কিছু ঘটনা থেকে আমার মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে সবচেয়ে আজব প্রাণী হল মানুষ! আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, কিছু নারী ও পুরুষ, তাদের সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন বিষয়েও ঈর্ষা, রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ করে, মিথ্যে বলে বা বিরূপ মত প্রকাশ করে। উদাহরণ দেই -
এক: একদিন আমাকে রাস্তায় গাড়ী চালাতে দেখে এক লোক ( যে মাঠে ঘাস কাটছে) বিরূপ মন্তব্য করল। আমার টাকায় কেনা গাড়ী আমি চালাচ্ছি। তাতে তার রাগ করার বা বিরক্ত হবার কোন কারণ থাকতে পারেনা।
দুই: আমার মেয়েকে জেএসসি পরীক্ষার হলে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছি। তিন ঘণ্টা বসে থাকতে হবে। তাই কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছি। সুন্দর একটা শাড়ী পরেছি। রোজই নতুন নতুন শাড়ী পরে মেয়ের হাত ধরে যাই। মাকে দেখতে সুন্দর লাগে, সবাই সেটা বলে। তাই দেখে মেয়ে খুশী হয়। এক মা আমাকে দেখে টিপ্পনী কাটলেন,"মনে ফুর্তি কত! গান শোনা, সাজগোজের বাহার ছুটেছে!" আজব কথা!! আমি গান শুনলে বা সাজলে ওনার সমস্যা কোথায়? তার ইচ্ছা হলে সে নিজেও যা খুশী করুক! তাকে কে মানা করছে?
তিন: আমার লেখা ব্লগের প্রথম পাতায় স্টিক হওয়াতে কিছু মানুষ নেগেটিভ কমেন্ট করেছে। লেখার মান খারাপ হলে বা বক্তব্য পছন্দ না হলে নেগেটিভ কমেন্ট করা দোষের কিছুনা। আমি নিজেও কখনও কখনও সেটা করি। কিন্তু প্রথম পাতায় আাসা নিয়ে আপত্তি করাটা কি উচিত? কোন লেখা প্রথম পাতায় যাবে কি যাবেনা তা মডারেটর বা এডিটররা ঠিক করেন, লেখকরা নয়। আবার কিছু মানুষকে দেখি, ক্রমাগত অন্যের লেখাতে নেগেটিভ কমেন্ট করেন। মানে নেগেটিভ কমেন্ট করাটাই তার স্বভাব।
আমি বোঝার চেষ্টা করেছি, এর কারণ কি। আমার মনে হয়, তারা এটা করেন ঈর্ষা থেকে এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা থেকে। যারা অকারণে অন্যের বিষয়ে বিরক্ত হন, তারা ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী, ব্যর্থ ও মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন। তাদের নিজেদের জীবন আনন্দহীন। এজন্যই তারা অন্যের আনন্দ দেখে ঈর্ষাকাতর হয়ে নেতিবাচক কথা বলেন। আবার কেউ কেউ অন্যকে অপমান বা বিতর্কিত করে হলেও পাবলিসিটির জন্য মিথ্যে বলেন। যেমন - সাকিবের কাজের মেয়েকে নিয়ে, আব্দুল জব্বারের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্য চাওয়া নিয়ে বা সালমান খানের মৃত্যু নিয়ে যারা মিথ্যা খবর ছড়াচ্ছেন, তারা আসলে পাবলিসিটি পাবার জন্য এটা করছেন। পাবলিসিটির জন্য মরা মানুষকেও রেহাই দিচ্ছেননা। কি আজব কথা!!!
