একেবারেই অন্যরকম অভিজ্ঞতা
আমি তখন নানার বাড়ীতে থেকে একটি ক্রিশ্চিয়ান মিশনারী স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ি। সেসময় আমি একবার ভিক্ষা করেছিলাম। আজ সেই অভিজ্ঞতার কথা বলি।
আমি আমার নানীর ( আমার নানার ছোটভায়ের বৌ) সাথে নানীর বাপের বাড়ী বেড়াতে গেছি। আমি এর আগে কখনও আম্মাকে ছাড়া অচেনা কোথাও বেড়াতে যাইনি। নানী তিনদিনের জন্য এসেছেন তাঁর চাচাতো ভায়ের বিয়ে উপলক্ষে। সাথে আমি। বাড়ী ভর্তি লোক। অনেক দূর দূর থেকে আত্মীয়রা এসেছেন, আসছেন বিয়েতে। বিয়ে বাড়ীতে নাচ-গান হচ্ছে। কিন্তু আমার ভাল লাগছিল না। আমি আম্মাকে মিস করতে লাগলাম। ফিরে যাবার জন্য ছটফট করতে লাগলাম। রাতে শুয়ে অন্ধকারে ফুঁপিয়ে কাঁদলামও। নানী পড়ে গেল বিপদে। বিয়ে শেষ না হলে সে ফিরবেনা, আবার কোন লোকও পাওয়া যাচ্ছিল না, যার সাথে আমাকে ফেরত পাঠাবে।
পরের দিন বিকেলবেলা ভিক্ষা করতে এলো নানার গ্রামের দুই হিন্দু বিধবা। এঁদের আমি 'দীদা' ডাকি। এরা ভিক্ষা করে। নানীর বাপের বাড়ীও এসেছে ভিক্ষা করতে। আমি দুই দীদাকে দেখে মহাখুশী হলাম। আমি নানীকে বললাম, "নানী আমি দীদাদের সাথে চলে যাই?" নানী আপত্তি করলেন না। এক দীদার বাড়ী নানার বাড়ীর তিনটা বাড়ী পর। সুতরাং সমস্যা নেই। আমি দীদাদের সাথে রওনা দিলাম হেঁটে। দু'টা গ্রাম পর আমার নানার গ্রাম। দীদারা ভিক্ষা করতে করতে ফিরছেন। আমি তাদের পিছ পিছ যাচ্ছি। যে বাড়ীতেই যাই, সেই বাড়ীর লোকজনই হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এত সুন্দর নাদুস নুদুস বাচ্চাটা ভিক্ষুক?!!! বলা বাহুল্য - ছোটবেলায়ও আমি দেখতে বেশ সুন্দর ছিলাম। খুবই মায়াবতী মুখ। সবাই দীদাকে একই প্রশ্ন করে, "আমি কে? কেন ভিক্ষা করছি?"
এক বাড়ীর ফর্সা গৃহিণী শুকানো কুমড়ো বড়ি পাতিলে তুলছিলেন। "কত্তা মা চারটে ভিক্কে পাই" - হাঁক শুনে ঘুরে তাকালেন। দীদারা তাঁর পরিচিত। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে দীদাদের প্রশ্ন করলেন, "বৈরাগীর বুড়ি, এ মেয়ে কে?" দীদা বললেন, "আমার গ্রামের পরধানের নাতনী"। আমার নানার পদবী প্রধান। আশপাশের কয়েক গ্রামে তিনি বেশ পরিচিত মানুষ। আমি কেন তাদের সাথে, দীদা সেই ফিরিস্তি দেবার পর ক'টা বড়ি চাইলেন। মহিলা দুই দীদাকেই চালসহ গোটা বিশেক বড়ি দিলেন।
এক বাড়ীতে সুন্দরী এক নতুন বৌ, মাথায় বড় ঘোমটা দেয়া, শুকনা বড়ই ঝাঁকাতে তুলছে। আমার বড়ই খুবই পছন্দ। তাও আবার শুকনো লাল লাল বড়ই। বৌটি আমার মনের কথা বুঝতে পেরে আমার দু'হাত ভরে বড়ই দিলেন জোর করে। আমি সেই বড়ই খেতে খেতে দীদাদের পিছে পিছে আবার হাঁটতে লাগলাম।
লাঠি হাতে এক বুড়ো দাদু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "এই মেয়ে, তুমি কোন ক্লাসে পড়?" আমি মিশন স্কুলে থ্রিতে পড়ি শুনে বললেন, " বল, রহিমেরা চার ভাই - এর ইংরেজী কি হবে?" আমার উত্তর শুনে উনি ভীষণ খুশী হলেন। উনি বোধহয় ভেবেছিলেন, আমি পারবনা। দাদু ওনার মেয়েকে ডেকে কি যেন বললেন। একটু পরে মেয়ে দু'টো বড় বড় মুড়ির মোয়া এনে আমার হাতে দিলেন।
এক বাড়ীর উঠান ভর্তি মরিচ শুকাতে দেয়া আছে। দীদা সেখান থেকে মরিচ চেয়ে নিলেন। আরেক বাড়ীর উঠান ভর্তি ক্ষেত থেকে তুলে আনা পটল আর বেগুনের ছড়াছড়ি। দীদা সেসবও চেয়ে নিলেন। এভাবে প্রায় সব বাড়ী থেকেই পেঁয়াজ, রসুন, আলু,... চেয়ে চেয়ে নিলেন ভিক্ষার চাল সহ। আমি দেখলাম, কেউ 'না' বলছে না, কেউ বিরক্ত হচ্ছেনা।
ঘটনাটা আমি মাঝে মাঝেই মনে করি। এই ঘটনাটি থেকে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জাগে। যথা -
- আমাদের সময় গ্রামের সবাই ছিল আপন। একটা পরিবারের মত। ভিক্ষুককেও আমরা দীদা ডাকতাম। এখনো ডাকি। এখনকার ছেলেমেয়েরা কি ডাকে? গ্রামের মানুষের মধ্যে এমন ভাব কি এখনো আছে?
