“ওকে আবারও দেখা যাচ্ছে,” জানালার পর্দা আলতোভাবে সরিয়ে লিলিয়ান রাইট বলল, “ঐযে ওখানে ও, জর্জ।”
“ঐখানে কে আছে বলছ?” টেলিভিশনে বেসবল খেলা দেখার জন্য সন্তোষজনক একটা চ্যানেল খুঁজতে খুঁজতে জানতে চাইল লিলিয়ানের স্বামী।
“মিসেস স্যাকারো,” লিলিয়ান বলল, “কে মিসেস স্যাকারো?” ওর স্বামী অনিবার্যভাবেই এ প্রশ্নটা করবে এমন আভাস পেয়েই দ্রুত আরো যোগ করল, “ভালো কথা, আমাদের নতুন প্রতিবেশী।”
“ওহ।”
“সূর্যস্নান করছে। সব সময় সূর্যস্নান করে। আমি অবাক হচ্ছি, কোথায় ওর ছেলেটা। ও সাধারণত এমন চমৎকার একটা দিনে বাইরে বের হয়, ওদের ঐ অদ্ভুত সুন্দর উঠোনে দাঁড়িয়ে ঘরের দেয়ালে বল ছুঁড়ে মারে। তুমি ওকে কখনো দেখেছিলে, জর্জ?”
“আমি ওর কথা শুনেছি। চাইনিজ জল যন্ত্রণার একটা সংস্করণ এটা। দেয়ালে প্রচণ্ড শব্দে আঘাত করা, মাটিতে দাপাদাপি করা, হাততালি দেওয়া। প্রচণ্ড আঘাত, দাপাদাপি, হাততালি, প্রচণ্ড আঘাত, দাপাদাপি...”
“ও ভালো ছেলে, শান্ত, সুন্দর ব্যবহার। আমার ইচ্ছে, টমি ওর সাথে বন্ধুত্ব করুক। ও টমির সমবয়সী হবে, বয়স দশের কাছাকাছি।”
“আমি জানতাম না, টমি ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে চায় না।”
“অবশ্য, স্যাকারোদের সাথে বন্ধুত্ব করতে যাওয়াটা কঠিন। ওরা নিজেদেরকে নিয়েই আছে। এমনকি আমিও জানিনা স্যাকারো সাহেব কি করে।”
“তুমি কেন জানবে? সে কি করে, এটা জানা সত্যিই কারো কাজ নয়।”
“আমার কাছে অদ্ভুত লাগে, কখনো তাঁকে কাজে যেতে দেখিনি।”
“আমাকেও কেউ কখনো কাজে যেতে দেখেনি।”
“তুমি বাড়িতে বসে লেখালেখি কর। সে কি করে?”
“আমি নিশ্চিত, মিসেস স্যাকারো জানে উনার স্বামী কি করে, আর সেও তোমার মত অস্থির হয়ে আছে কারন সে জানে না আমি কি করি।”
“ওহ, জর্জ,” লিলিয়ান জানালা থেকে চোখ সরিয়ে বিরক্তি নিয়ে টেলিভিশনের দিকে তাঁকাল, “আমার মনে হয়, প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক গড়তে আমাদের একটা উদ্যোগ নেওয়া উচিত।”
“কি ধরণের উদ্যোগ?” জর্জ সোফায় আরাম করে বসে, মাত্রই খোলা হয়েছে জমাট হিম কণায় আদ্র এমন একটা রাজকীয় আকারের সোডা হাতে নিল।
“ওদের সাথে পরিচিত হওয়া।”
“বেশ, তুমি চাওনি, যখন মিসেস স্যাকারো বের হয়েছিল? তুমি বললে তুমি ডেকেছিলে।”
“আমি হ্যালো বলেছিলাম, ঠিক আছে, ও একটু বেরিয়ে আসল, সাংসারিক কাজে ওকে তখনো বিচলিত দেখাচ্ছিল, তাই শুধু মাত্র হ্যালো, এই পর্যন্তই। দুই মাস হতে চলল, মাঝে মধ্যে হ্যালো বলা ছাড়া এখন পর্যন্ত আর বেশি কিছু হয় নি।... ও খুব অদ্ভুত মেয়ে।”
“অদ্ভুত মেয়ে?”
