somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিরাজমান সমস্যা ও সমাধান

২৭ শে মে, ২০১২ রাত ১২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সচরাচর ১০০ ভাগ সমস্যামুক্ত প্রশাসন দেখা যায় না, যত উন্নত, গতিশীল এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর প্রশাসনের ভিত স্থাপিত হোক না কেন, তাতে কিছু না কিছু সমস্যা বিরাজ করতে দেখা যায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য গতানুগতিক অনমনীয় প্রশাসন থেকে বেরিয়ে এসে নমনীয় বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় ফিরে আসা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন অথবা সাপ্তাহিক কর্মসূচীতে অভিভাবকদের সাথে মত বিনিময়ের জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখা যেতে পারে । বর্তমান ব্যবস্থাপনায় অভিভাবকরা প্রয়োজনে প্রধান শিক্ষকের সাথে আলোচনা করতে পারেন, কিন্তু একজন প্রধান শিক্ষক বা সহকারী প্রধান শিক্ষকের পক্ষে সকল অভিভাবকের সাথে আলোচনা করা অনেকটাই অসম্ভব । তাছাড়া প্রশাসনিক বিষয় ছাড়া একাডেমিক বিষয়ে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা খুব কমই হয়ে থাকে । বিদ্যালয় কর্মসূচিতে সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও যে বিষয়টি বিবেচ্য তা হলো অভিভাবকদের পেশাগত দিক । কারণ অনেক পরিবারেই অভিভাবক সদস্যই কোন পেশায় জড়িত থাকতে পারেন।

ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা

বিদ্যালয় ব্যাবস্থাপনার সমস্যাগুলো, প্রশাসনের গতিপথে অনেক সময় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অথবা সমস্যার সৃষ্টি করে। তবে সুপরিচালনা, দক্ষ নেতৃত্ব এবং যথার্থ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রশাসনকে কাঙ্ক্ষিত সাহায্য করে। প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার সফলতা এবং ব্যর্থতা নির্ভর করে এর সুষ্ঠ কাঠামোগত বিন্যাস এবং পরিচালনাগত পারদর্শীতার উপর। আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা ও জটিলতা প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নিয়ে আসে। উত্তম প্রশাসনে থাকে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, প্রশাসক-কর্মী যোগাযোগ ও উন্নত মানের আন্ত:সম্পর্ক। প্রভূত্ব বা কর্তৃত্বমূলক প্রশাসন দীর্ঘস্থায়ী সফলতা অর্জন করতে পারে না। তাই বিশ্বব্যাপী প্রশাসনে গণতান্ত্রিক চেতনার মূল্যায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশাসন এখনও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার রাহুগ্রাস মুক্ত হয়ে স্বচ্ছ হতে পারেনি। তদুপরি বেশ কিছু সমস্যা আমাদের শিক্ষা প্রশাসনে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত, এগুলো হল-

১. দক্ষ জনশক্তির অভাব
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বড় সমস্যা হ’ল দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তির অভাব, আকর্ষণীয় শিক্ষা পরিবেশ ও সুযোগ সুবিধা না থাকায় দক্ষতা ও মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ শিক্ষা সেক্টরে আসতে আগ্রহী হয় না। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় উন্নয়ন সাধন করতে হলে অবশ্যই জনশক্তির সমাগম ঘটাতে হবে।

২. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা
শিক্ষা প্রশাসনে আমলাতান্ত্রিকতার দৌরাত্ম থাকায় সর্বস্তরে যথাযথভাবে কার্যক্রম তদারকি হয় না । ফলে শিক্ষা কার্যক্রমে স্থবিরতা ও দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দেয়। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।

৩. নৈতিক অবক্ষয়
নৈতিক অবক্ষয় প্রশাসনের কার্যক্রম পরিচালনায় একটি বড় সমস্যা। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈতিক অবক্ষয় এখন আমাদের জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া না গেলে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হবে না। প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে হবে।

৪. কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা
কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা শিক্ষার স্বাভাবিক অগ্রগতির পথে একটি বাঁধা। এর ফলে যথাযথ মেধার বিকাশ ও লালন সম্ভব হচ্ছে না। বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসন বিভিন্ন স্তরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। ফলে প্রশাসনে গতিশীলতা নিশ্চিত হয়।

৫. শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম
অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় কোন নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে তাতে সুফল আসে না। আমাদের বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের কিছু নীতিমালা থাকলেও তা যথার্থভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না, ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

