বউদের বেতন কত হওয়া উচিত?
বাঙ্গালী নারীদের সুনাম সারা দুনিয়ায়। বধূ-মাতা-ভগ্নি-কন্যা ইত্যাদি সব রূপেই সে সমান দীপ্যমান। কিন্তু এদেশের ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তারা কতটা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত, তার প্রমাণ আমরা প্রতিনিয়ত পাই নানা গণমাধ্যমে ও গবেষণায়। এদেশে আগে ৬৪%, বর্তমানে ৮০% নারী নিজ ঘরে অতি আপন জন দ্বারা নির্যাতিত। ঘরে বাইরে নারীর প্রতি নানা সহিংসতা প্রমাণ করে তারা সমাজে কতটা অনিরাপদ। আমি আজ লিখছি নারীর আর্থিক স্বাধীনতা নিয়ে।
আমরা জানি আর্থিক স্বাবলম্বিতা নারীকে পরনির্ভরশীলতা থেকে বাঁচায়। নারী আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলে পরিবারে-সমাজে সে নিজেকে অনেকটাই নিরাপদ করতে পারে। শারীরিক-মানসিক নির্যাতন থেকে বাঁচাতে পারে। কারণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা তাদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন মেনে নেয় তাদের আর্থ-সামাজিক, মূলত আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে।
নারীকে বেশীরভাগ পুরুষ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে দেননা। প্রায় সব পরিবারে অর্থ নিয়ন্ত্রণ করেন পুরুষরা। তাই মেয়েরা সারাজীবন পরনির্ভরশীল থেকে যায়। তারা বিয়ের আগে বাবার, বিয়ের পর স্বামীর এবং স্বামীর অবর্তমানে ছেলের উপর নির্ভরশীল। মেয়েদেরকে সবসময় আর্থিক দিক থেকে বঞ্চিত করা হয়। বাবার সম্পত্তিতে অংশ বা বিধবা হলে স্বামীর সম্পত্তি ঠিকমত দেয়া হয়না। স্ত্রীধন, তালকের পর খোরপোষ - বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেয়া হ্য়না। এমনকি বাবার দেয়া যৌতুক বা সম্পদের উপরেও স্ত্রীর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। দেনমোহরটাও বেশীরভাগ সময় স্বামীরা দেননা। কেউ কেউ মোহরানা দেন। কিন্তু সেটা কোন না কোন বিনিয়োগে খাটানো হয় যা স্বামী নিয়ন্ত্রণ করেন।
স্ত্রী উপার্জন করলেও নিজের ইচ্ছামত স্বামী তা স্ত্রীকে খরচ করতে দেননা।
বেশীরভাগ স্বামীরা স্ত্রীর সম্পদ বা আয় নিজের মনে করেন এবং জোর করে নিজের করায়ত্তে রাখেন । স্ত্রীর উপার্জনে স্বামীর কোন হক নেই এবং স্ত্রী স্বেচ্ছায় না দিলে সেটা স্বামী নিতে পারেননা, এটা তাঁরা মানেননা। ফলে উপার্জনক্ষম নারীরাও নিজের আয় ইচ্ছামত ব্যয় করতে পারেন না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর নীলুফার সুলতানার এক গবেষণায় পাওয়া গেছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তাঁর বেতন তিনি নিজে তুলতে পারেন না। চেক সই করে দেন, তাঁর স্বামী টাকা তোলেন। তাঁর একাউন্টে কত টাকা আছে তা তিনি জানেন না। টাকা দিতে না চাইলে...। এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, আমরা কোথায় আছি?
নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। বেশীরভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নানাভাবে স্ত্রীদের নির্যাতন করে যৌতুকের জন্য। এসব স্বামীরা স্ত্রীর হাতে টাকা তো দেয়ইনা, উপরন্তু স্ত্রীর বাপের দেয়া অর্থ-সম্পদও কেড়ে নেয়।
সব নারী আয় করেননা। আবার বাংলাদেশের বেশীরভাগ পরিবার স্বচ্ছলও নয়। বাবা আয় করেন বলে তিনি তাঁর যেকোন প্রয়োজন সহজেই মেটাতে পারেন। ছেলেমেয়েদের প্রয়োজন মেটানো হয় সবার আগে। বাদ পড়ে থাকেন শুধু মা। তাঁর প্রয়োজনটা সেভাবে গুরুত্ব পায়না। ভাত-কাপড় বা বাজার খরচের টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়েই শেষ। তাঁর আর কোন প্রয়োজনকে আমলে নেয়া হয়না।
অথচ সব মানুষের নিজস্ব কিছু প্রয়োজন থাকে, নারীরও। কেউ দান করতে ভালবাসে, কেউ প্রিয়জনকে বিপদে সাহায্য করতে চায়, কেউ নানা উৎসব- অনুষ্ঠানে পছন্দের মানুষকে উপহার দিতে চায়। কেউ বা চায় প্রতিমাসে ভাইবোনের পড়াশোনা বা মাবাবার অষুধ কেনার টাকা পাঠাতে। কখনও চিকিৎসাখরচ, বিয়ে, মৃত বাবামার জন্য দান-খয়রাত বা এরকম কোন দরকারে টাকার খুব দরকার হয়। সবসময় বেকার নারীরা স্বামীর কাছে এসব প্রয়োজনে টাকা চাইতে পারেননা। চাইলেও দেবার মানসিকতা সব স্বামীর থাকেনা।
