প্রিয় ভাষার ইতিহাস
লিখে দিলেম প্রেমে মোড়ানো আবেগের রঙে।
চলো বিবেক দিয়ে গাঁথি শহীদের সৌধ।
ভাষা শুধু অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম কিংবা শব্দ বুনে আলাপচারিতার উপায় নয়। ভাষা সত্ত্বার প্রতিবিম্ব। আমাদের মনরাজ্যের প্রতি পরতে পরতে ভাষার ইমারত গড়েছে ঐতিহ্যের রংমহল। যার লালনীল গাঁথুনি আমাদের দেহে মনে সঞ্চার করে নবপ্রাণের উন্মাদনা। আমাদের ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় ভাষার প্রতি আমাদের যে প্রেম যে আবেগ তা একান্ত আমাদের অহংকার। ভাষার বুকেই আমরা আমাদের পরিচয় লিখেছি। বাংলা বাঙালীর প্রাণ। আত্মা। আমরা লালন করি বাংলাকে আমাদের মনের মণিকোঠায়। পাজরের প্রতিটি হাড় যেখানে শক্ত প্রাচীর গড়ে তুলেছে। কোন পঙ্কিলতা সেখানে স্থান পাবে না। সত্য সুন্দর পবিত্রতার প্রলেপে বাংলা আমাদের সম্মানের বটবৃক্ষ।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
১৯৪৭ সালে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের দ্বিজাতিতত্ত্বের বুকে ভর দিয়েই ভারত ভাগ হয়। জন্ম হয় পাকিস্তানের। কিন্তু পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিমমের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত মৌলিক পার্থক্য তথা বিভেদ নীতি যা রূপ নেয় অত্যাচারের, সেই বিভেদের আগুনে বাতাসকরণ করে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
ধীরে ধীরে উর্দুর ব্যবহার ক্রমেই উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে, কিন্তু বাংলার মুসলমানেরা তথা সব ধর্ম, সমাজের মানুষ বাংলা ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহারেই অভ্যস্ত ছিল। তাই এই ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যার থেকেই ভাষা আন্দোলনের উৎপত্তি।
আন্দোলনের পদক্ষেপ হিসেবে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে সমবেত হয়। সমাবেশ থেকে আরবি লিপিতে বাংলা লেখার প্রস্তাবের প্রতিবাদ এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। ছাত্ররা তাদের সমাবেশ শেষে এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। আন্দোলন দমনে ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বে-আইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যা আন্দোলনকারীদের মনে এক ইস্পাত কঠিন ইচ্ছের জন্ম দেয়। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন।
২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২: ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণে আমতলায় ঐতিহাসিক ছাত্রসভা।
২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২: পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণ, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রাক্কালে।
মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত সহ আরও অনেকে। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুণরায় রাজপথে নেমে আসে। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ভাষাশহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষাবধি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়:
ভাষা শহীদ
প্রথম ভাষা শহীদ রফিক। জব্বার। বরকত। শফিক। সালাম যদিও আবদুস সালাম তাৎক্ষণিক শহীদ নন, প্রায় দেড় মাস পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। কিন্তু তার নামটি আমরা সবার আগে উচ্চারণ করি।
ভাষা শহীদ রফিক
ভাষা শহীদ রফিকের পুরো নাম রফিক উদ্দিন আহমেদ। ১৯২৬ সালের ৩০শে অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার পারিল গ্রামে (বতর্মানে রফিকনগর) জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল লতিফ মিয়া এবং মাতা রাফিজা খাতুনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় ছিলেন রফিক।
১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে গর্জে ওঠা বাঙালী ছাত্র-জনতার মিছিলে রফিক অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গনে পুলিশ সেই মিছিলে বর্বরের মতো নির্বিচারে গুলি চালালে সেই গুলি রফিকের মাথায় লাগে। গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যায় এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়। মেডিকেল হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্বদিকে তার লাশ পড়ে ছিল। ছয় সাত জন ধরাধরি করে তার লাশ এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে রাখেন। রাত তিনটায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় ঢাকার আজিমপুর গোরস্তানে শহীদ রফিকের লাশ দাফন করা হয়। ডাঃ মশাররফুর রহমান খান রফিকের গুলিতে ছিটকে পড়া মগজ হাতে করে নিয়ে যান।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রফিকই প্রথম গুলিবিদ্ধ হন। তিনিই ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ।