৬. লালফিতার দৌরাত্ম
বাংলাদেশের সরকারি অফিস আদালতগুলোতে এমন একটা পরিবেশ বিরাজ করছে যেখানে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে কোন কাজ বৈধভাবে করানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ অবস্থার প্রভাব শিক্ষা অফিসগুলোতও বিরাজ করছে। ফলে শিক্ষা প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।

৭. সমন্বয়হীনতা
শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের মাঝে যে ধরনের সমন্বয় থাকলে শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হয় বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশাসনে সে ধরনের সম্পর্ক নেই। ফলে উচ্চ স্তরের কোন সিদ্ধান্ত নিম্ন স্তরগুলোতে ঠিকভাবে ও সময়মত পৌছেঁ না, অনুরূপে নিম্ন স্তরের কোন সমস্যা সম্পর্কিত রিপোর্টও সময়মত উচ্চ স্তরে পৌছায় না। এতে শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।

৮. অনুন্নত মনিটরিং ও ফিডব্যাক প্রক্রিয়া
আমাদের শিক্ষা প্রশাসনের মনিটরিং ও ফিডব্যাক প্রক্রিয়া আধুনিক ও যথাযথ নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম মনিটরিং এর জন্য কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ মনিটরিং কার্যক্রমই কাগজে থাকলেও বাস্তবে নেই। ফলে লেখাপড়ার গুণগত মানোন্নয়ন হচ্ছে না।

৯. শিক্ষানীতির অস্পষ্টতা
আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত জাতীয়ভাবে কোন শিক্ষানীতি চালু হয় নি। ১৯৯৭ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিও বাস্তবায়িত হয়নি। কয়েকটি শিক্ষা কমিশন সময়ে সময়ে শিক্ষা সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের জন্য কাজ করেছে। সর্বশেষ কমিশন হচ্ছে মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশন। এ রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনাধীন আছে, তবে জাতীয়ভাবে একটি সার্বজনীন শিক্ষানীতি থাকা আবশ্যক ।

১০. রাজনৈতিক অস্থিরতা
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শিক্ষা প্রশাসনে গতিশীলতা আসে না, এ দেশে বার বার ক্ষমতার পট পরিবর্তনে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটে। ফলে শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিতেও পরিবর্তন আসে। এভাবে বার বার পরিবর্তন ঘটায় প্রশাসনে সিদ্ধান্তহীনতা ও দোদুল্যমানতা বিরাজ করছে।

১১. সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব
সুষ্ঠু পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত গ্রহণ। জাতীয় নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের কারণে পরিকল্পনা সুষ্ঠু হয় না, তাছাড়া পরিকল্পনা প্রণয়নে যথার্থ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার অভাবেও এরূপ সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিখুঁত পরিকল্পনার জন্য যে সকল উপাদান দরকার সেগুলোর অভাবও সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নের পথে অন্তরায়।

১২. শিক্ষা বৈষম্য
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার একটি বড় সমস্যা হল শিক্ষা বৈষম্য। সরকারি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বাজেট বরাদ্দ থেকে তা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। একটি ক্যাডেট কলেজের শিক্ষা বাজেট দিয়ে একটি জেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা যায়। অর্থাৎ মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থী তথা বিশেষ গোষ্ঠির স্বার্থ রক্ষার জন্য শিক্ষা বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়। এতে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরই থেকে যায়।

১৩. রাজনৈতিক ও পেশীশক্তির প্রভাব
অনেক সময় কিছু কিছু শিক্ষা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হওয়ার কারণে পরিবর্তিত হয়। তাছাড়া এলাকার কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠি প্রতিষ্ঠানে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েও শিক্ষা প্রশাসনের উপর প্রভাব বিস্তার করে, যা শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি জটিল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।

১৪. প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব
প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব মূলত প্রকার- অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বহি:দ্বন্দ্ব। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত গ্রহণে মত দ্বৈত্যতা অথবা প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে দ্বন্দ্ব অনেক সময় প্রশাসনিক কার্যক্রমে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিপত্তি ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলেই এরূপ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।

১৫. সরকারিকরণে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রয়োগের অভাব
আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের নীতিমালা মান সম্মত বলা যায় না। তদুপরি যে নীতিমালা প্রচলিত রয়েছে তাও যথাযথবাবে অনুসরণকরা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে পেশীশক্তি, আর্থিক প্রভাব অথবা অন্য কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

