একটা বয়স ছিল যখন আত্মউন্নয়নমূলক বই শুধু পড়তাম না, গিলতাম। সেবা প্রকাশনীর আত্মউন্নয়নমূলক সিরিজের সব বই আমার সংগ্রহে ছিল। ‘ধূমপান ত্যাগে আত্মসম্মোহন’ নামে একটা বই পড়ে যখন দেখলাম, ধূমপান ত্যাগ কত কঠিন, সেই কিশোর বয়সেই সিদ্ধান্ত নিলাম জীবনে কখনও ধূমপান করব না। জীবনে কখনও ধূমপান করি নি, এমনকি কৌতূহলবশত একটা টান পর্যন্ত দেইনি সিগারেটে এবং আমার বন্ধুমহলে এটা একটা রেকর্ড।
যাই হোক, সেই আত্মউন্নয়নমূলক বই পড়ার ঝোঁক থেকেই ৪ বছর আগে কিনে ফেলি এই বইটি। আমার পড়া সেরা আত্মউন্নয়নমূলক বই এটি। আমেরিকান এক মনো বিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসক ডাঃ ড্যানিয়েল জি. আমেনের লেখা এই বইটি বাংলা অনুবাদ করেছেন ডঃ বসুধা বাগচী।
বইটির ৪টি অংশ।
প্রথম অংশ - আপনার সাফল্যের সংজ্ঞা।
এই অংশে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে আসলে সাফল্যটা কী এবং কী নয়। সফল হতে হলে কি কি গুণ থাকা দরকার এবং কী কী গুণ না থাকলেও চলে। সাফল্য সম্পর্কে প্রচলিত ভুলগুলোও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অংশ - স্ব-অন্তর্ঘাত কী এবং কেন ?
স্ব-অন্তর্ঘাতকে আবার ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
ক) স্ব-অন্তর্ঘাতী আচরণ
স্ব- অন্তর্ঘাতী ৬ টি আচরণের একটা তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যেমন
০১) যখনই ভুলভ্রান্তি হবে, তখনই অন্য লোককে দায়ী করার প্রবণতা
০২) নির্দিষ্ট লক্ষ্যহীনতা (জীবনের প্রতি সচেতন মনোভাব না থাকা)
০৩) সাফল্যের প্রত্যাশা না করা (অথবা ব্যর্থতা আশা করা)
০৪) ভাগ্যের অনুকূলতার উপর নির্ভর করা
০৫) সাময়িক ব্যর্থতাকে চূড়ান্ত পরাজয় ভাবা
০৬) সৃজনীশক্তির অভাব, নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়ার অক্ষমতা
খ) স্ব-অন্তর্ঘাতী কাজকর্ম
স্ব-অন্তর্ঘাতী ৭টি কাজকর্মের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যেমন :
০১) অমনোযোগ/পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাহীনতা
০২) কোনও বিষয়ে খবর না রাখা
০৩) কোনও কাজের জন্য প্রস্তুত না থাকা/অগোছাল মনোভাব
০৪) সিদ্ধান্ত নেয়ার অক্ষমতা / দোলাদোলচিত্ততা
০৫) সব কাজই নিজে করার মানসিকতা
০৬) আবেগপ্রবণতার আধিক্য/ হটকারিতা (উঠল বাই তো কটক যাই)
০৭) যুক্তিসঙ্গত ঝুঁকিও না নেবার মানসিকতা / অতি মাত্রায় সাবধানী
গ) লোকজনের সাথে ব্যবহারে স্ব-অন্তর্ঘাত :
লোকজনের সাথে ব্যবহারের ৬ টি স্ব-অন্তর্ঘাতের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যেমন :
০১) লোকজনের সাথে ভালোভাবে কথা না বলতে পারা
০২) নৈরাশ্যবাদী লোকদের মধ্যে থাকা
০৩) কারুর কাছ থেকে কিছুই না শেখা / সবজান্তার মতো ব্যবহার
০৪) প্রতিযোগিতামূলক বিষয় পরিহার
০৫) অন্যের প্রতি সহানুভূতিহীনতা
০৬) পরনির্ভরশীলতা
ঘ) ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে স্ব-অন্তর্ঘাত :
এখানে ৭টি স্ব-অন্তর্ঘাতের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যেমন :
০১) অপরিচ্ছন্ন চিন্তাভাবনা
০২) সাফল্যকে ভয় পাওয়া
০৩) মানসিক ভারসাম্যহীনতা
এখানে আবার উপ-বিভাগ রয়েছে। যেমন :