অনেক শিক্ষিত-স্বচ্ছল পরিবারে বেকার স্ত্রীদের কোন হাতখরচ দেয়া হয়না, দেয়ার প্রয়োজনও বোধ করা হয়না (অস্বচ্ছন্দ পরিবারের কথা বাদ দিলাম)। ফলে তারা সংসার খরচের টাকা থেকে চুরি করেন বা করতে বাধ্য হন। বেশীরভাগ সময়ে স্বামীকে মিথ্যে কথা বলে সঞ্চয় করেন বা মিথ্যে হিসাব দেন। এভাবে টাকা বাঁচিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটান বা জমান। আমার এক ভাবীকে দেখতাম, বাজার খরচের টাকা হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই কিছু টাকা সরিয়ে রাখতো প্রতি মাসে। আবার দেখতাম, দু'হাজার টাকার শাড়ী কিনে এনে বলতো, সাতাশ শ'। জিজ্ঞেস করলে বলতো, "এভাবে না জমালে টাকা পাব কৈ?" চুরি করে হলেও নারীরা সঞ্চয় করেন। কারণ তাঁরা জানেন, স্বামীর অবর্তমানে আর্থিক সঙ্গতি না থাকলে তাঁদের অবস্থা কতটা নাজুক হয়।
কিছু মহান স্বামী স্ত্রীদের হাতে টাকা দেন বটে। তবে তার পাই-পয়সা হিসাব নেন। ফলে বউদের কোন লাভ হয়না। মেয়েদের এমন কিছু প্রয়োজন থাকে যার জন্য স্বামীর কাছে টাকা চাওয়াটা মোটেই সম্মানজনক নয়। যেমন, কোন অভাবগ্রস্ত নিকটাত্মীয়কে অর্থ সাহায্য করা। নিঃসন্দেহে স্বামীরা সংসার চালানোর জন্য পরিশ্রম করে টাকা আয় করেন। বউরাও সংসারের জন্য রোজ কম কষ্ট করেন না। সংসারে একজন স্ত্রী ( বেকার বা সকার) রোজ যে কাজগুলো করেন, তা অর্থের বিনিময়ে করাতে হলে স্বামীরা বুঝতে পারতেন, স্ত্রীর বেতন কত হওয়া উচিত বা প্রতি মাসে স্ত্রীকে কত টাকা হাতখরচ দেয়া ন্যায্য।
এর বিপরীত চিত্রও আছে। অনেক রাজনীতিবিদ, ঘুষখোর অফিসার-কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ, ব্যবসায়ীরা নানা কারণে স্ত্রীদের নামে টাকা, সম্পদ দেন। অনেক অসাধারণ স্বামী আছেন যাঁরা বাড়ী, গাড়ী, টাকা স্ত্রীর নামে রাখেন। তবে বেশীরভাগ পুরুষ স্ত্রীর টাকা বা সম্পদকে নিজের মনে করে করায়ত্ব করতে চান। স্ত্রীকে তার সম্পদ-অর্থ স্বামীর হাতে তুলে দিতে বাধ্য করেন।ফলে টাকা থাকলেও অনেক মেয়ে সারাজীবন পরনির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হন। পরহস্তে ধন যে কোন কাজে লাগেনা, তা আমরা সবাই জানি। অর্থ না থাকলে কেমন লাগে, তা মাসের শেষদিকে সব পুরুষই টের পান। তবু বেশীরভাগ স্বামীরা স্ত্রীদের হাতে টাকা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননা, অপচয় মনে করেন।
তাই স্বামীদের বলছি, আপনারা স্ত্রীদের প্রয়োজন ও অসুবিধা অনুভব করুন। আপনার সাধ্য অনুযায়ী কিছু টাকা প্রতিমাসে আপনার স্ত্রীকে দিন এবং এ টাকার হিসেব কখনও চাইবেননা। স্ত্রী আয় করলে তার টাকা জোর করে কেড়ে নেবেন না। তাকে বিশ্বাস করুন, ভালবাসুন। সংসারের প্রতি আপনার চেয়ে তার টান কোন অংশে কম নয়। সে নিশ্চয় নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে বাকী টাকা আপনার সংসারের জন্যই ব্যয় করবে।
আর উপার্জনকারী নারীদের বলছি, আল্লাহ আপনাকে সামর্থ্য দিয়েছেন, যাতে আপনি আপনার আয় থেকে অভাবী কাউকে সাহায্য করতে পারেন। কিছুটা সঞ্চয়ও করুন, কিছুটা সংসারের জন্যও খরচ করুন। তবে কোনমতেই আপনার কষ্টার্জিত সব টাকা স্বামীকে দেবেন না। কারণ স্ত্রীর আয়ে স্বামীর কোন হক নেই এবং আপনি জানেন না ভবিষ্যতে আপনার অবস্থা কি হবে।
আর ভাগ্যবতী মেয়েদের (যাদের স্বামীরা আপনার আয় নেননা বা বেকার স্ত্রীদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত টাকা দেন) বলছি - আপনারাও দান করার ও প্রয়োজন মেটানোর পর কিছু টাকা সঞ্চয় করুন। কারণ কে বলতে পারে, হয়ত ভবিষ্যতে আপনার সঞ্চয়ই আপনার ও আপনার স্বামীর বা সন্তানের কাজে লাগতে পারে। কিছুদিন আগে ফেসবুকে পড়লাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক এখন বৃদ্ধাশ্রমে। হায়রে জীবন!!!
বন্ধুরা, রোজার মাসে বেশী বেশী দান করুন। ভাল থাকুন। আপনার প্রিয়জন ও আশপাশের মানুষগুলোকেও সাধ্যমত ভাল রাখুন। সবাইকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৭ সকাল ৯:৪৬