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশ সরকার শহীদ রফিককে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। এবং সরকারী ভাবে ২০০৬ সালে তারঁ পারিল গ্রামে ভাষা শহীদ পাঠাগার ও স্মৃতি যাদুঘর স্থাপন করা হয় শহীদ রফিকের নামে।
ভাষা শহীদ শফিউর
ভাষা শহীদ শফিউর রহমান ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারী মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোন্নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাহবুবুর রহমান। ঢাকার পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন তিনি। ১৯৪৫ সালে কলকাতার তমিজউদ্দিনের কন্যা আকিলা খাতুনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শফিউর রহমানের এক মেয়ে এবং এক ছেলে। মেয়ে শাহনাজ এবং ছেলে শফিকুর রহমান যে শফিউরের মৃত্যুর সময় মায়ের পেটে ছিল এবং ১৯৫২ সালের মে মাসে সে জন্ম গ্রহণ করে। দেশ বিভাগের পর পিতার সঙ্গে ঢাকায় এসে ঢাকা হাইকোর্টে হিসাব রক্ষণ শাখায় কেরানী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী শফিউর রহমান সকাল দশটায় ঢাকার রঘুনাথ দাস লেনের বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তিনি সেদিন পাজামা, শার্ট, গেঞ্জি এবং কোট পরেছিলেন। পায়ে ছিল জুতা। সাইকেলে তিনি অফিসে যাতায়াত করতেন। সকাল সাড়ে দশটার দিকে নবাবপুর রোডে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ছাত্র জনতার বিক্ষোভ মিছিলের উপর পুলিশ বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। শফিউর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতরভাবে আহত হন এবং তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তার অস্ত্রোপচার করা হয় যদিও তা সফল হয়নি। ওই দিন সন্ধা সাতটায় তিনি হাসপাতালে মারা যান।
ঐদিন মধ্যরাতেই আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয় শফিউরকে। তাঁর কবরের পাশেই রয়েছে ভাষা শহীদ বরকতের কবর।
২০০৫ সালে ভাষা শহীদ শফিউর রহমানকে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। ২০০৬ সালে তাঁর স্ত্রী বেগম আকিলা খাতুনকে আজীবন ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
ভাষা শহীদ বরকত
ভাষা শহীদ বরকত ১৯২৭ সালের ১৬ জুন ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শামসুদ্দিন এবং মাতা হাসিনা বেগম।
শহীদ বরকত তালিবপুর হাইস্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে মেট্রিক এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে আই.এ পাস করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ হয়ে বি.এ. অনার্স পাস করেন এবং অনার্সে শ্রেণীতে ভর্তি হন।
১৯৫২ সাল ২১ ফেব্রুয়ারী আমতলায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত সমাবেশে যোগদান করেন বরকত। ঢাকাসহ সারাদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এই দাবীতে তখন আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রজনতার শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে ওঠে পাক কুচক্রী বাহিনী। ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হন আবুল বরকত। তলপেটে গুলি লেগেছিল তার । পরনের নীল হাফ শার্ট, খাকি প্যান্ট ও কাবুলী স্যান্ডেল রক্তে ভিজে যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি অবস্থায় রাত আটটার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারী রাত ১০টার দিকে পুলিশের কড়া পাহাড়ায় আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে আজিমপুর পুরাতন গোরস্থানে আবুল বরকতের লাশ দাফন করা হয়।
২০০০ সালে ভাষা শহীদ আবুল বরকতকে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপনের অনুষ্ঠানেও বরকতের মা হাসিনা বেগম প্রধান অতিথি ছিলেন।
ভাষা শহীদ সালাম
ভাষা শহীদ আবদুস সালাম ১৯২৫ সালে ফেনী জেলার দাগনভুঁইঞা উপজেলার লক্ষণপুর (বর্তমান সালাম নগর) গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ফাজিল মিয়া এবং মাতার নাম দৌলতের নেছা। ৪ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে আবদুস সালাম ছিলেন সবার বড়। ঢাকায় নীলক্ষেত ব্যারাকে তিনি বসবাস করতেন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগে পিয়ন হিসাবে চাকরি পান।