কখনও কখনও নিজের বদনাম নিজে করেও লোকে পাবলিসিটি পেতে চায়। অভিষেক ও ঐশ্বর্য রায়ের বিয়ের দিন এক যুবতী মিডিয়ার সামনে দাবী করেছিল যে অভিষেক তার বয়ফ্রেন্ড। একথা শুনে মিডিয়া সারাদিন তাকে নিয়ে হুলুস্থুল। পরে দেখা গেল, (মেয়েটি ডিভোর্সি, একটি ছেলেও আছে) পাবলিসিটির জন্য নির্লজ্জ মিথ্যাচার। ফিল্মস্টাররাও নাকি নিজের বা ছবির পাবলিসিটি বাড়ানোর জন্য বা মিডিয়া কভারেজ পাবার জন্য নিজেদের প্রেম বা পরকীয়ার খবর বা নানা গসিপ নিজেই ছড়ান। অদ্ভুত মানুষের মন!!!!
আমরা নিজের, নিজ দল-মতের প্রসংসা করি। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজের দোষ গোপন করি, কেউ দোষ ধরিয়ে দিলে বা অপরাধ সম্পর্কে কথা বললে তাকে দাবিয়ে রাখি, আক্রমণ করি, তার দোষ খু্ঁজি (চিফ জাস্টিসের রাজাকার লিংক খুঁজি) বা কখনও কখনও খুনও করি এবং ভুলেও নিজের দোষ বা অপরাধ কখনোই স্বীকার করিনা। কিন্তু ঐ একই অপরাধ অন্য কেউ করলে তার সমালোচনা করি, সুযোগ পেলে অন্যকে অপমান করি বা বিপদে ফেলি। আমরা নিজে অসৎ, ঘুষখোর, অপরাধী হয়েও আরেকজনকে অসৎ, ঘুষখোর বা অপরাধী বলি। রাজনীতিতে এমন উদাহরণ প্রচুর। একজন আরেকজনের সাথে বা একদল আরেকদলের সাথে এমন আচরণের সুন্দর একটা নামও আছে -"কাদা ছোঁড়াছুড়ি"। অপরাধীরা যখন বিচারের মুখোমুখি হয়ে ন্যায়বিচার দাবী করে, তখন হাসি পায়। যখন সে নিজে অপরাধ করছিল, তখন আক্রান্তদের ন্যায়বিচার কোথায় ছিল? (যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায়বিচার পাবার আকুতি, মওদুদের বাড়ী হারানোর আকুতি আমরা দেখেছি।)
মানুষ উপকারীর উপকার মনে রাখেনা। কথায় আছে, উপকারীকে বাঘে খায়। বিপদে যে সাহায্য করে, বিপদ পার হলে মানুষ সেই সাহায্যকারীকেই অবজ্ঞা করে, বিপদে ফেলে, খুনও করে। বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছিল তাঁরই আশীর্বাদপুষ্টরা। একদিন এক লোক বিদ্যাসাগরকে এসে বলল, "অমুক লোক আপনাকে গালি দিচ্ছে।" শুনে বিদ্যাসাগর বিন্দুমাত্র অবাক না হয়ে বললেন,"নিশ্চয় আমি কখনও তার কোন উপকার করেছি। নাহলে তো গালি দেবার কথা নয়।" পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সত্যিই বিদ্যাসাগর তার উপকার করেছিলেন। অথচ বিপদ পার হয়েছে বলে এখন সে উপকারীকে গালি দিচ্ছে। বড়ই আজব প্রাণী! আমি নিজেও অনেককে নানাভাবে সাহায্য করি। পরে তাদের কাছ থেকেই আঘাত পাই। আপনাদেরও এমন অনেক অভিজ্ঞতা থাকার কথা।
শ্বাশুড়ী মেয়েকে ভালবাসে প্রাণ দিয়ে। কিন্তু বৌকে দেখতে পারেনা। মাবাবা ছেলেকে ভালবাসে, কিন্তু জামাইকে সন্দেহ করে, ভয় পায়, ঈর্ষা করে। আমার দুই মেয়ে। তাই সবাই আমাকে বলে, "টাকা রোজগার করে লাভ কি? সব তো ভূতে (জামাই) খাবে।" তার মানে, ছেলের বৌ খেলে আপত্তি নাই, জামাই খেলেই আপত্তি! অথচ বৌ ও জামাই দু'জনেই নিজের সন্তান নয়!
