কত-ই বা হবে তখন বয়স? বড়জোর ৯ কি দশ! আমাদের বাড়ি ছিল যশোরের ছোট্ট একটা গ্রামে। প্লাস্টার খসে পড়া লাল ইটের দেয়ালঘেরা একটা ঘর, একটা বড়সড় গোয়াল, কাচামাটির ছোট্ট একটি রান্নাঘর আর অনেকগুলো গাছপালা নিয়ে ছিল আমার জগত। বাড়ির পুবদিকে ছিল খেত। সেখানে ধান হত, গম হত, বেগুন, শসা, আলু এমনকি বাঁধাকপিও হত মাঝে মাঝে। বাবা সকাল হলেই দামড়া দুটোর গলায় 'জোয়াল' ঝুলিয়ে ভুঁই-তে চলে যেত। আর আমি? খেয়ে-দেয়ে মিন্টু, বিপ্লব, জ্যোতি আর পিংকিদের সাথে দলবেঁধে স্কুলে রওনা দিতাম।
আমাদের সময়ে কৈশোর ঠিক কৈশোরের মতোই ছিল। তাই পিঠের ব্যাগ বইয়ের চাপে ভারী না হয়ে তেঁতুলের বিচি, হরতুকি, গুলতি আর মারবেলে ভর্তি হয়ে থাকতো।
আরেকটা জিনিস থাকত অবশ্য! একধরণের পটকা বাজি। বারুদের পুটলি ভেতরে পুরে আকাশের দিকে ছুড়ে দিতে হতো ওটাকে। সা সা করে খানিকটা উপরের দিকে উঠে যেতো বাজিটা। তারপর ধাইধাই করে যেই নিচে এসে নামত ওমনি ফট্টাস করে বিকট শব্দ হতো।
আমরা ভালোবেসে ওকে নাম দিয়েছিলাম ‘লাদেন বোম’।
এভাবেই দিন যাচ্ছিলো। হঠাত একদিন জানতে পারলাম, সব কিছু আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। সব্বাইকে ছেড়ে আমরা অনেক দূর দেশে চলে যাব। কিন্তু কেন? মাকে বারবার জিজ্ঞেস করেও উত্তর পেলাম না। উত্তর দিলেও বুঝতাম না অবশ্য। তাই একদিন সবকিছু বেধে-ছেদে নিয়ে নতুন একটা গ্রামে চলে এলাম আমরা। সেই গ্রামেই আমার মামাবাড়ি ছিল। এসে সেখানেই উঠলাম।
তখনো থাকার জন্য নতুন বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। যেখানে বাড়ি বানানো হবে, সেখানে ছিল প্রকাণ্ড বাশ বাগান। শীতকাল সবে শেষ হয়েছে কি হয়নি! হাজারে-বিজারে পাখি সেই বাঁশঝাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। কলকাকলিতে মুখর সমস্ত জায়গা। তারা বাঁশঝাড়টাকেই ঘরবাড়ি বানিয়ে সারা শীতকালটাই কাটিয়ে দিয়েছে। ডিম-পেড়েছে, ছানাপোনা ফুটিয়েছে। এমন সময়ে বাঁশঝাড়ে কুড়ুলের কোপ পড়ল।
আস্তে আস্তে পাখিদের ডাক কমে আসতে লাগলো। অন্য কোথাও উড়ে যেতে লাগলো ওরা। ব্যবসায়ীরা প্রায় সমস্ত বাঁশ-ই কেটে নিয়ে গেছে। এক কোনায় অল্প কিছু বাঁশ অবশিষ্ট আছে। আমাদের বাড়িও থাকার জন্য কোনোমতে তৈরি।
মামাদের বাড়ি থেকে সেখানে এসে আমরা উঠলাম। আমি সারাদিন মন খারাপ করে অচেনা জায়গায় ঘোরাঘুরি করি, মা তার বাপের বাড়ির এলাকার লোকজনের সাথে গল্পগুজবে মগ্ন, বাবা বাইরে কাজ নিয়ে ব্যস্ত! আমার কিছুই ভালো লাগে না। একদিন হঠাত লক্ষ্য করলাম, বাঁশঝাড়ে একজোড়া বক বসে আছে! হলুদ আর কালো ডোরা কাটা গায়ের রঙ। বেশ সুন্দর দেখতে!