বাংলার আকাশ বাতাস যখন আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গে উষ্ণীয় তখন নিজের দেশপ্রেমী সত্ত্বার তাড়নায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২৭ বছরের আবদুস সালাম জাতির জন্য, মায়ের ভাষার জন্য বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। পরে ছাত্র-জনতার উপর পাকনেতাদের অঙ্গুলিহেলনে পুলিশ এলোপাথাড়িভাবে গুলি চালালে সালাম গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে সালাম সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মেডিক্যালের বারান্দায় পড়ে ছিলেন। প্রায় দেড় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ৭ এপ্রিল, ১৯৫২ তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২০০০ সালে ভাষা শহীদ আবদুস সালামকে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। ঐ সালেই ফেনী স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে 'ভাষা শহীদ সালাম স্টেডিয়ামে' রূপান্তর করা হয়। ২০০৭ সালে দাগনভুঞা উপজেলা মিলনায়তনকে 'ভাষা শহীদ সালাম মিলনায়তন' করা হয়।
ভাষা শহীদ জব্বার
ভাষা শহীদ আবদুল জব্বারের ১৯১৯ সালে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার পাঁচাইর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাসান আলী এবং মায়ের নাম সাফাতুন নেছা। ১৫ বছর বয়সে জীবন সংগ্রামের অজানা পথে বেরিয়ে অবশেষে নারায়ণগঞ্জে এসে জাহাজ ঘাটে কাজে যুক্ত হন। বছরখানেক পর তিনি এক ইংরেজ সাহেবের সহায়তায় একটি চাকরি নিয়ে বার্মায় যান। সেখানে আবদুল জব্বার দশ-বারো বছর অবস্থান করে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে এসে আমেনা খাতুন নামে এক যুবতীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ১৯৫১ সালের শেষের দিকে তাদের নূরুল ইসলাম বাদল নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।
আবদুল জব্বারের সন্তান জন্মানোর ৪ মাস পর তার শাশুড়ি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। শাশুড়িকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী তিনি ঢাকায় আসেন। শাশুড়িকে হাসপাতালে ভর্তি করে আবদুল জব্বার মেডিকেলের ছাত্রাবাসে গফরগাঁও নিবাসী হুরমত আলীর রুমে উঠেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হলে, কি হয়েছে দেখবার জন্য তিনি রুম থেকে বের হয়ে আসেন। ঠিক তিনি যখন ছাত্রদের কাছে গিয়ে দাড়ালেন তখনই পুলিশ গুলি শুরু করে। জব্বার গুলিবিদ্ব হন। ছাত্ররা আহত জব্বারকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করে।
২০০০ সালে ভাষা শহীদ আবদুল জব্বারকে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি
এক রফিক ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঐতিহাসিক করেছিলেন। তার ৪৬ বছর পরে আরেকজন রফিক সুদূর কানাডায় বসে সেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক করেছেন।
১৯৯৮ সালের ৯ই জানুয়ারী রফিক জাতিসংঘের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী কফি আনানকে ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রস্তাব করেন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’হিসেবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সে সময় সেক্রেটারী জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের। তার নজরে ঐ চিঠিটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ শে জানুয়ারী রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন।
সেই উপদেশ মোতাবেক রফিক ও তার সহযোদ্ধা আব্দুস সালামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গঠিত হয় নিয়ে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড” নামে একটি সংগঠন। এতে একজন ইংরেজীভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড”- এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন, এবং তার একটি কপি ইউএনওর ক্যানাডিয়ান এম্বাসেডর ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করেন।
১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন। আনা মারিয়া নামের এই ভদ্রমহিলাকে আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবো, কারণ এই ভদ্রমহিলাই পরামর্শ দেন রফিক ও সালামের প্রস্তাব ৫ টি সদস্য দেশ – ক্যানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে।
তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে উল্লেখিত ৫টি দেশ সহ আরো ২৯ টি দেশকে প্রস্তাবটির স্বপক্ষে সমর্থন আদায় করেন।
এরপর ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯। সেই ঐতিহাসিক দিন যেদিন সেই কাঙ্ক্ষিত প্রস্তাব উত্থাপন করা হলো সভার প্রথমেই। ১৮৮ টি দেশ এতে সাথে সাথেই সমর্থন জানালো। কোন দেশই এর বিরোধিতা করলোনা, এমনকি খোদ পাকিস্তানও নয়। সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হলো ইউনেস্কোর সভায়।
বাংলা ভাষা বিকৃতি