“ও সব সময় আকাশের দিকে তাঁকিয়ে থাকে। শত শত বার ওকে আমি এমন করতে দেখেছি। সামান্য মেঘ করলেও ও কখনো বাইরে বের হয়না। একদিন, ওর ছেলেটা বাইরে খেলছিল, ওকে ভিতরে আসার জন্য ডাকাডাকি করল, চেঁচিয়ে বলল বৃষ্টি শুরু হতে যাচ্ছে। আমি ওকে বলতে শুনলাম। ভাবলাম, বৃষ্টিতে হয়ত আমিও ভিজে যাবো, তাই দ্রুত সরে এলাম। অবশ্য, বেশ সূর্যের আলো ছিল। ওহ, সামান্য কিছু মেঘ ছিল, এর বেশি কিছু নয়, সত্যি বলছি।”
“শেষ পর্যন্ত, বৃষ্টি হয়েছিল?”
“মোটেই না। উঠোন থেকে আমি শুধু শুধু দৌড়ে এলাম।”
জর্জ কয়েকটা বেস হিটের মাঝে হারিয়ে গেল। বল প্রায় হতবুদ্ধি করে বেরিয়ে গেল, এর মানে এক রান। যখন উত্তেজনা শেষ হয়ে এল এবং বল নিক্ষেপকারী তাঁর হাতে বলটি আবার ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিল, লিলিয়ান ততক্ষণে রান্নাঘরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। জর্জ ওর উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “বেশ, যেহুতু তাঁরা অ্যারিজোনা থেকে এসেছে, আমি নিশ্চিত, মেঘ-বৃষ্টি এই সব জিনিসের সাথে তাঁরা পরিচিত নন।”
লিলিয়ান দ্রুতপায়ে শোবার ঘরে ফিরে এল, “কোথা থেকে এসেছে?”
“টমির কথা অনুযায়ী অ্যারিজোনা থেকে।”
“টমি কিভাবে জানল?”
“আমার ধারণা, বল খেলার সময় টমি ছেলেটার সাথে কথা বলেছে। ও টমিকে বলেছে ওরা অ্যারিজোনা থেকে এসেছে। এরপর ওকে ভিতরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। টমি বলেছে এটা অ্যারিজোনা অথবা অ্যালাবামার মত কোন একটা জায়গা হবে। তুমিতো টমিকে জানো, পুরোপুরি কিছু মনে করতে পারে না ও। কিন্তু যদি তাঁরা আবহাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে, তবে আমার মনে হয়, অ্যারিজোনাই হবে। আমাদের এত সুন্দর বৃষ্টিভাবাপন্ন জলবায়ুকে কি করে বুঝতে হবে, তাঁরা তা জানে না।”
“কিন্তু তুমি আমাকে আগে কখনো বলনি কেন?”
“কারন টমি আমাকে আজ সকালে বলেছে মাত্র, আমি ভেবেছিলাম তোমাকে ও ইতোমধ্যে অবশ্যই বলে থাকবে। আর সত্যি বলতে কি, আমি ভেবেছিলাম তুমি তাঁদের একটা স্বাভাবিক অস্তিত্ব বের করে আনতে পেরেছ, যদিও তুমি কখনই কিছু খুঁজে পাওনি। ওয়াও...”
বল উড়ে গিয়ে রাইটফিল্ড স্ট্যান্ডে পরল, এবং সেখান থেকে বল কুড়িয়ে এনে নিক্ষেপকারীর কাছে পাঠান হল।
লিলিয়ান জানালার পর্দার কাছে ফিরে গিয়ে বলল, “আমি শুধু ওর সাথে পরিচিত হতে চাই। ও দেখতে কত চমৎকার। ...ওহ, জর্জ এদিকে দেখ।”
জর্জ টিভি বাদ দিয়ে আর কোথাও তাঁকাল না।
লিলিয়ান বলল, “আমি জানি, ও ঐ মেঘের দিকে একদৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। আর এখন ও ভিতরে চলে যাবে। বিশ্বাস কর।”
****
লাইব্রেরিতে রেফারেন্স খুঁজতে গিয়ে জর্জ দুই দিন বাইরে ছিল, ফিরল এক গাদা বই সাথে নিয়ে। লিলিয়ান উৎফুল্লভাবে তাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, “এখুনি, আগামীকাল তুমি আর কোন কাজ করছ না।”
“তোমার কথাটা বিবৃতির মত শোনাচ্ছে, প্রশ্ন নয়।”
“বিবৃতিই বলতে পাড়। আমরা স্যাকারোদের সাথে মর্ফি’স পার্কে যাচ্ছি।”
“সাথে...”