আমি অবাক হলাম! সব পাখিই না উড়ে গেছে! কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, এদের আসলে উড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ বাঁশের আগায় বাসা বেধেছে ওরা। আর সেখান থেকে মাঝেমাঝেই চি চি করে শব্দ আসছে। তার মানে ওরা ডিম পাড়তে দেরী করে ফেলেছে। তাই অন্য সবার বাচ্চারা বড় হয়ে গেলেও তাদের বাচ্চারা এখনো উড়তেই শেখেনি। এর মাঝে আমরা এসে পড়ায় বিপাকে পড়েছে ওরা।
আমি রোজ সেখানে যেয়ে বসে থাকতাম। বাবা আর মা বক মুখে করে যেই কিছু একটা নিয়ে আসতো, অমনি ছানাগুলো চিঁ চিঁ করে উঠত। একটা অলিখিত বন্ধুত্ব হয়ে গেছিলো ওদের মধ্যে। আস্তে আস্তে এমন হলো যে কণ্ঠ শুনেই আলাদা করতে পারতাম ওদের।
মোটমাট তিনটে বাচ্চা। একটা ত সারাক্ষণই চিল্লাফাল্লা করে, খালি খাইখাই যেনো! - ওর নাম দিলাম মোটু। আরেকটার চুপচাপ থাকতো সারাক্ষণ- ওর নাম দিলাম ছোটু। আর তিন নাম্বারটা ঘটু!
দিন দুই পরের কথা, নতুন যে স্কুলে ভর্তি হয়েছি ওখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময়ে বাবার কন্ঠ শুনলাম। রান্নাঘরের জন্য বাঁশের বেড়া বানাতে দুপুরে একজন লোক আসবে। আমি অতশত না ভেবে স্কুলে রওনা দিলাম। ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেলো। ব্যাগটা খাটের উপর রেখেই দৌড় দিলাম আমার নতুন বন্ধুদের দেখতে। কিন্তু কোথায় কি? আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অবশিষ্ট বাঁশগুলোর কোনো চিহ্নই নেই আর। সেগুলো এখন বেড়া হয়ে রান্নাঘরকে ঘিরে রেখেছে! কিন্তু সেই বাচ্চাগুলো? ওগুলো কোথায়? ওরা তো উড়তে পারে না।
আমি কাঁদতে কাঁদতে মাকে গিয়ে বললাম, পাখির বাচ্চাগুলোর কথা। মা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে উত্তর দিলো, বাঁশ কাটার পরে আগায় বকের বাসা থেকে তিনটে বাচ্চা পাওয়া গেছে। ওগুলো তো মিস্তিরি নিয়ে গেছে, রেঁধে খাবে বলে।
আমি নির্বাক হয়ে বসে পড়লাম। সেই মুহূর্তে প্রথম কবিতা লিখেছিলাম আমি। আজ প্রায় পনের বছর পরে ঠিক মনে নেই, ঠিক লিখেছিলাম! কিন্তু এটুকু মনে আছে, সেইক্ষণ থেকে আমার লেখালেখির সূচনা। সেই লেখালেখির প্রথম সাকার রূপ পরাণ ডোমের পোস্টমর্টেম- আত্মপ্রকাশ করলো আমার প্রথম কলম তুলে নেওয়ার পনের বছর পরে।
ওহ, ভালো কথা! আমার সেই জন্ম ভিটে নিয়ে একটি গল্প আছে বইটিতে। কোন গল্প? সেটি জানতে চাইলে অবশ্য পড়তে হবে বইটি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:২১