বাবার বিয়ে এবং একটি জঘণ্য অপরাধ
আমার পরিচিত একজন ক্ষমতাবান মানুষ দু'বছর আগে বড় বড় ছেলেমেয়ে, বৌ রেখে গোপনে এক সুন্দরী মেয়েকে ( ধরা যাক, তার নাম লিমা) বিয়ে করেছে। সে ক্ষমতাবান বলেই বিষয়টি দু'বছর গোপন রাখতে পেরেছে। তবে যতবড় ক্ষমতাবানই হোক, সত্য বেশীদিন চাপা থাকেনা। থাকেওনি। তার এহেন আচরণে বৌ-বাচ্চারা দিশেহারা। লজ্জা, অপমান, প্রতারণাা, বিশ্বাসঘাতকতা, সামাজিকভাবে হেয় হওয়া..... ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে তারা চরম মানসিক যণ্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েটি পাগলপ্রায়। তার বোবা চোখ, এক সমুদ্র হতাশা আর বুকফাটা কষ্ট আমার আজকের লেখার অনুপ্রেরণা।
আগেকার দিনে পুরুষরা একাধিক বিয়ে করত ধর্ম প্রচারের জন্য। সম্পদ-সংসারের দেখভাল, সন্তান লাভ, পুত্রান্তান লাভ, বা ক্ষমতাবান রাজা বা ধনী পুরুষদের সুন্দরী মেয়েদের প্রতি লালসা থেকে বহুবিবাহের প্রচলন। সব ধর্মে এসব কারণেই বহুবিবাহ জায়েজ।
যৌক্তিক কারণে নারী বা পুরুষের একাধিক বিয়ের বিধান থাকা জরুরী ছিল। যেমন -কারো স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলে সে আবার বিয়ে করতে পারে এর ফলে। ইসলাম বৈধ কারণে (যেমন - স্ত্রীর অসুস্থতা, সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা, সাংসারিক কাজে অপারগতা, ইত্যাদি) স্বামীর একাধিক বিয়ের অনুমতি দিয়েছে, তবে তা অবশ্যই সব স্ত্রীর সাথে সমান আচরণ করতে পারার শর্তে, যা অসম্ভব।
আবার ডিভোর্সের পর কোন পুরুষ বা নারী আবার নতুন করে অন্য কাউকে বিয়ে করলে সেটা বৈধ। যদিও অনেক সন্তান বাবা বা মা মারা যাবার পরেও বাবা বা মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারেন না। যেমন, এক ছেলে তার মা মারা যাবার পর বাবা বৃদ্ধ বয়সে আবার বিয়ে করেছেন। সেই অপরাধে ছেলে বাবার সাথে সম্পর্ক ছেদ করে বিদেশে চলে গেছে। ভেবে দেখুন, মায়ের মৃত্যুর পরেও যেখানে সন্তানরা বাবার বিয়ে মেনে নিতে পারেনা, সেখানে মা বেঁচে থাকা অবস্থায় বা মাকে ডিভোর্স না দিয়ে বাবা আবার বিয়ে করলে সন্তানরা সেটা মেনে নেবে কিভাবে? আর মা???
বহুবিবাহের বিধান থাকার সবচেয়ে খারাপ দিক হল, স্ত্রীর জন্য এটি একটি ভয়াবহ মানসিক নির্যাতন, সন্তানদের জন্য তো বটেই। আমার মনে হয় পৃথিবীতে মেয়েদের প্রতি যত বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, তারমধ্যে মানসিক দিক থেকে সবচেয়ে নির্মম হল স্ত্রীর উপস্থিতিতে স্বামীর একাধিক বিয়ে। দ্বিতীয় বিয়ে করামাত্র প্রথম স্ত্রী যে ভয়াবহ মানসিক কষৃট পায়, তাতে "সব স্ত্রীর সাথে সমান আচরণ করার" শর্ত ভেঙ্গে যায়। তাহলে কি দ্বিতীয় বিয়ের বৈধতা থাকে?