১৬. ম্যানেজিং কমিটিরি অন্তর্দ্বন্দ্ব
অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি দুটি বা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত থাকতে দেখা যায়। এর ফলে দ্বিমুখী বা ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে প্রশাসনের অনেক কার্যক্রমই গতিশীলতা পায় না। কখনও কখনও দ্বন্দ্ব মারাত্মক রূপ নিলে বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।

১৭. কমিটি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের দ্বন্দ্ব
কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক বনাম কমিটির দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। প্রতিষ্ঠানে একাডেমিক কাজে কমিটির অবৈধ হস্তক্ষেপের ফলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরূপ সমস্যা দেখা দেয়। কখনও কখনও প্রধান শিক্ষকের অযোগ্যতা বা অদক্ষতার কারণেও এরূপ ঘটে।

১৮. সন্ত্রাস
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস আজকাল আমাদের শিক্ষা প্রশাসনে একটি সাধারণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা তাদের মূল কাজ- লেখাপড়া ফেলে ছাত্র রাজনীতির ছত্র ছায়ায় নানা প্রকার সন্ত্রাসে লিপ্ত রয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে শিক্ষা প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রম মারাত্মকবাবে ব্যাহত হচ্ছে।

১৯. পরীক্ষার নকল প্রবণতা
পরীক্ষায় নকল প্রবনতা শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এটা মহামারীর রূপ ধারণ করেছিল। গত দু’বছর যাবৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তরিক ও কার্যকর উদ্যোগের ফলে এ প্রবণতা অনেক হ্রাস পেয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে পরীক্ষায় নকল প্রবণতা অনেক কমে যাবে।

২০. কর্মচারী/কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে জটিলতা
গতিশীল প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য হল নিয়মানুগতা ও ন্যায়পরায়ণতা রক্ষা করা এবং যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে বসান। কিন্তু এক্ষেত্রেও আমাদের শিক্ষা প্রশাসন ত্রুটিমুক্ত নয়। স্বজন প্রীতি ও দুর্নীতির কারণে পদোন্নতিতে পক্ষ পাতিত্বমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যায়।

২১. শিক্ষদের দলীয় রাজনীতি
অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকগণ দণ উপ-দলে বিভক্ত থাকেন। ফলে প্রত্যেকে তাদের দলীয় স্বার্থকে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ অপেক্ষা বড় করে দেখেন। এতে প্রশাসনিক কার্যক্রমে শিথিলতা আসে। একাডেমিক কাজ কর্মেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

২২. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি
শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি এখন একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েঁছে। যে প্রশাসন জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার কথা। সেখানেই যদি স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতিতে ভরে যায় তাহলে জাতি গঠনে শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে ভূমিকা রাখবে তাই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে আমাদের ক্রমাবনতিশীল শিক্ষা প্রশাসনিক ধারা।

২৩. সিদ্ধান্তহীনতা
যে কোন কাজেই সিদ্ধান্তহীনতা অথবা বিলম্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। এতে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। শিক্ষা প্রশাসনে নানা কারণে সিদ্ধান্তহীনতা পরিলক্ষিত হয়। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন একটি বড় কারণ।

২৪. ব্যয় বরাদ্দে অসামঞ্জস্য
ইদানিং জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ হলেও ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি, শহর গ্রাম ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিরাট বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। যা বন্ধ হওয়া উচিত।

২৫. শিক্ষকদের সামাজিকভাবে অবমূল্যায়ন
আমাদের সমাজে শিক্ষকদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। শিক্ষকতা পেশাকে একটি নিম্ন মানের পেশা হিসেবে দেখা হয়। ফলে শিক্ষকদের মাঝে একটি হীনমন্যতার ভাব কাজ করে যা তার প্রাত্যহিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে।

২৬. পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণ সেল না থাকা
আমাদের শিক্ষা প্রশাসনে পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা চালূ থাকলেও তা ততটা উন্নত নয়। যথাযথ পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করার মত কোন কার্যকর পদক্ষেপ এক্ষেত্রে নেই। তদুপরি পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণ ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে আলাদা কোন সেলও গঠন করা হয়নি।