“পাশের বাড়ির পতিবেশীর সাথে, জর্জ। তুমি নামটি কখনই মনে রাখতে পারনা কেমন করে?”
“বেশ উপহার দিলে। কিভাবে এটা সম্ভব হল?”
“আজ ঠিক সকালে ওদের বাড়িতে গেলাম, আর বেল বাজালাম।”
“এত সহজ?”
“এতটা সহজ ছিল না। খুব কঠিন। আমি সেখানে দাঁড়ালাম, অস্বস্তি নিয়ে ডোরবেলে টিপ দিলাম। তখন পর্যন্ত আমি ভেবেছিলাম দরজা খোলার চেয়ে বেল বেজে উঠা সহজতর হবে, আর সেখানে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ধরা পড়ব।”
“আর তোমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়নি সে?”
“না। যতটা সম্ভব, ওর ব্যবহার ছিল মধুর। আমাকে ভিতরে আসতে বলল, ও জানত আমি কে, বলল বেড়াতে এসেছি বলে ও খুব আনন্দিত।”
“আর তুমি প্রস্তাব করলে, আমরা মর্ফি’স পার্কে যাব।”
“হ্যা। আমি ভেবেছিলাম, যদি এমন কিছু প্রস্তাব করি যা শিশুদেরকে আনন্দ করার উপলক্ষ্য এনে দিবে, এটা ওর জন্য সহজ হবে সাথে যাবার। ছেলের জন্য এ অপ্রত্যাশিত সুযোগটা নষ্ট করতে চায়নি ও।”
“এক জন মায়ের মনস্তত্ত্ব।”
“কিন্তু ওদের বাড়িটা তোমার দেখতে যাওয়া উচিত।”
“আহ। এই সব বিষয়ে তোমার একটা আগ্রহ ছিল, তুমি সব জানতে পেরেছ। তুমি কুক’স ট্যুরে যেতে চেয়েছিলে। কিন্তু, দয়াকরে তাঁদের বাড়ির রঙবিন্যাসের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া থেকে আমাকে অব্যাহতি দিও। বিছানার চাদর সম্পর্কে জানতে আমি আগ্রহী নই, আর খাসকামরার আকারের মত বিষয়, আমি বরাবরই এড়িয়ে চলি।”
লিলিয়ান জর্জের কোন কথাই কানে দিত না, এটাই ছিল ওদের সুখী দাম্পত্যের গোপন রহস্য। ও স্যাকারোদের বাড়ির রঙবিন্যাসের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে চলল, সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলল বিছানার চাদর সম্পর্কে, আর খাসকামরার ইঞ্চি বাই ইঞ্চি বর্ণনা দিল জর্জকে।
“আর পরিষ্কার? আমি কখনো কোন জায়গা এত নিখুঁত দেখিনি।”
“যদি তুমি কারো সাথে পরিচিত হতে চাও, তখন সে তোমাকে অসম্ভব একটা মানদণ্ডে বসাবে, আর তোমার নিজস্ব সমর্থনের জন্যই তাঁকে ছাড় দিতে হবে।”
“ওর রান্নাঘর,” জর্জকে গ্রাহ্য না করেই লিলিয়ান বলল, “এত পরিষ্কার, তুমি দেখে বিশ্বাসই করতে পারবে না, ও এটা কখনো ব্যবহার করেছে। পানি খেতে চাইলে, ট্যাপের নিচে গ্লাস রেখে ও আস্তে আস্তে পানি ঢালল, যেন এক ফোঁটা পানিও বাইরে না পড়ে। কোন ভান ছিল না। ও এটা সচ্ছন্দে করল, আমি বুঝতে পারলাম ও সব সময় এভাবেই কাজটা করে। আর যখন আমাকে গ্লাসটা দিল, ও ওটা একটা পরিষ্কার রুমাল দিয়ে ধরে রেখেছিল। ঠিক হাসপাতালের মত স্বাস্থ্যকর পরিবেশ।”
“সে এর জন্য নিজেই অনেক বিপদে পড়বে। সে কি সাথে সাথেই আমাদের সাথে আসতে রাজী হয়েছিল?”
