আবার নির্মম, বর্বরোচিত ধর্ষণ ও খুন! রূপাদের সংখ্যা বাড়ছেই!! শুধু বাড়ছেনা রূপাদের কাছে আমাদের লজ্জা, অন্যায় বা পাপবোধ!!! বাড়ছেনা অপরাধীদের প্রতি ঘৃণা, অপরাধের প্রতিবাদ ও প্রতিকারও!!!! যেকোন ধর্ষনের ঘটনার পর মানুষের মধ্যে সাধারণত তিন রকমের প্রতিক্রিয়া হয়। যথাঃ
১। অল্প কিছু মানুষ ধর্ষণের প্রতিবাদ করবে, ধর্ষকের শাস্তি চাইবে।
২। কিছু মানুষ ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতার পোশাক, পর্দা না করা, উগ্র চলাফেরা বা রাতে একা চলাফেরাকে দায়ী করবে।
৩। কিছু মানুষ আর দশটা স্বাভাবিক ঘটনার মত এটাকেও মেনে নেবে এবং ঘটনা ভুলে গিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে।
যেকোন ঘটনা বা বিষয়ের প্রতি মানুষের ইতিবাচক বা নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয় কিভাবে? আসুন জানি।
মানুষ ছোটবেলা থেকে তার পরিবার, সমাজ, পারিপার্শ্বিকতায় যাকিছু দেখে, তা থেকে বিভিন্ন বিষয়, ঘটনা সম্পর্কে তার ধারণা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস এগুলো তৈরী হয় যা তার সারাজীবনের আচরণের মূল চাবিকাঠি। ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিকতা, সততা, উদারতা, পরিশ্রমী মানসিকতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ইত্যাদি গুণগুলো এভাবেই শিশুরা অর্জন করে তার চারপাশের মানুষকে অনুকরণ করে। একইভাবে চুরি করা, মিথ্যে বলা, মারামারি করা, প্রতারণা করা, কাউকে নির্যাতন করা, ইত্যাদিও শিশুরা শেখে পরিবারের ও আশেপাশের লোকেদের আচরণ অনুকরণ করেই। যেমন যেসব পরিবারে বাবা মাকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করে, সেসব পরিবারের শিশুরা এগুলোকে স্বাভাবিক ঘটনা মনে করে এবং বড় হয়ে তারাও এসব আচরণ করে। মন্দ কাজের জন্য পরিবার থেকে শাস্তি বা বাধা দেয়া না হলে সেগুলো তার আচরণে থেকে যায় যা নিয়ে শিশুরা স্কুলে আসে । স্কুলে আসার পর শিশুরা পরিবার থেকে ভুল কিছু শিখে আসলেও শিক্ষকরা শিশুদের ভুল বা অন্যায়ের পরিবর্তে ঠিক ও ন্যায় শেখানোর চেষ্টা করেন। যেমন- ধরা যাক কোন শিশু বাড়ীতে ছোটখাট চুরি করলেও বাবামা বাধা বা শাস্তি দেননি। ফলে ঐ শিশুর কাছে চুরি করা অন্যায় নয়। তাই ঐ শিশু স্কুলে এসেও চুরি করবে। তখন শিক্ষক তাকে শেখাবেন, চুরি করা অন্যায়। এভাবে শিশুদের মধ্যে ধীরে ধীরে ন্যায়-অন্যায় বোধ বা বিবেকবোধ জেগে ওঠে (শিক্ষক শেখালেও সবাই সবকিছু শেখেনা। ব্যক্তির নিজস্ব চাহিদা, আগ্রহ, মনোভাব,.... এসবের উপর কোনকিছু শেখা বা না শেখা নির্ভর করে)। একারণেই একজন অশিক্ষিত মানুষ যে কাজ খুব সহজে করে ফেলে, একজন প্রকৃত শিক্ষিত (নামমাত্র শিক্ষিত বা জ্ঞানপাপী নয়) মানুষ তা পারেনা। শিক্ষার মূল ভূমিকা এখানেই। মানুষের আচরণের কাঙ্খিত ও তুলনামূলকভাবে স্হায়ী পরিবর্তন আনে শিক্ষা । আচরণের এই কাঙ্খিত ও তুলনামূলকভাবে স্হায়ী পরিবর্তন আসে তার অনুশীলন (বার বার চেষ্টা ও ভুল করতে করতে মানুষ সঠিকভাবে কোনকিছু করতে শেখে। যেমন - পড়ালেখা, কাজ, ছবি আঁকা, ইত্যাদি) ও অভিজ্ঞতা থেকে। মানুষের অভিজ্ঞতা আসে দুভাবেঃ
১। একই সমাজ, দেশ বা পরিবেশে বসবাসকারী সব মানুষের অভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে। যেমন - বাংলাদেশের আবহাওয়া, পরিবেশ, মানুষের জীবনযাপন প্রণালী, খাবার, পোশাক, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি,... ইত্যাদি সব বাঙ্গালীদের অভিন্ন অভিজ্ঞতা।
২। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে ঘটে যাওয়া ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা যা সবার একরকম হবেনা। যেমন - কোন ব্যক্তির ছোটবেলায় বাবা বা মায়ের মৃত্যু, যুদ্ধে সব হারানো, চোখের সামনে প্রিয়জনকে খুন হতে দেখা, হিন্দু বা মুসলিম সংস্কৃতি, বিদেশে গিয়ে ভিনদেশী কোনকিছু জানা,.... ইত্যাদি অভিজ্ঞতা সবার হবেনা। (বাবামার আদরে বড় হওয়া শিশুর অভিজ্ঞতা আর এতিম শিশুর অভিজ্ঞতা এক নয়। পরিবারে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, সততা, নির্যাতন না করা,..এসব না শেখালে শিশু বড় হয়ে অন্যায় মেনে নিতে শিখবে।)
এই দুই ধরণের অভিজ্ঞতার প্রভাবে একই ঘটনাকে ( যেমন - রেপ) সব মানুষ একইভাবে দেখবেনা বা প্রতিক্রিয়া করবেনা। তাই রেপের প্রতি আমাদের একেক জনের মনোভাব এক এক রকম। একারণেই কিছু মানুষ ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতার পোশাক, পর্দা না করা, উগ্র চলাফেরা বা রাতে একা চলাফেরাকে দায়ী করে। কেউ রেপের প্রতিবাদ করে, কেউ করেনা বা মেনে নেয়।
ভারতীয় কোন মেয়েকে রাস্তায় জিন্স আর গেন্জি পরে হাঁটতে দেখলে, উপজাতি মেয়েরা বা উন্নত বিশ্বের মেয়েদের খোলামেলা পোশাকে চলাফেরা করতে দেখলেও কেউ তাদের দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকাবে না। কারণ ছোটবেলা থেকে তারা মা-বোনকে বা আশপাশের মেয়েদেরকে ওরকম পোশাকেই দেখে অভ্যস্ত বলে ওটা তাদের কাছে স্বাভাবিক অভিন্ন অভিজ্ঞতা (ওরা অবাক হবে কোন মেয়েকে বেশী পোশাকে পুলে নামতে দেখলে)। আমাদের দেশের মানুষরা নারীদের ওরকম পোশাকে দেখেনা বলেই নির্যাতনের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করে। কারণ ভিনদেশীয় পোশাককে তারা স্বাভাবিকভাবে মন থেকে মেনে নিতে পারেনা। ভিনদেশীয় সংস্কৃতিকে আমরা একারণেই অপছন্দ করি বা পছন্দ করলেও ( যেমন - হিন্দী গান বা বিদেশী অনুষ্ঠান) আপন ভাবতে পারিনা। সম্প্রতি ঢাবির সুফিয়া কামাল হলে মেয়েদের সালোয়ারের উপর গেন্জি পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে একই কারণে।
আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ হলো, মেয়েরা পর্দা করবে, খোলামেলা পোশাকে বা রাতে একা চলাফেরা করবে না। আমাদের ধর্মীয়, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ হলো, মেয়েরা পুরুষের অধীনস্ত। তাই তারা পুরুষদের দ্বারা শাসিত হবেই। প্রয়োজনে পুরুষ নারীকে নির্যাতন ও করার অধিকার রাখে, যেহেতু নারীরা পুরুষের উপর নির্ভরশীল।
আমাদের সমাজের প্রায় সব নারী-পুরুষ তাদের মেয়েরা স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হলে বলবে, "মেনে নাও, কপালের দোষ, বাচ্চার কথা ভাবো, একা কিভাবে বাঁচবে, লোকে মন্দ বলবে, ধৈর্য্য ধর,..... ইত্যাদি।" মানে মেয়েরা নির্যাতিত হবে, হতেই পারে - এটাই আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ। একারণেই অনেক পুরুষ মনে করে, যেহেতু মেয়েরা এসব মূল্যবোধ মানছে না, তাই তার শাস্তি হিসেবে তারা ধর্ষিত হতেই পারে, হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেসব পুরুষ এরকম ভাবে, তারা সুযোগ পেলেই মেয়েদের রেপ করে। কারণ তারা এটাকে অন্যায় মনে করেনা। তাই তারা নিজেকে সংযত করেনা। তাদের ভাব এমন যে, "আমার ইচ্ছা হয়েছে, করেছি। এতে দোষের কি আছে? মেয়েদের সাথে ছেলেরা এমন করতেই পারে।" আমিন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলেকে পুলিশ ধরলে বাবা ও ছেলে এরকম মনোভাব প্রকাশ করেছিল। এদেশে টাকা বা ক্ষমতা থাকলে অপরাধ করে পার পাওয়া যায়। তাই শাস্তির ভয় থাকেনা বলেই লোকে নির্ভয়ে যেকোন অপরাধ করে। এসব কারণে এদেশে রেপ থামবেনা।