২৭. সততা ও নিষ্ঠার অভাব
যে কোন কাজ সফল ও সার্থকভাবে করতে হলে সততা, নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের শিক্ষা প্রশাসনে সর্বস্তরে দায়িত্বশীল সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মীর বড়ই অভাব। এ অভাব পূরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে প্রশাসনিক গতিশীলতা আশা করা যায় না।

২৮. প্রশাসকদের রক্ষণশীল মনোভাব
অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসকদের রক্ষণশীল মনোভাব, প্রতিষ্ঠানের গতিশীলতাকে স্তিমিত করে দেয়। পুরাতন ধ্যান ধারণা ত্যাগ করে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত কোন পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ করতে না পারলে প্রশাসনে গতিশীলতা আশা করা যায় না।

২৯. সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাব
শিক্ষা প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কার্যক্রমে সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। ফলে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়।

৩০. বেসরকারি শিক্ষক/কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালায় ত্রুটি
বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের সন্তোষজনক নীতিমালা না থাকায় এ সব বিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এতে বিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কার্যে গতিশীলতা আসে না। ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও শিক্ষকদের উপদলীয় কোন্দল দ্বারাও নিয়োগ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।

৩১. শিক্ষাবোর্ড এবং বিশ্ব-বিদ্যালয়সমূহের স্বেচ্ছাচারীতা
শিক্ষা বোর্ডগুলোতে এক শ্রেণীর কর্মকর্তা/ কর্মচারীর দুর্নীতির কারণে স্বাভাবিক নিয়মে বোর্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পন্ন করা যায় না, ছাত্র ভর্তি, রেজিষ্ট্রেশন, ফরম পূরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বোর্ডের এক শ্রেণীর কর্মচারী নানাবিধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে স্বাভাবিক নিয়মকে অকার্যকর করে তোলে। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়েও এ ধরণের অবস্থা দৃশ্যমান হয়।

৩২. কর্মচারীদের পদ স্বল্পতা
বিদ্যালয় সুপরিচালনার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মচারী থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে রয়েছে খুবই কম সংখ্যক পদ। এর ফলে বিদ্যালয় কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না।

৩৩. বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে কর্মকমিশন না থাকা
বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করে নিরপেক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে হলে বর্তমান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনা অত্যাবশ্যক। এ জন্য বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ কর্মকমিশন গঠন করা আবশ্যক। অবশ্য সরকার ইদানিং বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে একটি জাতীয় শিক্ষক নির্বাচন কমিটি গঠন করেছে।

৩৪. শিক্ষা নীতি নির্ধারণে অশিক্ষাবিদদের প্রাধান্য দান
শিক্ষানীতি একটি দেশের প্রাণশক্তি। এজন্য দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে বাস্তব সম্মত ও কার্যকর শিক্ষানীতি প্রণয়ন জরুরী। কিন্তু শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটিতে অশিক্ষাবিদদের প্রাধন্য বেশী থাকলে কার্যকর ও সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তাই এ ধরনের কমিটিতে শিক্ষাবিদদের প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে।

৩৫. দক্ষ ও উপযুক্ত প্রশাসকের অভাব
সর্বোপরি সফলভাবে বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য প্রধান শিক্ষকের দক্ষতা 09ও যোগ্যতা থাকা অত্যাবশ্যক। আমাদের দেশের বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে উপযুক্ত ও দক্ষ প্রশাসক না থাকায় বিদালয়গুলোর সার্বিক মান উন্নত হচ্ছে না। নানাবিধ সমস্যা ও গোষ্ঠির প্রভাবে বিদ্যালয় কার্যক্রমে স্থবিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।



সমাধানের উপায়

বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশাসনের সমস্যাসমূহ চিহ্নিত না করলে সমস্যার প্রকৃত সমাধান হবে না। এ জন্য প্রয়োজন সমস্যাভিত্তিক যথার্থ সমাধানের পন্থা উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বর্তমান প্রশাসন ব্যবস্থায় গতিময়তা আনতে হলে একটি সমন্বিত আন্তরিক উদ্যোগ প্রয়োজন। নিচে সমস্যাসমূহের সম্ভাব্য সমাধানের কয়েকটি উপায় বর্ণিত হল।

১. জাতীয় শিক্ষানীতি নির্ধারণ
শিক্ষা প্রশাসনের চলমান সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের প্রয়োজন একটি সর্বসম্মত জাতীয় শিক্ষানীতি। সর্বস্তরের জ্ঞানী গুণী ও শিক্ষাবিদদের মধ্য থেকে যোগ্য, অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনপূর্বক জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন আজ সময়ের দাবী।