“না... সাথে সাথেই না। ও আবহাওয়ার পূর্বাভাষ সম্পর্কে জানার জন্য ওর স্বামীকে ডাকল। স্যাকারো সাহেব বলল, সব পত্রিকাই বলেছে আগামীকালের আবহাওয়া সুন্দর থাকবে। তবুও রেডিওর সর্বশেষ রিপোর্টের জন্য সে অপেক্ষা করছিল। ”
“সব পত্রিকা তাই বলেছে, এহ?”
“অবশ্যই, তারা সবাই শুধু সরকারি আবহাওয়ার পূর্বাভাষ মুদ্রণ করে, তাই তাদের সবার রিপোর্ট এক হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, ওরা সবগুলো পত্রিকাই রাখে। কাগজের ছেলেটাকে কমপক্ষে এক বান্ডিল পত্রিকা রেখে যেতে দেখেছি আমি...”
“বেশি কিছু আর বাকি নেই যা তোমার চোখে এড়িয়ে গেছে, আছে কিছু?”
“যাই হোক,” লিলিয়ান অস্থিরভাবে বলল, “ও আবহাওয়া অফিসে ফোন করেছিল, তারা ওকে সর্বশেষ আবহাওয়ার পূর্বাভাষ জানাল। ও ওর স্বামীকে ডেকে সব বলল। এরপর ওরা বলল, ওরা যাবে। এছাড়াও বলল, যদি আবহাওয়ার আকস্মিক কোন পরিবর্তন ঘটে, ওরা আমাদেরকে ফোন করে জানাবে।”
“ঠিক আছে। তাহলে আমরা যাবো।”
****
স্যাকারোরা দেখতে কমবয়সী ও হাসিখুশী, শ্যামলা ও সুশ্রী। ঠিক যেখানে রাইটদের গাড়িটি পার্ক করা ছিল, বাড়ি থেকে নেমে ওরা সেদিকে লম্বা পদক্ষেপে এগোল। জর্জ ওর স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে, কানে কানে বলল, “তাহলে স্যাকারো সাহেবই কারন।”
“আমিও তাই আশা করছি,” লিলিয়ান বলল, “সে যেটা বইছে, ওটা কি একটা হাতব্যাগ?”
“পকেট রেডিও। আবহাওয়ার পূর্বাভাষ শোনার জন্য, আমি নিশ্চিত।”
স্যাকারোদের ছেলেটা ওদের পিছনে দৌড়ে আসছিল কিছু একটা নাড়াতে নাড়াতে, যেটা বায়ুচাপ মাপার যন্ত্রে রূপান্তরিত হল, ওরা তিন জনই গাড়ির পিছনের সিটে গিয়ে বসল। আলাপচারিতা শুরু হল, নৈর্ব্যক্তিক কিছু বিষয়ে নিখাদ প্রশ্নোত্তর আদান-প্রদান, মর্ফি’স পার্ক পর্যন্ত এভাবেই চলতে লাগল।
স্যাকারোদের ছেলেটি এত ভদ্র ও যুক্তিবাদী যে, টমি রাইট পর্যন্ত সামনের সিটে ওর বাবা-মায়ের মাঝখানে বসে সভ্যতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। লিলিয়ান মনে করতে পারছিল না, এত প্রশান্ত-সুখকর মোটরগাড়ি ভ্রমণ কবে সে কাটিয়েছিল।
স্যাকারো সাহেবের ছোট রেডিওটা চালু ছিল, লিলিয়ান এর জন্য আদৌ বিরক্তবোধ করে নি, আলাপচারিতার মাঝে রেডিওর শব্দ সামান্যই শোনা যাচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষে, লিলিয়ান কখনই দেখে নি স্যাকারো সাহেব কদাচিৎ রেডিওটি তাঁর কানের কাছে ধরে রাখছে।
মর্ফি’স পার্কে চমৎকার একটা দিন; উষ্ণ ও শুকনো, অত্যধিক গরম পড়ে নি; নীলে, নীল আকাশে প্রফুল্ল উজ্জ্বল সূর্য। এমনকি স্যাকারো সাহেব, যদিও সে আকাশের প্রত্যেকটা অংশ সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে পরীক্ষা করল, গভীর দৃষ্টি নিয়ে একটানা বায়ুচাপ মাপার যন্ত্রের দিকে তাঁকিয়ে রইল, সেও মনে করল খুঁজে বের করার মত কোন ত্রুটি নেই।
লিলিয়ান আমিউজমেন্ট সেকশনে ছেলে দুটিকে নিয়ে গেল, পর্যাপ্ত সংখ্যক টিকিট কিনল যেন পার্কের প্রত্যেক ধরণের রোমাঞ্চকর রাইডে ওরা চড়তে পারে।
“অনুগ্রহ করে,” মিসেস স্যাকারোকে বাঁধা দিয়ে লিলিয়ানকে বলতে হয়েছে, “আমাকেই করতে দিন। পরবর্তীতে আপনাকে সুযোগ দেব।”
লিলিয়ান যখন ফিরে এল, জর্জ একা। “কোথায়...”, লিলিয়ান শুরু করল।
“খাদ্য ও পানীয় স্ট্যান্ডটার ঐ ওখানে। আমি তাঁদেরকে বলেছি, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। তুমি এলেই তাঁদের সাথে যোগ দেব।”, বিষণ্ণতা নিয়ে কথাগুলো বলল জর্জ।
“কোন সমস্যা হয়েছে?”