এখনও আমাদের সমাজে কোন কারণ ছাড়াই অনেক পুরুষরা দ্বিতীয়, তৃতীয়,... বিয়ে করে। সুন্দরী স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সব আছে। তবু ক্ষমতা বা টাকার দাপটে স্রেফ যৌন লালসা মেটানোর জন্য কেউ গোপনে, কেউ প্রকাশ্যে বিয়ে করে। এরা একবারও ভাবেনা, তার আগের পরিবারের লোকগুলার কি দশা হবে? তারা কতটা মানসিক কষ্ট পাবে?
আবার হরহামেশাই দেখা যায়, বিবাহিত নারী বা পুরুষ পরকীয়ায় জড়ান। তখন তাদের সামনে ৩ টি বিকল্প থাকে। যথা -
১. তখন অনেকে সাহস করে বর্তমান সঙ্গীকে তালাক নিয়ে পছন্দের মানুষকে পুনরায় বিয়ে করেন।
২. আবার বেশীরভাগ মানুষ সমাজ, পরিবার সন্তানের কথা ভেবে নিজেকে সংযত করেন।
৩. কেউ কেউ এ দু'টোর কোনটাই না করে গোপনে অনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে যায় এবং তারা বৌ-বাচ্চার সাথে প্রতারণা করে।
যখন কোন স্বামী বা স্ত্রী বুঝতে পারেন যে, তার সঙ্গী অন্য কারো প্রতি আসক্ত, (তখন তাদের মধ্যে সুস্হ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকেনা। এ অবস্থা কারো জন্যই ভাল নয়।) তখন তার করণীয় কি? সমাজ-সন্তান-নিরাপত্তার কথা ভেবে তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে ভালবাসাহীন বিবাহিত জীবন চালিয়ে যাওয়া? নাকি বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে সঙ্গীকে পরিত্যাগ করা?
আসুন জানি, এ বিষয়ে মনোবিজ্ঞান কি বলে?
একটা শিশুর দেহ ও মনের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য সুস্থ ও স্বাভাবিক পারিবারিক পরিবেশ খুবই জরুরী। মায়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা (গর্ভকালীন ও জন্ম পরবর্তী সময়ে) শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশকে চরমভাবে প্রভাবিত করে।
মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে, শিশুদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য ভগ্নগৃহ বা ব্রোকেন হোমের (পরিবারে মৃত্যু, বিবাহবিচ্ছেদ, সেপারেশন বা ডিজারশনের কারণে স্বামী বা স্ত্রী যে কোন একজনের অনুপস্থিতি) চেয়ে কলহপূর্ণ পরিবার ( যে পরিবারে বাবা-মা অধিকাংশ সময়ে কলহে লিপ্ত) অনেক বেশী ক্ষতিকর।
বাবা-মার ঘন ঘন কলহ শিশুর মনে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। কেননা তার নিরাপত্তা বিধান ও স্বার্থ রক্ষারর একান্ত আশ্রয়স্থল (বাবা-মা) সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ে। বাবা-মার দ্বন্দ্ব শিশুর আত্মদ্বন্দ্বে পরিণত হয়, যার মীমাংসা সে করতে পারেনা। পরিণামে শিশুর চরম মানসিক বিপর্যয় ঘটে।
বাবার দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনে মা যখন কষ্টে থাকে, তখন সে সন্তানদের দিকে প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিতে পারোনা। ফলে শিশুরা হতাশা, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধবোধ, স্নেহবঞ্চনা, দুশ্চিন্তা... এসবে ভোগে।
বাবা-মার মধ্যে কলহপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে বড় হলে শিশুদের নানারকম মানসিক ক্ষতি হতে পারে। প্রচণ্ড মানসিক চাপ থেকে নানা মানসিক সমস্যা ও রোগ যেমন- দূর্বল ব্যক্তিত্ব, পরনির্ভরশীল, নানা পরিবেশ ও মানুষের সাথে সঙ্গতিবিধানের অক্ষমতা, কাউকে বিশ্বাস করতে বা ভালবাসতে না পারা, ট্রমা, এংজাইটি, ক্রনিক ডিপ্রেশন, ফোবিয়া, অবসেসিভ এন্ড কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, পোস্ট ট্রমেটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার... ইত্যাদি হতে পারে।