- গ্রামে ভিক্ষুকদেরও সম্মান ছিল। কেউ তাদের ফেরাতো না। খারাপ ব্যবহার করতো না। এখনও কি তেমন করে?
- আমাদের সময়ে গ্রামে হিন্দু- মুসলিম সবার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, যা সত্যি চমৎকার! সেই সৌহার্দ্যপূর্ণ ও বিশ্বস্ততার সম্পর্ক কি এখনও আছে?
- শুধু চাল নয়, প্রায় সব জিনিসই ভিক্ষুকরা গ্রামের কৃষক পরিবারের লোকেদের কাছ থেকে পেত। এখনও কি পায়?
আমার নানাবাড়ী জয়পুরহাট জেলার দোগাছি ইউনিয়নের ঘাশুরিয়া গ্রামে (পোস্টঅফিস দরগাতলাহাট)। এ গ্রামের ৬/৭ ঘর মুসলিম আর বাকী পুরো গ্রামের বাসিন্দারা হিন্দু। কিছু সাঁওতাল ও আছে। আমার নানা ছিলেন এ গ্রামের প্রধান। সারাজীবন উনি গ্রাম্য নানা সালিশে বিচার করেছেন, গ্রামের মানুষের নানা প্রয়োজনে পাশে থেকেছেন। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, যখন পুরো গ্রামে মোটে ২/৩ টা টিউবওয়েল ছিল তখন নানার বাড়ীর আশপাশের সবকটি হিন্দু বাড়ীর লোকজন নানার কলের পানি খেত, নানার পুকুরে গোসল করত (এখনো করে), ষষ্ঠী পূজার ফল নিয়ে যেত নানার বাগান থেকে।
সবচেয়ে বেশী অবাক হতাম, গ্রামের পূজা-কীর্তনের সময় ঢাকঢোল বাজিয়ে গ্রামের নারী-পুরুষ উৎসব করতো, কিন্তু নানার উঠানে কখনো আসতোনা। কি সুন্দর সহাবস্থান! গ্রামের প্রতিটা বিয়েতে নানার দাওয়াত থাকতো। নানা তাঁর পুকুরের বড় বড় কাতল মাছ তুলে দিতেন বিয়েতে রান্নার জন্য। নতুন বর-বৌ নিয়ে লোকজন আসতো নানার দোয়া নিতে। নানা নতুন বর-বৌকে দোয়া করতেন, নতুন বৌয়ের হাতে টাকা দিতেন।
নানার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিলেন যতীন বৈরাগী দাদু। তিনি নানার সাথে বর্ষার দিনে একই ছাতার তলে আধাআধি ভিজতে ভিজতে হাসিমুখে গল্প করতে করতে হাট থেকে ফিরতেন। ছোটবেলায় দাদু আমাকে মাছ ধরার খুতি বানিয়ে দিতেন। আখের জমির ভিতর দিয়ে যে নালা বয়ে গেছে, সেইখানে খুতি ফেলে রাখলে রাতে তাতে মাগুর আর টাকি মাছ পড়ত। কিডনি রোগে ভুগে দাদু মারা যাবার পর গ্রামের হিন্দুদের সাথে আমিও কেঁদেছি।
এখনো নানার বাড়ী গেলে গ্রামের লোকেরা আমাকে দেখে খুব খুশী হন , একান্ত আপনজনকে দেখলে লোকে যেমন হয়। কুশল বিনিময় করে। আমি অনেকের বাড়ীতে যাই। আমার মনে আছে, আমার সন্তান হবে শুনে এক কাকীমা বলেছিলেন, "আশীর্বাদ করি তোমার ছেলে হোক মা।" আমি অবাক হয়েছিলাম। আমার ছেলে হলেও ওনার কিছু যায় আসেনা, মেয়ে হলেও না। ওনার মেয়ের জন্য তিনি যে দোয়া করতেন, আমার জন্যও তাইই করেছেন। এরই নাম মানবতা। এখনো নানা কাজে নানার গ্রামের হিন্দু লোকজন রাজশাহী এলে আমাদের বাসায় ওঠে। আম্মা পরম যত্নে তাদের দেখাশোনা করেন। দেখে আমার ভাল লাগে।
বাংলাদেশের গ্রামগুলো কি এখনও এমন আছে?
সম্ভব হলে আর একবার দীদাদের সাথে ভিক্ষা করতে বের হতাম। দেখে আসতাম, এখনকার মানুষের মানসিকতায় কি কি পরিবর্তন হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৭ সকাল ১১:৩৮