“না, সত্যিই না, শুধু মনে হচ্ছে, স্যাকারো সাহেব সম্ভবত সহজাতভাবেই সম্পদশালী।”
“কি বললে?”
“আমি জানি না, সে জীবনধারণের জন্য কি করে। আমি ইঙ্গিত করে বললাম ...”
“এখন কে কৌতূহলী?”
“আমি তোমার জন্যই জানতে চাইছিলাম। সে বলল, সে মানব প্রকৃতির একজন ছাত্র মাত্র।”
“কতটা দার্শনিক। ঐসব পত্রিকাগুলোই এটা প্রমাণ দেয়।”
“হ্যা, কিন্তু একজন সুদর্শন, সম্পদশালী নিকট প্রতিবেশী নিয়ে, এখন দেখা যাচ্ছে আমি নিজেকেও একটা অসম্ভব মানদণ্ডে বসিয়ে ফেলেছি।”
“বোকার মত কথা বল না।”
“আর সে অ্যারিজোনা থেকে আসে নাই।”
“সে আসে নাই?”
“আমি বললাম, আমি শুনেছি সে অ্যারিজোনা থেকে এসেছে। তাঁকে খুব বিস্মিত দেখাচ্ছিল, এটা নিশ্চিত সে অ্যারিজোনার নয়। এরপর সে হেসে জানতে চাইল, তাঁর কথার টান অ্যারিজোনার মত কিনা।”
লিলিয়ান চিন্তিতভাবে বলল, “তুমি জানো, তাঁর কথায় কিছু একটা টান আছে। দক্ষিণ পশ্চিমে স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত অনেক লোক বাস করে, তাই সে অ্যারিজোনারই হবে। স্যাকারো একটা স্প্যানিশ নাম হতে পারে।”
“জাপানী বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। ... বাদ দাও, তাঁদেরকে দেখা যাচ্ছে। ওহ, দেখ তাঁরা কি কিনেছে।”
স্যাকারোরা প্রত্যেকেই হাওয়াই মিঠাইয়ের তিনটি কাঠি ধরে আছে, চিনির তন্তুতে তৈরী গোলাপী ফোমের প্রকাণ্ড চক্র যা ফেনিল সিরাপ শুকিয়ে উষ্ণপাত্র থেকে পেঁচিয়ে উঠিয়ে আনা হয়েছে। এটা মধুরভাবে মুখের ভিতরে গলে যায়, আর একটা আঠালো অনুভূতি রয়ে যায়।
স্যাকারোরা প্রত্যেকেই একটি করে প্রত্যেক রাইটের সামনে ধরল, ওরা বিনম্রভাবে ওগুলো গ্রহণ করল।
ওরা মধ্য পথের দিকে এগোল। বাণ নিক্ষেপের চেষ্টা করল হাত দিয়ে, ওটা এক ধরণের পোকার খেলা। ওরা নিজেদের ছবি তুলল, কণ্ঠ রেকর্ড করে রাখল, আর পাঞ্জা লড়ে শক্তি পরীক্ষা করল।
অবশেষে ওরা ছেলে দুটিকে আয়ত্তে আনল, এদিক ওদিক রুদ্ধশ্বাসে ছুটাছুটি করে কাহিল হয়ে পড়েছিল ওরা। স্যাকারোরা ওদেরকে সাথে সাথেই খাদ্য ও পানীয় স্ট্যান্ডের কাছে নিয়ে এল। টমি ইঙ্গিত করে আগ্রহ প্রকাশ করল ওর জন্য সম্ভাব্য একটা হট-ডগ কেনার ব্যাপারে। জর্জ কাছে ডাকতেই, ও দৌড়ে এল।
“সত্যি বলতে,” জর্জ বলল, “আমি এখানে থাকতেই পছন্দ করছি। যদি ওদেরকে আরেকটা হাইয়াই মিঠাইয়ের কাঠিতে কামড় দিতে দেখি, আমি সবুজ হয়ে এখানেই অসুস্থ হয়ে পড়ব। যদি তাঁরা প্রত্যেকেই এক ডজন করে খেয়ে না থাকে, আমি নিজেই এক ডজন খাবো।”
“আমি জানি, ওরা এখন মুঠো ভরে কিনছে ওদের ছেলেটার জন্য।”
“আমি স্যাকারোকে একটা হ্যামবার্গার খেতে সেধেছিলাম, সে বিকটভাবে তাঁকিয়ে মাথা নাড়ল। একটা হ্যামবার্গারও খেল না, অথচ পর্যাপ্ত পরিমাণ হাওয়াই মিঠাই খেয়ে তাঁদের ভোজন শেষ হবে।”