আজকের দিনে নিজেকে আধুনিক জাহির করার প্রয়াসে বাঙালী আওড়ে চলেছে বাংলা - ইংরেজি মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি ভাষায় । মোবাইলে ফেসবুকে অনলাইনে বাংলাভাষাকে যেভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে তাতে লজ্জিত হই এই ভেবে যে এই বাঙালীই বাংলার জন্য সর্বস্ব দিয়েছিল। নব্য এলিট শ্রেণী বাংলার পরিবর্তে ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছে ইংরেজি ভাষার প্রতি। ইংরেজি সাহিত্যে নাক না ডুবালে তাদের নিঃশ্বাসে পরিশুদ্ধতা আসে না। কবিতায়ও তারা ইংরেজির গন্ধ শোঁকে। দোকান এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সবজায়গায় আজ ইংরেজি ব্যবহারের ধুম। বাংলা ব্যবহার করলেও বানানে উদাসীনতা। আজকাল বাবা মায়েরা ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাচ্চাদের ভর্তি করতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাংলা আজ পদদলিত। খ্যাত। পুরানো। অশিক্ষিতের ভাষা।
দেশ জাতি যে ভাষার জন্য বিশ্বে সমাদৃত। আমরা সেই গৌরবিত ভাষাকেই হেয় করছি প্রতিনিয়ত। ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের মধ্যে ভর করে ভাষা শহীদদের আত্মা। ভাষায় আমাদের পরাণ কেঁদে ওঠে। অনলাইনে কবিতা গল্প হাবিজাবি লিখে বিখ্যাত হবার চেষ্টায় ভুলে যাই ইতিহাস। রক্তের দাগ। মিছিলের আওয়াজ। রাজপথের সেই আন্দোলন।
আমি আপনি আমরা সবাই একত্রিত প্রয়াসেই পারি বাংলাকে তার ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিতে। আসুন হাতে হাত রেখে বাংলা বানান সংশোধনে পরস্পরকে সাহায্য করি। সচেতন হই ভাষা ব্যবহারে। ভাষা আমাদের দিয়েছে পরিচয়। আমরা কি তাকে দিতে পারি না অতীত ঐতিহ্য। হারানো সম্মান।
সংযুক্তি
একুশে পদক
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য এ বছর একুশে পদক পেলেন ১৬ জন। বুধবার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের একুশে পদকের জন্য মনোনীতদের নাম ঘোষণা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার সকালে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একুশে পদক বিতরণ করেন। তিনি মাতৃভাষা ব্যবহারে সবাইকে যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ভাষা আন্দোলনে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, সাঈদ হায়দার, সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া (মরণোত্তর) ও জসিম উদ্দিন বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদকে সম্মানিত করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য একুশে পদক পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি মফিদুল হক।
এ ছাড়া ভাষা এবং সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ এবং হাবিবুল্লাহ সিরাজীকে একুশে পদক দেওয়া হয়েছে।
পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা স্বর্ণের তৈরি ৩৫ গ্রাম ওজনের পদক, দুই লাখ টাকা, সম্মাননাপত্র এবং একটি রেপ্লিকা পেয়েছেন।
তমদ্দুন মজলিস ও ২১শে ফেব্রুয়ারি
১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভাষা-আন্দোলনের পথিকৃৎ ও প্রধান সংগঠক অধ্যাপক আবুল কাসেম তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠা করেন।
তমদ্দুন মজলিসের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবী ইসলামী আদর্শের প্রতিষ্ঠা এবং পূর্বপাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে সার্থক আন্দোলনে রূপদান করা।
১৯৪৭-এর ১৫ই সেপ্টেম্বর এই সংগঠন থেকে 'পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষা বাংলা–না উর্দু?' নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়।
১৯৪৭ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে মজলিসের উদ্যোগে সাহিত্যিক ও ছাত্রদের এক আলোচনা সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আনুষ্ঠানিক দাবি জানানো হয়। সভায় উপস্থিত কয়েকজন মন্ত্রীও দাবির স্বপক্ষে বক্তব্য রাখেন। এ মন্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবিবুল্লাহ বাহার, বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী নূরুল আমীন, কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ মো. আফজাল। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে প্রথমবারের মত স্মারকলিপি পেশ করা হয়। ঐ স্মারকলিপিতে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষকসহ শতাধিক ব্যক্তি স্বাক্ষর করেন।
এর পক্ষ থেকেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজের সামনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী বাংলা ভাষা সমর্থকদের ওপর পুলিশের গুলীতে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত প্রমুখ তরুণদের রক্তে রাজপথ সিক্ত হয়ে উঠলে ভাষা আন্দোলনের নতুন গতিবেগ সৃষ্টি হয়। তাই ২১শে ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পেছনে তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকা অনেক।
তথ্যসূত্র - পাঁচ ভাষা শহীদের, ভাষা আন্দোলন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উইকিপিডিয়া|আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস(ইউনেস্কো)।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৩৫