হুমায়ূন আহমেদের থাপ্পড়
দুপুরবেলা ভার্সিটি থেকে ফিরেছি। প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে। আমি বাসায় ঢুকেই গুলতেকিনকে টেবিলে খাবার দিতে বললাম। খেতে বসে দেখি - সাদা ভাত, বেশী করে পেঁয়াজ দিয়ে ছোট মাছের ভাজি, করলা ভাজা, মশুরের ঘন ডাল, গলদা চিংড়ি ভুনা আর মুরগির ঝোল। সাথে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ আর লেবু। সবই আমার পছন্দের খাবার। খুশী মনে খেতে বসতেই আমার ছোট মেয়ে বিপাশা গম্ভীর মুখে বলল, "বাবা, ফজলু মিয়াকে থাপ্পড় মারা তোমার ঠিক হয়নি।"
আমি রোজ রাতে যা লিখি, সেগুলো ডাইনিং টেবিলের পাশে ডিপ ফ্রিজের উপর পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেয়া থাকে। সকালে স্কুলে যাবার আগে সেগুলো পড়ার পর আমার তিন মেয়ে স্কুলে যায়। আমি এখন "গাতক ফজলু" নামের যে গল্পটি লিখছি, তাতে ফজলু মিয়া মূল চরিত্র। ফজলু মিয়া একজন বাউল। আধপাগলা টাইপের মানুষ। সে একা থাকে। কঠিণ রোগে ভুগে বিনা চিকিৎসায় তার অল্পবয়সী সুন্দরী স্ত্রী মারা যাবার পর সংসারে তার মন নেই। নিঃসন্তান ফজলু গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ায়, গান গায়। মাঝে মাঝে এক-দেড় মাসের জন্য বাড়ী ছেড়ে উধাও হয়ে যায়। আবার আসে। বাপ-দাদার ভিটেতে তার ভাঙ্গাচোরা দু'টো ঘর আছে। তার একটাতে সে থাকে। অন্যটাতে সে নিজেই রান্না করে খায়। তার এই ভিটেমাটির প্রতি চোখ পড়েছে গ্রামের দুষ্টু চেয়ারম্যান জব্বার মোল্লার। জব্বারের লোকেরা ফজলুকে তাড়াবার জন্য গভীর রাতে তার বাড়ীর মধ্যে ঢিল মারে, ভূতের মত বিকট গলায় শব্দ করে। তাতে কোন কাজ হয়নি। সম্প্রতি ফজলু জব্বার মোল্লাকে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্বক গান রচনা করেছে। সেই অপরাধে জব্বার ফজলুকে গ্রামের লোকেদের সামনে থাপ্পড় মারে।
গতরাতে এই থাপ্পড় মারার অংশটি আমি লিখেছি। আমার মেয়ের সেটি পছন্দ হয়নি। সে ক্লাস ফোরে পড়ে। কিন্তু সেইই আমার লেখার সবচেয়ে বড় সমালোচক। সে গান ভালবাসে। ফজলু গাতক। তাই তার প্রতি আমার মেয়ের বিশেষ দূর্বলতা তৈরী হয়েছে। তার উপর ফজলুর বয়স ষাটের ঊর্ধে। এমন মানুষকে কেউ থাপ্পড় মারবে - এটা সে মেনে নিতে পারছে না। আমি অপরাধীর মত বললাম, "দ্যাখ মা, ক্ষমতাবানরা সবসময় ক্ষমতাহীনদের সাথে এমন আচরণই করে।"
গুলতেকিন মহাবিরক্ত হচ্ছে। দুপুরের প্রচণ্ড গরমে ঘেমে সে এতকিছু রান্না করেছে। খাওয়া ফেলে এই থাপ্পড় বিষয়ক আলোচনা তার মোটেই পছন্দ হচ্ছেনা। খাবার ঠাণ্ডা হচ্ছে। আমি আবার ঠাণ্ডা খাবার খেতে পারিনা। আমি না খেলে সেও খেতে পারছেনা। বড় মেয়ে নোভার তাড়া আছে। সে খেয়ে টিউশনিতে যাবে। শিলা বিপাশাকে চোখের ঈশারায় ধমক দিল। নুহাশের গলদা চিংড়ি খুবই প্রিয়। সে এসব ফালতু আলোচনায় কান না দিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। বিপাশা বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, "বাবা, ক্ষমতাবান কি?"
গুলতেকিন দেখল, আলোচনা আরো দীর্ঘ হবে। তাই সে কড়া গলায় শাসনের সুরে আমাকে বলল, "আগে খাও। থাপ্পড় পরে মেরো।" ক্ষমতাবানের ধমকে আমাদের আলোচনা থেমে গেল। আমি ভাল করে খেতে পারলাম না। চোখের সামনে ফজলু মিয়ার অপমানিত করুণ মুখটা ভাসতে লাগলো। খাওয়া শেষে সিগারেট হাতে বারান্দায় বসে ভাবতে লাগলাম - কি করা যায়? থাপ্পড় বাদ দেব? থাপ্পড়ের জন্যই ফজলু মিয়ার প্রতি পাঠকের সহমর্মিতা তৈরী হবে। জব্বার মোল্লাকে ঘৃণা করবে। পাঠক চাইবে জব্বর মোল্লার সাজা হোক। এভাবে গল্প পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে।
অন্যদিকে কাহিনী না বদলালে বই ছাপার পর ছোট মেয়ে দেখে মন খারাপ করবে যে, তার বাবা তার কথা শোনেনি। তারচেয়েও বড় সমস্যা হল - সকালে অন্যপ্রকাশের সত্বাধিকারী মাজহার এসে লেখাগুলো নিয়ে গেছে টাইপ করতে। সামনে বইমেলা। হাতে সময় কম। আমি মাজহারকে ফোন করে ডাকলাম। সাথে অবশ্যই আজকের লেখাগুলো নিয়ে আসতে বললাম।
মাজহার আসার পর বললাম, "লেখাগুলো থাক। আমি আরেকটু ভেবে লিখব।" মাজহার হতাশ চোখে আমার দিকে তাকালো। এর আগেও আমি এমন পাগলামো অনেকবার করেছি। শেষ মুহূর্তে চরিত্রের নাম, ঘটনা, গল্পের পরিণতি বদলে দিয়েছি। মাজহারকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম, "তুমি চিন্তা করোনা। আমি খুব বেশী সময় নেবনা।"
রাতে আবার লিখতে বসলাম। অনেক ভাবার পর থাপ্পড়ের জায়গায় "শুয়োরের বাচ্চা" বসালাম। এই প্রথম লেখক হুমায়ূন বাবা হুমায়ূনের কাছে হেরে গেল। পরাজয়ের আনন্দে তার মন ভরে গেল। তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো - নতুন বই হাতে নিয়ে তার পরীর মত মেয়ে নাচছে.......!!!!!
হুমায়ূন আহমেদের স্টাইলে লেখার চেষ্টা করেছি। অনেকটা কৌতুহল থেকে। উনি লিখলে কি এভাবে লিখতেন? সরি স্যার। আপনাকে খাটো করার জন্য লিখিনি। মিস ইউ। আপনি থাকলে বাংলাদেশ আরও অনেক কিছু পেত। যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন - এই কামনা সবসময়।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৭ রাত ১১:৩৯