“আমি জানি। আমি ওকে এক গ্লাস কমলালেবুর শরবত সেধেছিলাম, ও না বলার সময় এমনভাবে লাফ দিয়ে উঠল, তোমার মনে হবে আমি যেন ওটা ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে মারছিলাম। আমার ধারণা, ওরা এধরণের জায়গায় আগে কখনো আসেনি। নূতনত্বের সাথে মানিয়ে নিতে ওদের সময় লাগবে। ওরা মন ভরে হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছে, এরপর আগামী দশ বছরের মধ্যে আর কখনই ওটা খাবে না।”
“বেশ, হয়তবা।” ওরা ধীরে ধীরে হেঁটে স্যাকারোদের দিকে এগোচ্ছিল। “দেখো, লিল, আকাশে মেঘ জমছে।”
স্যাকারো সাহেব রেডিওটা তার কানের কাছে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে পশ্চিমের দিকে তাঁকাচ্ছিল।
“উহ-ওহ,” জর্জ বলল, “সে এটা দেখেছে। বাজি ধরলে একের জন্য তুমি পঞ্চাশ করে পাবে, সে এখন বাড়ি যেতে চাইবে।”
স্যাকারোরা তিনজনই এখন জর্জের সামনে দাঁড়িয়ে, শিষ্ট কিন্তু দ্ব্যর্থহীন। ওরা দুঃখিত, ওরা একটা চমৎকার সময়, একটা অবিশ্বাস্য সময় কাটাল, রাইটারা ওদের অতিথি হবে, যত দ্রুত সম্ভব এর ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এখন, সত্যিই, ওদের বাড়ি ফিরতে হবে। ঝড় আসবে মনে হচ্ছে।
মিসেস স্যাকারো বিলাপ করে বলল, সকল পূর্বাভাষ বলেছিল বৃষ্টিপাত হবে না, আবহাওয়া সুন্দর থাকবে।
জর্জ ওদেরকে শান্তনা দেবার চেষ্টা করল, “স্থানীয় বজ্রসহ ঝড়-বৃষ্টি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করা কঠিন, কিন্তু এমনকি এটা যদি চলেও আসে, আধ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হবে না।”
এই কথায়, স্যাকারোদের ছেলেটা প্রায় কেঁদে ফেলছিল, আর মিসেস স্যাকারোর হাতে ধরা রুমালটি দৃশ্যমানভাবে কেঁপে উঠল।
“চলুন বাড়ির দিকে যাই,” বশ্যতা স্বীকার করে বলল জর্জ।
****
ফিরে যাওয়ার সময় যাত্রাটা মনে হচ্ছিল অনেক লম্বা, অনন্ত ও একঘেয়ে। কোন আলাপচারিতা নেই। স্যাকারো সাহেবের রেডিওটা বেশ উচ্চস্বরে বাজছে, এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে যেয়ে প্রতি মূহুর্তের আবহাওয়ার রিপোর্ট ধরার চেষ্টা করছে সে। ওরা রিপোর্টে মন্তব্য করছে, এখন “বজ্রসহ বৃষ্টিপাত” হবে।
স্যাকারোদের ছেলেটা বলে উঠল, বায়ুচাপ মাপার যন্ত্রের কাঁটাটা পড়ছে, আর মিসেস স্যাকারো চিবুকের নিচে হাতের তালু রেখে বিষণ্ণ হয়ে একটানা আকাশের দিকে চেয়ে থেকে জর্জকে অনুরোধ করল, সম্ভব হলে যেন গাড়িটা আরো দ্রুত চালানো হয়।
“বেশ আশঙ্কাজনক দেখাচ্ছে, তাই না?” লিলিয়ান বিনীতভাবে বললেন ওদের অতিথির অঙ্গভঙ্গির সাথে মানিয়ে নিতে। কিন্তু জর্জ মিসেস স্যাকারোর শ্বাস-প্রশ্বাসের নিচে চাপা পড়া কথাটা শুনলেন, “দয়া করে!”
