প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
প্রারম্ভিকাঃ
যদিও সিরিজটি খনার বচন এবং কৃষি ঐতিহ্য নিয়ে কিন্তু এই পর্বে একটু ভিন্ন দিকে অর্থাৎ খনার বচনে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব।
নামের উৎপত্তিগত দিক থেকে প্রাচীন বাংলায়া চৈনিকদের অবদানের কথা কিছুটা অনুমান করা গেলেও প্রাচীন বাংলার চিকিৎসা ব্যবস্থাতে চৈনিকদের অবদান বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়না। প্রাচীন বেদে বর্ণিত আয়ুর্বেদ(আয়ু বিজ্ঞান) ই অত্র অঞ্চলের চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রাচীনতম নিদর্শন। তবে বেদের হাত ধরে এদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থার ইতিহাস পাওয়া গেলেও এটা ধরে নেয়ার কোন কারণ নেই যে আর্যরাই অত্র অঞ্চলে চিকিৎসা ও গণ স্বাস্থ্য পদ্ধতির গোরাপত্তন করে। কেননা, আর্যদের আগমনের অনেক পূর্বে গঠিত মহেঞ্জদারো সভ্যতায় আমরা পরিকল্পিত স্বাস্থ্য সম্মত নগর ব্যবস্থা দেখতে পাই। তাছাড়া পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতের আর্য বিরোধী চার্বাক মতাদর্শের অনুসারীদের আলোচনাতেই আমরা প্রথম দেখতে পাই যে মানব শরীর পৃথিবীর জড় পদার্থের সমন্বয়েই গঠিত। বস্তু জগত ভিন্ন অন্য কিছুর উপাদান মানব শরীরে অনুপস্থিত। এর থেকেও ধরে নেয়া যায়, চার্বাকদের শরীর গঠন সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল। মুসলমাদের প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত আয়ুর্বেদই ছিল এখানকার একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি। পরবর্তীতে দ্বাদশ শতকের দিকে মুসলমানদের হাত ধরে আসে ইউনানী(গ্রীক) চিকিৎসা পদ্ধতি। যার চিকিৎসকগণ হেকিম নামে পরিচিত ছিল। এবং সবশেষে ইংরেজদের হাত ধরে আসে এলোপ্যাথি।
আয়ুর্বেদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে-
View this link
View this link
বাংলায় পড়তে- View this link
খনার বচনে স্বাস্থ্য সুরক্ষাঃ
খিস্টপুর্ব ৮০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের স্বর্ণযুগ বলা হয়। সম্ভবত এই স্বর্ণযুগের শেষের দিকে এসে বা পরবর্তী সময়ের থেকে খনার বচন দেশব্যাপি পরিচিতি লাভ করে। এখানে বলে নেয়া ভালো যে এর প্রায় সবই অনিশ্চিত ইতিহাসের পর্যালোচনা। প্রসঙ্গত, খনার বচনে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে যেসব প্রবচন রয়েছে তার কোনটাই কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ নয় বরং এর সবই বিজ্ঞান সম্মত এবং যৌক্তিক। সেগুলো ঝাড়-ফুক, তাবিজ -কবজ ইত্যাদি অতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ এবং সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে উঠা একটি বিজ্ঞান সম্মত উপায় যার উপযোগীতা আজো সমানভাবে সাদরে গৃহীত। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে খনার বচন রোগের চিকিৎসা মূলক কোন পদ্ধতি নয় বরং রোগ প্রতিরোধের উপায় মুলক। এসব প্রবচন মানুষের রোগ প্রতিরোধের পদ্ধতি, দীর্ঘায়ু, দৈহিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য লাভের কৌশল মুলক। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সুনিয়ন্ত্রিত এবং সুনির্বাচিত আহার এবং আদর্শ জীবন ব্যবস্থাই হচ্ছে সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু লাভের চাবিকাঠি।
নিচে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে কয়েকটি খনার বচন জেনে নেই-
জর ভিটায় তুলে ঘর, সে আসে তারই জর।
অর্থঃ অপরিচ্ছন স্যাতসেতে জায়গায় ঘর করলে সে ঘরে অসুখ বিসুখ লেগেই থাকে।
পীড়ে উঁচু মেঝে খাল, তার দুঃখ চিরকাল।
অর্থঃ ঘরের মেঝে চারদিকের ভিটির চাইতে নিচু হলে সে ঘর স্বাস্থ্য সম্মত নয়।
আলো হাওয়া বেঁধ না, রোগ ভোগে মরো না।
অর্থঃ বদ্ধ ঘর স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
পুবে হাঁস পশ্চিমে বাঁশ
উত্তরে বেড়ে(কলা) দক্ষিনে ছেড়ে
ঘর করগে পুতা জুড়ে।
অর্থঃ হাস মুরগীর খামার বাড়ীর পুব দিকে রাখতে হয় আর বাঁশ ঝাড় পশ্চিমে করতে হয় কলা বাগান উত্তরে এবং দক্ষিণ দিক খোলা রাখতে হয়।
দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের রাজা, পুব দুয়ারী তাহার প্রজা
পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই, উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই।
অর্থঃ স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে দক্ষিণ দুয়ারী ঘর সবচে বেশী ভালো তারপর হচ্ছে পুব দুয়ারী ঘর। পশ্চিম দুয়ারী এবং উত্তর দুয়ারী ঘর ভালোনা।
নিম নিসিন্দা যথা, মানুষ কি মরে তথা।
অর্থঃ নিম নিসিন্দা গাছ বাড়ীর জন্য অত্যন্ত ভালো।
বক বকুল চাপা, তিন পুতোনা বাপা।
অর্থঃ বক বকুল চাপা এই তিনটি গাছ একত্রে বুনতে নেই।
উনা ভাতে দুনা বল, অতি ভাতে রসাতল।
অর্থঃ অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
অধিক খেতে করে আশ, এর নাম বুদ্ধি নাশ।
অর্থঃ মাত্রারিক্ত খেলে বুদ্ধিনাশ ঘটে।
আঁতে তিতা দাঁতে নুন, উদর ভরো তিন কোন।
অর্থঃ পাকস্থলির চার ভাগের এক ভাগ খালি রেখে খেতে হয়।
বারো মাসে বারো ফল, না খেলে যায় রসাতল।
অর্থঃ সব মৌসুমেই কিছু কিছু মৌসুমি ফল খেতে হয়।
জল খেয়ে ফল খায়, যম বলে আয় আয়।
অর্থঃ জল খেয়ে ফল খেতে নেই।
বেল খেয়ে খায় জল, জির(কৃমি) যায় রসাতল।
অর্থঃ বেল খেয়ে জল পান করলে কৃমি নাশ হয়।
খালি পেটে কুল, ভরা পেটে মূল।
অর্থঃ কুল খালি পেটে আর মূলা ভরা পেটে খাওয়া ভালো।
খেতে বসলে কিসের দায়, পাকনা ধান কি জলে যায়।
অর্থঃ নিশ্চিন্ত মনে আহার করা উচিত।
খানা খায় করে শব্দ, অলক্ষী খুশী লক্ষী জব্দ।
অর্থঃ নিরবে খাদ্যগ্রহন করতে হয়।
তপ্ত অম্ল ঠান্ডা দুধ,
যে খায় সে নির্বোধ।
অর্থঃ ঠান্ডা দুধ স্বাস্থ্যে জন্য ক্ষতিকর। (এখানে অম্ল বলতে ঠিক কোন খাদ্য বোঝানো হয়েছে সেটা নিশ্চিত নই)
খেয়ে উদাইম্যা ভাত, শইল করে উৎপাত।
অর্থঃ শারীরিক পরিশ্রম না করলে খাদ্য হজম হয় না।
দুগ্ধ শ্রম গাংগা বারি, এ তিন উপকারী।
অর্থঃ দুধ, শারীরিক শ্রম এবং স্রোতস্বিনী নদী স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
ভোরের হাওয়া লাখ টাকার দাওয়া।
অর্থঃ লাখ টাকার ঔষুধের চাইতে ভোরের হাওয়া উপকারী।
শাক অম্বল পান্তা, তিনো অসুখের হন্তা।
অর্থঃ অসুখ হলে শাক অম্বল এবং পান্তা খেতে নেই।
ঘোল কুল কলা, তিনে নাশ গলা।
অর্থঃ গলার অসুখ হলে ঘোল কুল ও কলা খেতে নেই।
মাংশে মাংশ বৃদ্ধি, ঘৃতে বৃদ্ধি বল
দুগ্ধে বীর্য বৃদ্ধি, শাকে বৃদ্ধি মল।
অর্থঃ মাংশ খেলে মাংশ বাড়ে, ঘিয়ে শক্তি বাড়ে, দুধে বীর্য বাড়ে এবং শাক খেলে মল বৃদ্ধি হয়।
তেল তামাকে পিত্ত নাশ,
যদি হয় তা বারো মাস।
অর্থঃ সারা বছর তৈলাক্ত খাবার এবং তামাক সেবন করলে পিত্তের প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়।
আহারান্তে চোখে জল, দৃষ্টি শক্তির বাড়ে বল।
অর্থঃ খাবার পর চোখে জল ছিটানো চোখের জন্য ভালো।
সকালে সোনা, বিকালে লোনা।
অর্থঃ সকালের গোসল উত্তম আর বিকেলে গোসল করলে ত্বক মলিন হয়ে যায়।
প্রভাত কালে উঠে যে খাবে ঠান্ডা জল,
তাহার ঘরে বদ্যি না যাবে কোন কাল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠান্ডা পানি পান করতে হয়।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে খনার বচন ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ এসব থেকে স্বতন্ত্র। খনার বচন হচ্ছে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও অভিজ্ঞতা লব্ধ বাস্তব সম্মত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন। আধুনিক চিকিৎসার ব্যায় বাহুল্য এবং জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় হারিয়ে যাওয়া এসব বচনাদি গ্রামাঞ্চলে সঠিক ভাবে প্রচার করে পালনে উৎসাহিত করলে একটি স্বাস্থ্য সম্মত গ্রাম্য সমাজ অতি সহজে এবং প্রায় বিনা খরচায় গড়ে তোলা সম্ভব। এখানে উল্লেখ্য, আধুনিক চিকিৎসার জটিলতার কারণে উন্নত বিশ্বে এইসব প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি এবং প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে জোর দিচ্ছে। আশাকরি, যথাযথ কতৃপক্ষ এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে গ্রামগঞ্জে এর প্রায়োগিক সম্ভবনা খতিয়ে দেখবেন।
( চলবে, , , , , , )