পিতা-মাতার প্রত্যাখ্যান ( Parental Rejection) শিশুর জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। পরকীয়া বা দ্বিতীয় বিয়ে বা অন্য কোন কারণে সন্তান বাবামার কাছে অবাঞ্ছিত হলে তারা সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত ঔদাসীন্য ও অনীহা প্রদর্শন করে। একে নিষ্ক্রিয় প্রত্যাখ্যান ( Passive Rejection) বলে। আবার কখনও বাবামা সন্তানের প্রতি রূঢ় ও উৎপীড়নমূলক আচরণ করতে পারে। একে সক্রিয় প্রত্যাখ্যান ( Active Rejection) বলে। এ উভয় প্রত্যাখ্যানই শিশুর উপর অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। তারা সমস্ত জগত সংসারকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর স্থান মনে করে। এরূপ পীড়নমূলক অবস্থায় নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় বোধ করে, তার সামাজিক অভিযোজন প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়। পরিণামে বিভিন্ন মানসিক গোলযোগে আক্রান্ত হয়।
কৃত্রিম পরিবেশ ( যেখানে সামাজিক কারণে বাবা-মা সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেন, প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে কোন সুসম্পর্ক থাকেনা) ও শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
হুমায়ূন আহমেদের ছেলে নুহাশের লেখা আমি পড়েছি। এত আপন যে বাবা, দ্বিতীয় বিয়ে করার পর কিভাবে একটু একটু করে সেই বাবাই পর হয়ে যায়, তার কষ্টকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে তার লেখায়।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে নর-নারী প্রেম করে, উভয়ের সম্মতিতে সেক্স করে, লিভ টুগেদার করে, বিয়েও করে। কিন্তু যখন বুঝতে পারে দু'জনের মধ্যে আর ভালবাসা নেই, ওরা উভয়ের সম্মতিতে ডিভোর্স নেয় বা ব্রেকআপ করে। আমাদের মত দিনের পর দিন ভালবাসার, ভালথাকার অভিনয় করেনা। ওরা ভীষণ সৎ। একটি সম্পর্কে থাকাকালীন অন্য্ সম্পর্কে জড়ায়না। মানে, একই সাথে একাধিক প্রেম বা পরকীয়া করেনা। আমরা করি।
মূল কথা হল, আমাদের সমাজে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা কম। সেজন্যই পরিবার ছেলে বা মেয়েকে জোর করে অপছন্দের কারো সাথে বিয়ে দেয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর নির্যাতন, পরকীয়া, বহুবিবাহ.. সহ্য করে আমরা সংসার করি। তালাক দেইনা। ছেলেরা অবশ্য বৌ পছন্দ না হলে তালাক দেয়, দিতে পারে।
হুমায়ূন আহমেদ গুলতেকিনকে তালাক দিয়ে শাওনকে বিয়ে করার পর দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল এ কারণে যে, হুমায়ূন আহমেদের মত বিচক্ষণ, বয়স্ক ও শ্রদ্ধেয় মানুষ বৌ-বাচ্চা রেখে মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করেছেন। আমাদের সমাজ বিবাহবিচ্ছেদকে মেনে নিতে চায়না, বিশেষ করে নারী বা পুরুষের বয়স বেশী হলে বা সন্তান থাকলে। অর্থাৎ হুমায়ূন আহমেদ বিয়ে না করে শাওনের সাথে পরকীয়া চালিয়ে গেলে কারো তেমন আপত্তি হতনা, যেমন গোপনে বিবাহিত পুরুষরা পতিতালয়ে গেলে, কাজের মেয়ের সাথে সেক্স করলে বা পরকীয়া করলে কারো কিছু বলার থাকেনা। সবাই শাওনকে দুষতে ভালবাসে, সব দোষ শাওনের, কারণ সে মেয়ে। সবাই মনে করে, শাওনের বিয়ে করতে রাজী হওয়া ঠিক হয়নি। পুরুষতো চাইবেই। শাওন জেনেশুনে অমন লোককে বিয়ে করতে রাজী হবে কেন? তার কি আর বর জুটছিল না?