২. যথোপযুক্ত সুসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়ন
শিক্ষা প্রশাসনের সমস্যাসমূহ সমাধানের জন্য যথোপযুক্ত একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। বিদ্যালয় সমস্যার মূলোৎপাটনের জন্য পরিকল্পনায় কার্যকর দিক নির্দেশনা থাকতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে তা সমাধানে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

৩. ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ
বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থা চালু হলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ ও যোগ্য প্রশাসক তৈরির ভিত রচিত হয়। তাই আমাদের শিক্ষা প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীভূত শিক্ষা প্রশাসনে রূপান্তরিত করতে হবে।

৪. জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ
জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা প্রশাসনে গতিশীলতা ও আস্থা বৃদ্ধি করে। তাই শিক্ষা প্রশাসনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা থাকতে হবে, প্রতিটি কাজে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

৫. শিক্ষায় বৈষম্য দূরকরণ
আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রচন্ড রকমের বৈষম্য রয়েছে। বিশেষ শ্রেণীর জন্য শিক্ষা সুযোগের অবারিত দ্বার উন্মেচিত রয়েছে। অপরদিকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির জন্য সে সুযোগ সুবিধা না থাকায় সঠিকভাবে মেধা লালন করা যাচ্ছে না। তাই শিক্ষা বৈষম্য দূরীভূত করে সমতা আনতে হবে।

৬. বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য কর্ম কমিশন গঠন
দেশের শিক্ষা প্রশাসনের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে কোন কর্ম কমিশন না থাকা। এ জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা আনতে একটি বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ কর্ম কমিশন গঠন করা সময়ের দাবী।

৭. নকল প্রতিরোধে উদ্যোগ অব্যাহত রাখা
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নকল একটি ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছিল। বিগত দু’বছর যাবৎ সরকারি সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগের ফলে নকল প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এতে শিক্ষা ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে গৃহীত ব্যবস্থা ও উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে।

৮. সু পরিচালনা নিশ্চিত করা
সুপরিচালনার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায় পরায়ণতা, সুবিচার ইত্যাদি। অতএব, এ সবের আলোকে সুপরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে।

৯. পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার
ইদানিংকালে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে যথেষ্ঠ সংস্কার সাধন করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার গুণগত মানের উন্নতি হয়েছে। এ সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে মূল্যায়নকে আদর্শ মানে নিয়ে যেতে হবে।

১০. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন
শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখনও নিশ্চিত হয়নি। যদিও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক দিক পরিদৃষ্ট হচ্ছে, তবে এক্ষেত্রে আরোও অনেক উন্নয়ন প্রয়োজন।

১১. চাকরির নিরাপত্তা বিধান
অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য থেকে কেউ ভালভাবে কাজ করতে পারে না। তাই শিক্ষা প্রশাসকদের চাকরির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এক্ষেত্রে যোগ্যতর প্রশাসকদের দক্ষতাকে পুরোমাত্রায় ব্যবহার করার জন্য তাদের মাঝে প্রেরণা সৃষ্টি করতে হবে।

১২. লাল ফিতার দৌরাত্ম বন্ধ করা
আমাদের দেশে ব্রিটিশ আমল থেকে চালু হওয়া লাল ফিতার দৌরাত্ম থেকে আমরা এখনও নিষ্কৃতি পাইনি, বরং শিক্ষা ক্ষেত্রে পূর্বে এটা কম থাকলেও এখন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌছে গেছে। এজন্য সরকারি উদ্যোগ অপরিহার্য।

১৩. শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিকরণ
শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদের যেমন ভূমিকা দরকার তেমনি সচেতন মহল থেকেও ভূমিকা নিতে হবে। শিক্ষকদের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকেও শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে হবে।

১৪. পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণে গতিময়তা সৃষ্টিকরণ
আমাদের শিক্ষা পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণে এখনও গতিশীলতা এসেছে বলার উপায় নেই। যদিও কিছুটা পদ্ধতিগত উন্নয়ন ঘটেছে তথাপিও প্রক্রিয়া অনুসরণ ও বাস্তবায়নে কাঙ্ক্ষিত মান নিশ্চিত হয়নি।