বাতাস বইতে শুরু করল, সপ্তাহের পর সপ্তাহ শুকনো রাস্তার ধুলো উড়তে লাগল। যখন ওরা রাজপথে উঠে এল, যেখানে ওরা থাকে, সেখানে পাতাগুলো অশুভভাবে মর্মর করে উঠল। বিদ্যুৎ চমকে উঠল।
জর্জ বলল, “বন্ধু, আপনারা আর দুই মিনিটের মধ্যেই বাড়ির ভিতরে পৌছে যাবেন, আমরা এটা পারব।”
জর্জ দরজার কাছে এসে থামাল, যা স্যাকারোদের প্রশস্ত সম্মুখ উঠোন মেলে ধরল, গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজা খুলে দিল। ও ভেবেছিল, ও নামিয়ে দিতে পেরেছে। ওরা ঠিক সময়েই এসেছে।
স্যাকারোরা গড়িয়ে নামল, মুখে দুশ্চিন্তার রেখা টেনে বিড়বিড় করে ধন্যবাদ জানাল। এরপর ওদের দীর্ঘ সম্মুখ উঠোনের দিকে ভয়ানক গতিতে হেঁটে গেল।
“সত্যি বলতে,” লিলিয়ান শুরু করল, “তুমি চিন্তা করেছিলে ওরা পৌছুতে...”
আকাশ খুলে গেল, আর বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নেমে এল যেন স্বর্গের বাঁধ হটাৎকরেই ফেটে পড়েছে।
ওদের গাড়ির উপরিভাগে সজোরে শত শত ড্রামের কাঠির আঘাত পড়ছিল, আর সম্মুখ দরজার মাঝপথে স্যাকারোরা থেমে গেল, নৈরাশ্য নিয়ে উপরের দিকে তাঁকাল।
বৃষ্টির আঘাতে ওদের মুখগুলো ঝাপসা হয়ে এল; ঝাপসা ও কোঁচকানো। একসাথে ওরা দৌড় দিল। তিনজনই কোঁচকিয়ে গেল, কাপড়-চোপড়ের মধ্যে ভেঙে পড়ল, যা ডুবে গেল তিনটি আঠালো-আদ্র স্তুপের মাঝে।
যখন রাইটারা ওখানে পৌছল, বিষম ভয়ে এফোঁড় ওফোঁড় বিদ্ধ হয়ে, লিলিয়ান নিজেকে থামাতে অসমর্থ হল ওর এই মন্তব্যটি শেষ করতে, “... চিনির তৈরী, ভয় হচ্ছে ওরা গলে যাবে।”
পাদটীকা
আইজ্যাক আসিমভের (১৯২০-৯২) এই ছোট গল্পটি তাঁর “Jupiter and Other Stories (1975)” সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে। গল্পটি অন্তর্জাল থেকে ডাউনলোড করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন। এই গল্পে ব্যবহৃত স্যাকারো (Sakkaro) শব্দটি saccharose (sacchar-ose) থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ চিনি (Sugar)। এটি প্রাণরসায়নে বহুল ব্যবহৃত একটি আবিধানিক শব্দ। আসিমভ নিজেও আমেরিকার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। রবার্ট এ. হাইনলাইন , আর্থার সি. ক্লাকের ও আইজ্যাক আসিমভকে একসাথে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের ‘বিগ থ্রি’ ("Big Three") বলা হয়।