ছেলে বৌকে কাজে সাহায্য করলে মা ছেলেকে বলে 'স্ত্রৈণ' আর জামাই মেয়েকে সাহায্য করলে বলে 'কেয়ারিং'। ছেলে প্রেম করলে (কারো বোনের সাথে) কোন আপত্তি নাই। কিন্তু নিজের বোন কারো সাথে প্রেম করলে ভায়েরা বোনকে মেরে তক্তা বানায়।
এক ছেলের হাতে রিপোর্ট কার্ডে নম্বর কম দেখে বাবা তেলেবেগুণে জ্বলে উঠে বললেন, "এতগুলা বিষয়ে ফেল!! আমি সব বিষয়ে লেটার পেতাম..."। ছেলে বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "বাবা, ওটা তোমার রিপোর্ট কার্ড। পুরনো কাগজপত্রের মধ্যে পেয়েছি।" আজকাল সেসব বাবামাই সন্তানকে রেজাল্ট খারাপ হলে বেশী গালি দেন, যাদের নিজেদের রেজাল্ট ছিল মাশআল্লাহ!! সেসব বাবামাই সন্তানকে রাতদিন পড়তে বলেন যারা নিজেরা....!!!
মানুষ নিজেকে বেশী ভালবাসে, নাকি সন্তানকে? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য একটি শিম্পাঞ্জীকে তার শিশুসহ খাঁচায় আটকে রেখে খাঁচার নীচে তাপ দেয়া হল। তাপ যত বাড়ে, শিম্পাঞ্জী তত হাতে, কোলে, ঘাড়ে, মাথায় নিয়ে বাচ্চাটাকে বাঁচাবার চেষ্টা করে। এভাবে তাপ যখন সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেল, তখন বাচ্চাটাকে নীচে ফেলে বাচ্চার উপর উঠে দাঁড়িয়ে শিম্পাঞ্জী নিজেকে বাঁচালো। তখন সাথে সাথে তাপ বন্ধ করে দেয়া হলো।
মানুষ এমন করেনা। কখনও কখনও মা সন্তানের জন্য জীবন দেয়, হাজার কষ্ট বুক পেতে নেবে বা নেয় - এমনটাই আমাদের বিশ্বাস। আসলেই তাই কি?
ধীরে ধীরে আমাদের বিশ্বাসের জায়গাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। যেদিন সৎ বাবার আট বছর ধরে মেয়েকে রেপ করার খবর পড়লাম, সেদিন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে চাইনি। যখন জানলাম, মা সব জেনেও চুপ করে ছিল, তখন নিজের গায়ে থুথু দিতে ইচ্ছে হয়েছে। আশি ভাগ স্ত্রীকে নির্যাতন করে তার আপন স্বামী! অধিকাংশ শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তার নিকটআত্মীয়দের দ্বারা! পতিতালয়ে আসা অধিকাংশ মেয়েদেরকে সেখানে বিক্রি করে দিয়েছে তাদের ভালবাসার, ভরসার মানুষরা!
আগে প্রকাশ্যে কেউ কোন শিশুকে মারলে কেউ না কেউ বাধা দিত। এখন মারতে মারতে মেরে ফেললেও শিশুর আর্তচিৎকারে কারো মন গলেনা। চারপাশে মানুষের এত ভয়ংকর আচরণ, এত অনাচার দেখেও আর কোন কিছুই মানুষকে অবাক বা বিচলিত করেনা, কষ্ট দেয়না, প্রতিবাদী করেনা। নিষ্ঠুর সব অপরাধ প্রকাশ্যে ঘটতে দেখেও মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে দেখে, ছবি তোলে, ভিডিও করে, আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে যায়না। দেখে মনে হয়, যেন এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক।
পশু-পাখীও নিজ গোত্রের কাউকে আক্রান্ত হতে দেখলে প্রতিবাদ করে। মানে কারো অন্যায়, জুলুম মেনে নেয়না। আমরা কি পশু-পাখীর চেয়েও অধম হয়ে যাচ্ছি???
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১:৫৫