১৫. স্থানীয় ও গোষ্ঠি প্রভাবমুক্ত করণ
শিক্ষা প্রশাসনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হল স্থানীয় ও গোষ্টিগত প্রভাব। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ বিশেষ করে স্থানীয় উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন।

১৬. সমন্বয়ে গতিশীলতা আনা
শিক্ষা প্রশাসনে সমন্বয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। গতানুগতিক পদ্বতিতে সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন সাধন করে গতিশীল ও আধুনিক সমন্বয় কৌশল প্রয়োগ করে গতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।

১৭. জাতীয়করণের নীতিমালা পুনর্গঠন
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের সুস্পষ্ট কোন নীতিমালা নেই। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট শর্ত আরোপ করে ব্যাপকভিত্তিক জাতীয়করণ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

১৮. নিয়োগে অনিয়ম ও অসমনীতি দূরীকরণ
প্রশাসনের সর্বস্তরে নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অসমনীতি পরিহার করে সুস্পষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকে ব্যক্তি স্বার্থের স্থান দিলেই এটা সম্ভব।

১৯. জনবল বৃদ্ধি করা
শিক্ষা প্রশাসনকে আধুনিক ও সময়োপযোগী করতে হলে জনবল কাঠামোগতেও পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে গতি প্রবাহ সঞ্চার করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল কাঠামো তৈরি করতে হবে।

২০. টীম স্পিরিট গড়ে তোলা
শিক্ষা প্রশাসনের সফলতার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল টীম স্পিরিট। সর্বস্তরের জনবলের মাঝে স্বত:স্ফূর্ত সহযোগিতা গড়ে তোলার মাধ্যমে দায়িত্ববোধ জাগ্রত করাই হচ্ছে টীম স্পিরিট। এটা ব্যতিত প্রশাসনে সফলতা আসবে না।

২১. ভর্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম দূরকরণ
দেশের ভাল বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির প্রতিযোগিতা এখন ভর্তি যদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এক শ্রেণীর বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে তাই যথেষ্ঠ অনিয়ম দেখা যায়। এগুলো দূর করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।

২২. পরিকল্পনা প্রণয়নে শিক্ষাবিদদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো
সঠিক, যথার্থ, কার্যকর ও মানসম্পন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা পরিকল্পনায় জ্ঞান তাপস শিক্ষাবিদদের সম্পৃক্ততার হার বাড়াতে হবে।

২৩. শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সমিতি গঠন
শিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাণবন্ত ও স্বত:স্ফূর্ত করার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সমিতি গঠন করতে হবে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের সমস্যা ও চাহিদাসমূহ সনাক্ত করা এবং সেগুলোর
সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখা সহজ হয়।

২৪. অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রশাসক নিয়োগদান
শিক্ষা প্রশাসনের সফলতা ও ব্যর্থতা মূলত: নির্ভর করে প্রশাসকের দক্ষতার উপর। দক্ষতা অর্জিত হয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। তাই অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রশাসক নিয়োগ দান অপরিহার্য।

২৫. স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি বন্ধকরণ
আমাদের সমাজের রন্ধ্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ঢুকে পড়েছে। শিক্ষা প্রশাসনও তা থেকে মুক্ত নয়। প্রশাসনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে সার্বিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিমু্ক্ত প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে।

২৬. প্রশিক্ষণ জোরদারকরণ
যোগ্যতা ও দক্ষতা না থাকলে কোন কাজই সফলভাবে করা সম্ভব হয় না। শিক্ষা প্রশাসকদের মানোন্নয়নের লক্ষে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাও কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে। এ জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার।

২৭. বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাচারিতা দূরীকরণ
যে সকল বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যন্ত্রে স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি রয়েছে তা দূরীভূত করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যাতে প্রশাসনে নিয়মানুগ পদ্ধতি চালু থাকে।

২৮. সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন সৃষ্টি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য সর্বস্তরের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তাছড়া শিক্ষা প্রশাসনকে কার্যকর ও কর্মক্ষম করা সম্ভব হবে না।

২৯. পদোন্নতিতে নিরপেক্ষতা অবলম্বন
শিক্ষা প্রশাসন নিরপেক্ষ না থাকলে প্রত্যাশিত উন্নয়ন সাধিত হয় না। এজন্য সকল স্তরের শিক্ষক কর্মচারীর পদোন্নতিতে অবশ্যই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে।