# মানসিক উদ্বেগ (ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া, আতঙ্কগ্রস্ত হওয়া, উন্মুক্ত জায়গার প্রতি আতঙ্ক, স্ব-নির্বাচিত কর্মবন্ধনজনিত মানসিক রোগ, ভয়ঙ্কর ঘটনার অভিঘাতজনিত মানসিক চাপ)
# হতাশা / বিষণ্নতার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া
# মাত্রাহীন মাদকাসক্তি (মস্তিষ্কের সর্বনাশ)
# মদ্যাসক্ত / মাদকাসক্ত পরিবারে বড় হওয়া
# মনঃসংযোগ-রহিত অবিরাম কর্মজনিত মানসিক ব্যধি
০৪) উদ্যমহীনতা, প্রাণশক্তির অভাব
০৫) চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব
০৬) আত্মবিশ্বাস না থাকা, পরনির্ভরশীলতা
০৭) সহজেই হাল ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা, অধ্যবসায়হীনতা
তৃতীয় অংশ - পরিবর্তনের পদ্ধতি
এখানে ১০টি ধাপ :
০১) পরিবর্তনের জন্য দরকার কোন অস্বস্তিকর সমস্যা। সেই সমস্যাটাই হচ্ছে পরিবর্তনের প্রধান কারণ
০২) এই অস্বস্তিকর সমস্যাটার পরিবর্তন অথবা সমাধান করতে হবে - এই সংকল্প গ্রহণ
০৩) অস্বস্তিকর সমস্যাটা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে ঠিক কোন কোন বিষয় সমস্যার সৃষ্টি করছে তা স্থির করা
০৪) এই সব সমস্যার পিছনে যে সব কারণ আছে, সেগুলো ভালোভাবে বোঝা
০৫) এই সমস্যা উপরে আপনার কতটা নিয়ন্ত্রণ আছে তা ভেবে বার করা
০৬) পরিবর্তনের জন্য বিশদ পরিকল্পনা তৈরি করা
এই ধাপের আবার কতগুলো উপ-বিভাগ আছে
ক) অপরের থেকে শিক্ষাগ্রহণ
খ) সচেতন প্রয়াস
গ) নমনীয় পরিকল্পনা
ঘ) নমনীয়তা ও অনমনীয়তার সামঞ্জস্য
ঙ) কল্পনা শক্তি
০৭) পরিবর্তন ধাপে ধাপে হয় - এ কথা মনে রেখে এগিয়ে যাওয়া
০৮) মধ্যে মধ্যে নিজের মনের দিকে তাকানো এবং নিপুণভাবে আত্মবিশ্লেষণ করা
০৯)পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করতে গিয়ে আপনি যা শিখলেন তা কাজে লাগানো
১০) পরিবর্তন এক অন্তহীন প্রবাহ, তা কখনই থেমে থাকে না
চতুর্থ অংশ - সাফল্যের জন্য ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপত্র :
এই অংশের ৪টি ভাগ -
০১) স্ব-অন্তর্ঘাতী আচরণ থেকে মুক্তিলাভ :
৬টি দোষের বিপরীতে ৬টি গুণ সৃষ্টি করতে হবে। যেমন :
০১) যখনই ভুলভ্রান্তি হবে, তখনই অন্য লোককে দায়ী করার প্রবণতা - এর বিপরীতে গুণ - নিজের উপর দায়িত্ব গ্রহণ
০২) নির্দিষ্ট লক্ষ্যহীনতা (জীবনের প্রতি সচেতন মনোভাব না থাকা) - এর বিপরীতে গুণ - সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা : যাত্রাপথের মানচিত্র
০৩) সাফল্যের প্রত্যাশা না করা (অথবা ব্যর্থতা আশা করা) - এর বিপরীতে গুণ - সাফল্যের প্রত্যাশা করা : কল্পনাশক্তির সঠিক প্রয়োগ
০৪) ভাগ্যের অনুকূলতার উপর নির্ভর করা - এর বিপরীতে গুণ - সৌভাগ্য/দুর্ভাগ্যের জন্য তৈরি থাকা : ভাগ্যলক্ষী সদাপ্রস্তুতকে সাহায্য করেন।
০৫) সাময়িক ব্যর্থতাকে চূড়ান্ত পরাজয় ভাবা - এর বিপরীতে গুণ - অতীতের ভুল অথবা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ
০৬) সৃজনীশক্তির অভাব, নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়ার অক্ষমতা - এর বিপরীতে গুণ - সৃজনশীলতা : সমস্যাকে অন্য চোখে দেখা
০২) স্ব-অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম থেকে মুক্তিলাভ :
৭টি দোষের বিপরীতে ৭টি গুণ সৃষ্টি করতে হবে। যেমন :