যারা রেপ করার সুযোগ পায়না বা শাস্তির ভয় করে, তারা রেপ করেনা। কিন্তু সুযোগ পেলে করবেনা, এমন কিন্তু নয়। এরাই মেয়েদের দোষ খোঁজে (পোশাক, উশৃংখল চলাফেরা, পর্দা না করা,... ইত্যাদি )। এসব অজুহাতে তারা ধর্ষককে উস্কানি দেয়। তারা ধর্ষণকে সমর্থন করে বা এটাকে অন্যায় বা পাপ মনে করেনা। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশে মেয়েদের দিকে কুনজরে তাকায়না, অত্যন্ত শালীন পোশাকের মেয়ে দেখেও তাদের মুখে লালা ঝড়েনা - এমন পুরুষের সংখ্যা অতি নগন্য। মেয়েদেরকে বিশ্রী লোভী চোখে দেখার, ছোঁয়ার, কটু কথা বলার, নির্যাতন করার লোকের সংখ্যাই বেশী। এরা সবাই সুযোগের অভাবে সাধু পুরুষ। অনেক নারীরাও রেপের জন্য মেয়েদেরকেই দায়ী করে। তাই এদেশে রেপ হবেই।
বিদেশে মা বুক খুলে শিশুকে দুধ খাওয়াছে, বিকিনি পরে বীচে বা পুলে সাঁতার কাটছে, হাঁটছে, বসে আছে, স্বল্প পোশাকে জনাকীর্ণ এলাকায় ঘুরছে,... এরকম দৃশ্য খুবই কমন। পোশাকই রেপের কারণ হলে উন্নত বিশ্বের দুধ খাওয়াচ্ছে এমন মায়েদের বা খোলামেলা পোশাকের প্রতিটা নারীর প্রতিনিয়ত রেপ হবার, তাদের শরীরে হাত দেবার, তাদেরকে কুনজরে দেখার কথা। তা হয়না। বিকিনি পরা মেয়েদের দিকেও কেউ সেভাবে তাকায়না, তাদেরকে রেপ করেনা। বিদেশে বেশীরভাগ রেপ হয় মাতাল অবস্থায়, যখন তাদের স্বাভাবিক বোধ থাকেনা বা যারা মানসিক বিকারগ্রস্ত। আমরা করি জেনে, বুঝে, স্বাভাবিক জ্ঞান থাকা অবস্থায়। তাই এদেশে রেপ বন্ধ হবেনা।
ধর্ম সব মানুষের মনে বিবেকবোধ জাগাতে পারলে বা পাপবোধ তৈরী করতে পারলে ধার্মিকরা পাপ করতো না। ভারতের ধর্মগুরুরা, সারা বিশ্বের ধার্মিক লোকেরা, হাফেজ হুজুররা পাপ করতো না। সৌদি আরবের বা ধনী মুসলিম দেশগুলোর লোকেরা সীমাহীন অপচয়, বিলাসিতা, কাজের মেয়েকে রেপ, মদ-জুয়া, সমকামীতা, বহুগামিতা, অবোধ শিশুকে উটের জকি হিসেবে ব্যবহার,... এসব করতোনা।
যারা প্রকৃত শিক্ষিত (পরিবার ও শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের ফলে বিবেকবোধসম্পন্ন), তারা মনে করে, কারো প্রতি জোর-জুমুম করা অনুচিত। তারা নিজেদেরকে সংযত করে। তারা মেয়েদের বা যেকোন মানুষকে নির্যাতন করা অন্যায় মনে করে। তাই প্রকৃত শিক্ষায় (মূলত পারিবারিক শিক্ষায়) শিক্ষিত করে তুলতে পারলে মানুষের মধ্যে বিবেকবোধ জাগানো সম্ভব যার ফলে নারী নির্যাতনসহ যেকোন অপরাধ কমানো সম্ভব।
আর রেপসহ যেকোন অপরাধ কমানোর সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হলো, আইনের কঠোর ও দ্রুত প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। এটি করার মত আমাদের দেশের তথা সরকারের যে নৈতিক ভিত্তি ও সামর্থ নেই, সেটা বহুবার বহুভাবে প্রমাণিত হয়েছে যা বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ জানে। যে দেশে দিনের বেলা প্রকাশ্যে, অনেক লোকের সামনে কুপিয়ে মানুষ খুন হয় এবং সে খুনের দৃশ্যের ভিডিও থাকার পরেও আসামীরা ফাঁসির রায় থেকে খালাস পায়, সে দেশের..........!!!!!!!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ১১:৫০