৩০. দ্বন্দ্ব নিরসন
অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। এ দ্বন্দ্ব মূলত: দলীয় প্রাধান্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য অবশ্যই আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকতে হবে।

৩১. স্কুল ম্যাপিং অনুসরণ
শিক্ষা প্রশাসনের উন্নয়ন কোন কোন ক্ষেত্রে স্কুল ম্যাপিং এর উপর নির্ভর করে। একই এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল স্কুল থাকলে তা প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজ কর্মের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া যায় না। এভাবে প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়ে। এজন্য স্কুল ম্যাপিং অনুসরণ জরুরি।

৩২. শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের মানোন্নয়ন
শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের মানোন্নয়নে প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তাই কারো কারো মতে, গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত উন্নয়নে কম বরাদ্দ রাখায় বাজেটে নতুন কোন বৈচিত্র্য আসেনি। দিন বদলের অঙ্গীকার ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল আরো বেশী। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরো বাড়ানো উচিত ছিল। বাজেটে শিক্ষার উন্নয়ন খাতে চেয়ে অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে বেশী। অধিকাংশ অর্থই ব্যয়িত হবে বেতন-ভাতা ও পেনশন প্রদানে। কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নে গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে কম বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ও পরিকল্পনায় পর্যায়ক্রমে স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা এবং তথ্য ও প্রযুক্তি সেক্টর গুরুত্ব পেয়েছে।

৩৩. শিক্ষার বানিজ্যিকীকরণ প্রবণতা বন্ধ করা
একটি জাতিকে উন্নয়নের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হলে শিক্ষা খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হয়। তা না হলে দেশের মেধাবী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে জাতীয় উন্নয়নে শরিক করা যাবে না। তাই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রয়োজন ছিল শিক্ষা খাতে কমপক্ষে মোট জাতীয় বাজেটের ২৫ শতাংশ এবং জাতীয় আয়ের ৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখার। দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে ও জনশক্তিকে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে শিক্ষার বানিজ্যিকীকরণ প্রবণতা বন্ধ করা এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা খাতে এ বরাদ্দ জরুরী।

৩৪. প্রশাসনকে ই-গভার্মেন্টে রূপান্তরিত করা
আমাদের দেশের অন্যান্য সেকটরের মতো শিক্ষা ক্ষেত্রেও দুর্নীতি মহীরুহে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে শিক্ষা বাজেটের একটা বিরাট অংশ দুর্নীতিবাজদের পকেটে চালান হয়ে যাচ্ছে। তাই সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য সর্বপ্রথমে শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে দেশের সব সরকারী কলেজগুলোকে ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। তাছাড়া সব সরকারী শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট, আলিয়া মাদ্রাসা, শিক্ষা বোর্ড, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকেও এ সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তথ্য আদান-প্রদান করা হবে ই-মেইল ও ওয়েব সাইটের মাধ্যমে। আর ইন্টারনেটের মাসিক বিল প্রদান করতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারী তহবিল থেকে।

উপসংহার
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশাসনের সমস্যা এত বেশী ও জটিল যে তা সমাধান একদিনে ও দ্রুততার সাথে সম্ভব নয়। শিক্ষা সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্যঅন্য প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষাঙ্গনের সন্ত্রাস, নকল প্রবণতা, দুর্নীতি, দারিদ্র, অদক্ষতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় একা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। সমাজের অণ্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই মাত্র শিক্ষা ক্ষেত্রে ও প্রশাসনে বিরাজমান সমস্যা সমাধান সম্ভব।



তথ্যসূত্রঃ
 প্রফেসর এ.কে.এম. মোজাম্মেল হক – মাধ্যমিক শিক্ষা
 মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান – শিক্ষা প্রশাসন
 অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম – মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা
 আবু হেনা মোস্তফা জালাল – মাধ্যমিক শিক্ষা, শিক্ষাক্রম ও শিশুর ক্রমবিকাশ
 মুহম্মদ মাছুম বিল্লাহ- মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি বলার চর্চা
 গৌতম রায় - বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের শিক্ষা: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়
 ডঃ শেখ আমজাদ হোসেন - আবশ্যকীয় শিক্ষণ দক্ষতা
 মোঃ সিরাজুল ইসলাম - আবশ্যকীয় শিক্ষণ দক্ষতা
 ডঃ এ.এইচ.এম. ফারুক - শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা
 হোসনে আরা বেগম - শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×