০১) অমনোযোগ/পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাহীনতা - এর বিপরীতে গুণ - কাজে পূর্ণ মনোযোগ : যেটা দেখছেন সেটা লক্ষ্য করা
০২) কোনও বিষয়ে খবর না রাখা - এর বিপরীতে গুণ - সব রকম খবর রাখার চেষ্টা
০৩) কোনও কাজের জন্য প্রস্তুত না থাকা/অগোছাল মনোভাব - এর বিপরীতে গুণ - সর্বদা প্রস্তুত থাকা : সব কিছু গুছিয়ে রাখার অভ্যাস
০৪) সিদ্ধান্ত নেয়ার অক্ষমতা / দোলাদোলচিত্ততা - এর বিপরীতে গুণ - সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা
০৫) সব কাজই নিজে করার মানসিকতা - এর বিপরীতে গুণ - কাজ ভাগ করে নেয়া
০৬) আবেগপ্রবণতার আধিক্য/ হটকারিতা (উঠল বাই তো কটক যাই) - এর বিপরীতে গুণ - সংযত আচরণ : সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রা
০৭) যুক্তিসঙ্গত ঝুঁকিও না নেবার মানসিকতা / অতি মাত্রায় সাবধানী - এর বিপরীতে গুণ - যুক্তিসঙ্গত মাত্রায় ঝুঁকি নেয়া
০৩) স্ব-অন্তর্ঘাতী লোক ব্যবহার থেকে মুক্তিলাভ :
৬টি দোষের বিপরীতে ৬টি গুণ সৃষ্টি করতে হবে। যেমন :
০১) লোকজনের সাথে ভালোভাবে কথা না বলতে পারা - এর বিপরীতে গুণ - ভালো কথা বলার ক্ষমতা
০২) নৈরাশ্যবাদী লোকদের মধ্যে থাকা - এর বিপরীতে গুণ - আশাবাদী লোকদের মধ্যে থাকা
০৩) কারুর কাছ থেকে কিছুই না শেখা / সবজান্তার মতো ব্যবহার - শেখবার মনোভাব : যত দিন বাঁচি, তত দিন শিখি
০৪) প্রতিযোগিতামূলক বিষয় পরিহার - এর বিপরীতে গুণ - প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ : অন্যকে না হারিয়ে জেতা
০৫) অন্যের প্রতি সহানুভূতিহীনতা - এর বিপরীতে গুণ - অন্যের প্রতি সহানুভূতি
০৬) পরনির্ভরশীলতা - এর বিপরীতে গুণ - স্ব-নির্ভরশীলতা : ‘তুমি হচ্ছ তুমি, আর আমি হচ্ছি আমি’
০৪) ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে স্ব-অন্তর্ঘাত থেকে মুক্তিলাভ :
৭টি দোষের বিপরীতে ৭টি গুণ সৃষ্টি করতে হবে। যেমন :
০১) অপরিচ্ছন্ন চিন্তাভাবনা - এর বিপরীতে গুণ - সঠিক প্রণিধান করার ক্ষমতা
০২) সাফল্যকে ভয় পাওয়া - এর বিপরীতে গুণ - সাফল্য অর্জনের নিরন্তর প্রচেষ্টা : এঞ্জিনের জ্বালানি
০৩) মানসিক ভারসাম্যহীনতা - এর বিপরীতে গুণ - মানসিক স্বাস্থ্য : স্বচ্ছ চিন্তা
০৪) উদ্যমহীনতা, প্রাণশক্তির অভাব - এর বিপরীতে গুণ - উদ্যম : পরিশ্রম করার ক্ষমতা
০৫) চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব - এর বিপরীতে গুণ - চারিত্রিক দৃঢ়তা : যে কথা সেই কাজ
০৬) আত্মবিশ্বাস না থাকা, পরনির্ভরশীলতা - এর বিপরীতে গুণ - আত্মবিশ্বাস ও আত্মশ্রদ্ধা
০৭) সহজেই হাল ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা, অধ্যবসায়হীনতা - এর বিপরীতে গুণ - অধ্যবসায় : হাল না ছাড়া
উপরের তালিকা থেকে মনে হয়, বইটা সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া গেছে। এটা কোন উপদেশমূলক বই নয়। এটি একটি প্রেসক্রিপশন, যেই প্রেসক্রিশনটি প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদাভাবে কাজে লাগবে।
আমার কাছে মনে হয় প্রত্যেকটি মানুষের এই বইটি পড়া উচিত এবং নিজের জীবনকে বদলে ফেলা উচিত। কেননা, আমরা এই পৃথিবীতে একবারই জন্মগ্রহণ করি।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ৯:৫২