদন বেশিদিন চাপা রইলো না। প্যারিসের নারীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী! সবাই চায় অলিভারের কোমল তুলির আঁচড়ে তার শরীরের দেহসুধা যেন ক্যানভাসে চির অমরত্ব লাভ করে।
সম্ভ্রান্ত নারীরা তার স্টুডিওতে এসে ভিড় জমাতে আরম্ভ করলো। অলিভার হাতের লক্ষ্ণী পায়ে ঠেলার মতো নির্বোধ নয়, তাই সেও ভক্তকুলকে নিরাশ করে না। যশ অর্থ প্রতিপত্তি কোনো কিছুর কমতি নেই তার। নারীও দুর্লভ নয় অলিভার বার্তিনের কাছে। তবু কোনো নারী তাকে মায়ার বাধনে বাধতে পারেনা। এভাবেই চলে যাচ্ছিলো বেশ, কিন্তু একদিন ওলটপালট হয়ে গেলো! চোখে পড়লো ডাচেস দ্য মার্তিমেনকে। প্যারিসের উঁচুতলার এক রমণী- রাজনীতিক ক্যোঁৎ গিলেরয় এর স্ত্রী। যে অলিভারের কাছে নিজের পোট্রেট আকার জন্য নারীরা পাগল, অনুরোধের পর অনুরোধে কাজ হয় না সেই অলিভার নিজেই মাদাম গিলেরয়কে তার ছবি একে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন নিজে।
স্বামী রাজনীতি আর উচ্চাভিলাষ নিয়ে ব্যস্ত, নিঃসঙ্গ স্ত্রী তার দেহময় সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে ধরা দিলো অলিভারের কাছে। এতদিনে অলিভার তার পূর্ণতা পেলো। সবার নজর এড়িয়ে চলতে লাগলো দুজনের গোপন প্রণয়। এমনকি মাদাম গিলেরয়ের একমাত্র কন্যা আন্নেতও জানতে পারলো তা তা মা প্রিয় আংকেলের কাছে সপে দিয়েছে নিজের সবটুকু। অলিভার শিল্পী; তার প্রয়োজন অনুপ্রেরণা- সে খোজে সৌন্দর্যের। মাদাম গিলেরয় একজন নিঃসঙ্গ অথচ পরিপূর্ণ রমণী। তার ভেতরে লুকিয়ে আছে রুপসুধা! একজন তৃষ্ণার্ত অন্যজন অমৃতের ভাণ্ডার। একজন প্রার্থী, অন্যজন দাত্রী! মাদাম গিলেরয় অলিভারের শিল্প-জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুললো সমস্ত দিক দিয়ে।
সময় বয়ে চললো, মাদাম গিলেরয়ের দেহ-বল্লরী ক্রমশ ম্রিয়মাণ! সেই ভূবনভোলানো মোহিনী রূপ ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে দেহের বাক থেকে; বেড়ে যাচ্ছে প্রসাধনীর ব্যবহার! একদা যে সৌন্দর্য দিয়ে সে রাজত্ব করেছে গোটা প্যারিসের নারী সমাজে, সেই সৌন্দর্য আজ অস্তগামী! এমন সময় নানীর কাছ থেকে বহুদিন পরে আন্নেত এসে হাজির। এতদিন গ্রামেই বড় হয়েছে সে! কিন্তু এক কোন আন্নেত? ছোট্ট আন্নেত যেন হুবহু পূর্ণ যৌবনা মায়ের প্রতিরূপ! আন্নেতের মধ্য দিয়েই যেন তার মায়ের সৌন্দর্যের নব সূর্যোদয় হচ্ছে!
এতদিন সবাই তাকে তার মায়ের মতো হতে বলতো, আজ সে তার আপন পরিচয়েই উদ্ভাসিত! আংকেল অলিভারও তাকে ইদানীং অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়া শুরু করেছে! যে মনোযোগের একমাত্র দাবীদার ছিলো মাদাম গিলেরয়, আজ সেই মনোযোগে ভাগ বসাচ্ছে তার মেয়ে! যে রূপ ছিলো তার, আজ সেই রূপ তার দেহ থেকে উবে গিয়ে সাজিয়ে তুলছে তার কন্যাকে! মাতা-কন্যার মধ্যে এ যেন এক অলিখিত প্রতিযোগিতা। নিজের অধিকার কি হারাচ্ছে মাদাম গিলেরয়? অলিভার কি তার মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে? নইলে মেয়ের বাকদত্তের প্রতি এত বিতৃষ্ণা কেন অলিভারের? কেনোই বা আন্নেতকে নিয়েই তার সমস্ত উচ্ছ্বাস? কি হবে এর পরিণতি?
মনস্তাত্ত্বিক ঘরানার এক অদ্ভুত কাহিনী মোপাসা'র 'Strong As Death'. একজন সৌন্দর্যপিপাসু শিল্পী যে তার প্রেমিকার রূপ-লাবণ্যের সাধনা করে এসেছে; সেই একই সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে যদি অন্য কেউ হাজির হয়, তখন শিল্পীর বিশ্বস্ততা কি বিগতযৌবনা মায়ের প্রতি অক্ষুণ্ণ থাকে? নাকি সেটি আপতিত হয় মেয়ের প্রতি? নাকি নিজে প্রেমিকাকেই সে আবিষ্কার করে প্রেমিকার সন্তানের প্রতি? আর যে প্রেমিকা তার জীবনকে কেন্দ্রীভূত করেছে শিল্পীর অনুপ্রেরণায়, সেই প্রেমিক যদি নিজের প্রতিরূপ মেয়ের প্রতি মনোযোগ সরিয়ে নেয়, তাহলে তার উপর কি প্রভাব পড়ে? সবকিছু মিলিয়ে অদ্ভুত বিষাদময় প্রলম্বিত সুরের এক জীবনগাথা 'স্ট্রং এজ ডেথ'।
ফরাসি সাহিত্যিক মোপাসাঁ বিশ্বসাহিত্যের সেরা গল্পকারদের অন্যতম। তার গল্পে আদিমতম প্রবৃত্তি তথা যৌনতা নানাভাবে উঠে এসেছে বারবার! পারিবারিক জীবনে অশান্তিই হয়তো এর কারণ! মোপাসাঁ তার তেতাল্লিশ বছরের জীবনে সৃষ্টি করে গেছেন অসাধারণ কিছু সৃষ্টি। 'স্ট্রং এজ ডেথ' তার মধ্যে একটি! এক সৌন্দর্যপিপাসু শিল্পীর মনস্তাত্ত্বিক অভিযাত্রার বিষাদ বিবরণ!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১০:০৭