গুলতেকিন অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন, হুমায়ূন আর তাকে ভালবাসেন না। এরকম পরিস্থিতিতে আমরা সামাজিক কারণে বিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। এটি শিশুদের জন্য বেশী ক্ষতিকর।
ভারতীয় অভিনেতা আমীর খান যখন কিরণের সাথে সম্পর্কে জড়ান, তখন তিনি তাঁর দুই ছেলে ও প্রথম স্ত্রী রীণার সাথে বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। পরে সবার সম্মতিতে মিউচুয়াল ডিভোর্স হবার পর আমীর কিরণকে বিয়ে করেন।
আমীর খান গোপণে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে পারতেন। তাতে সমাজ খুশী হত, রীণা বা আমীর (হুমায়ূন ও গুলতেকিন) সুখী হতেন না। বৈবাহিক সম্পর্কে পরস্পরের প্রতি ভালবাসা না থাকলে শুধু দায়িত্ববোধের কারণে একসাথে বাস করলে সেটা কারো জন্যই ভাল নয়।
আমার ভাবনার বিষয়টি হল, আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় আমরা জেনেশুনে পুরুষের এই যৌন লালসাকে প্রশ্রয় দেই আর্থ-সামাজিক কারণে। যেমন - লিমার পরিবার সব জেনেশুনে বিয়ে দিয়েছে। লিমাও বিবাহিত, বয়স্ক এবং তিন সন্তানের জনককে বিয়ে করতে আপত্তি করেনি টাকার লোভে। অসহায় কোন মেয়ে বাধ্য হয়ে এরকম বিয়েতে রাজী হলে তাকে দোষ দেয়া যায়না। কিন্তু লিমা অনায়াসে কোন অবিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করতে পারতো, যেহেতু ঐ লোকের সাথে তার তেমন কোন সম্পর্ক ছিলনা। তার কোন দায় ছিলনা এমন লোককে বিয়ে করার। লিমা আপত্তি করলে ঐ পরিবারটার এমন দূর্গতি হতনা।
আবার ঐ ক্ষমতাবান লোকের প্রতি কোন অভিযোগ থাকতো না যদি সে আমীর খানের মত করতো। তাহলে তার পরিবার এতটা কষ্ট পেতনা। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হল, সব জানার পরেও তার প্রথম স্ত্রী তাকে ছাড়েনি। এটিই মূল কারণ যার ফলে পুরুষরা এমন অন্যায় করে, করতে পারে, ভবিষ্যতেও করবে। তারা খুব ভাল করে জানে, তারা যাই করুক, স্ত্রীদের পক্ষে স্বামীকে ছাড়া কতটা কঠিণ!!!
আমার ভীষণ খারাপ লেগেছে যে, অনেক চেষ্টা করেও আমি ঐ নির্দয় বাবার মেয়েটিকে বিন্দুমাত্র সান্ত্বনা দিতে পারিনি। আমার কোন কথাই তাকে লেশমাত্র স্পর্শ করেনি। করার কথাওনা। এতবড় শোক এত সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলল, "দোস্ত শোন। তোকে একটা গল্প বলি। এক ভদ্রলোকের দুই বৌ ছিল..."। বন্ধুকে থামিয়ে দিয়ে অপর বন্ধু বলল,"দূর! ভদ্রলোকের আবার দুই বৌ হয় নাকি?"
খুব খুব ভাল থাকবেন বন্ধুরা। আর ঐ মেয়েটির জন্য দোয়া করুন। সে যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে তাড়াতাড়ি।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:২৭