২.
এক প্রাইমারি স্কুলের মাঠে মুখোমুখি আমি একজন মহিলার। একজন ছেলে তার মায়ের। তখন ক্লাশ ওয়ানে পড়ি আমি। ক্লাশ ওয়ান পড়ুয়া আমি প্রচন্ড জেদে ফেটে যাচ্ছি ভিতরে ভিতরে। সামনে দাঁড়ানো মহিলাটিকে আমি জ্ঞান হবার পর থেকে বুঝতে যখন শিখেছি, তখন থেকেই কেন জানি ঘৃণা করে আসছি। যদিও এই পৃথিবীতে কেবল এই মা-ই আমার একমাত্র আপনজন। আমার যখন এক বছর বয়স, তখন বাবা অন্য এক মহিলার প্রেমে পড়ে মাকে ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকে মা আজ পর্যন্ত আমাকে আগলে রেখেছেন। আমরা যে বস্তিতে থাকি, আমার স্কুল সেখান থেকে একটু সামনে। বাবা মাকে ছেড়ে চলে যাবার পর, মা এই স্কুলের বোর্ডিং এ থাকা শিক্ষক এবং ছাত্রদের জন্য রান্না করে দেবার কাজ শুরু করেন।
মায়ের একটি চোখ নেই। এজন্য সবাই আমাকে কানার ছেলে বলে ডাকে। সেজন্যই মাকে আমি ঘৃণা করে। কেবল এই একটি সম্বোধনের জন্যই পৃথিবীর সব থেকে প্রিয় মানুষটি আমার কাছে সব চেয়ে ঘৃন্য মানুষে পরিণত হয়েছে।
মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আমার গত দিনের কথা মনে পড়ে। গতকাল ছিল প্যারেন্টস ডে। সবার বাবা-মায়েরা স্কুলে এসেছিলেন। কত আনন্দ। কিন্তু আমি সারাটিক্ষণ আল্লাহ আল্লাহ করেছি, মা যেন এখানে না আসেন। কিন্তু আল্লাহ আমার বাবু মনের প্রার্থনা কেন জানি শুনলেন না। মা এলেন। অন্যদের পাশে গিয়ে বসলেন। একটা ঘোরের মধ্যে সময়গুলি কিভাবে যেন কেটে গেল।
অন্যদের সাথে মা চলে গেলে সেদিন খেলার মাঠে বন্ধুদের একজন বললো, ’এ্যাই, তোর মায়ের এক চোখ নাই। তুই কানা বগীর ছা।‘ তার সাথে অন্যরাও তাল দেয়। সবাই আমাকে ঘিরে গোল হয়ে বলতে থাকে, ‘কানা বগীর ছা’ ‘কানা বগির ছা’। সেই সময়টায় আমার মনে হচ্ছিল মাটি ফাঁক হয়ে যাক। আমি যদি এই মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম! একই সাথে মনে এটাও জাগল, ‘মা কেন অদৃশ্য হয়ে যায় না আমার জীবন থেকে?’
আজ স্কুল মাঠে একা মাকে সামনে পেয়ে সব কিছু মনে পড়ে যায়। একটা নিস্ফল ক্রোধ আমার বাবু মনের এপিঠ-ওপিঠ ঘুরে ঘুরে পাক খেতে থাকে। মায়ের একমাত্র চোখের দিকে তাকিয়ে আমি হিসহিস করে বলি, ‘তুমি সবার সামনে আমাকে জোকার বানাও কেন? তোমাকে দেখে সবাই হাসে... বুঝ না তুমি? কেন আস আমার স্কুলে? তুমি মরতে পার না?’
মা চুপচাপ সব শুনলেন। কিছু বললেন না। দীর্ঘশ্বাসও ফেললেন না কিংবা গোপনও করলেন না। শুধু এক চোখে হৃদয়ের সকল মমতাটুকু এনে আমাকে ছুঁয়ে গেলেন! আমি প্রচন্ড রেগে ছিলাম, তাই এইমাত্র মাকে কি বললাম, সেটা আমার বাবু মনের অনুভবে এলো না।
সেদিন থেকে আমার ভেতরে একটা জেদ চাপে। আমি মায়ের জীবন থেকে, যেখানে মাকে সবাই চেনে-জানে, সেই এলাকা থেকে এমনকি মায়ের সাথে যে ঘরটিতে আমি থাকি, সেখান থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাইলাম। একটা তাড়না আমাকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কঠোর অধ্যবসায়ে নিমজ্জিত করায়। পড়ালেখা ছাড়া আর কোনো দিকে আমার মনযোগ থাকে না। আর এই সবকিছু কেবলি একজন এক চোখা মা’র ছেলে হিসেবে নিজেকে দেখাতে না চাওয়ার জন্যই.. কারো কাছ থেকে ‘কানা বগীর ছা’ সম্বোধন যাতে না শুনতে হয় সেজন্যই করি আমি।
পরবর্তী বছরগুলিতে মায়ের সাথে থেকেও যেন একজন ‘আউটসাইডারে’ পরিণত হই আমি। এভাবে স্কুলের গন্ডী পার করে কলেজে পা রাখি। সেখানে অসাধারণ রেজাল্ট করার কারণে স্কলারশিপ পাই। দেশের বাইরে এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে যাবার দিনটিও একদিন এসে যায়। যাবার দিনেও সেই একচোখা মহিলা আমার পিছু ছাড়েনি। বিমানবন্দরে বিদায় দিতে এসে এক পাশে অন্যদের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি একবারও তার দিকে ফিরে তাকালাম না। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মৃদু স্বরে কথা বলতে বলতে একসময় ডিপারচার লাউঞ্জে ঢুকে গেলাম সেই মহিলার সামনে দিয়ে।
একজন মা বিমানবন্দরে একজন অচ্ছুৎ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ! তাঁকে সচকিত করে যখন বোয়িং ৭৪৭ রানওয়ে ত্যাগ করে, তখনো তার সম্বিত ফিরে না। একজন মা যখন সন্তানের কাছে সামান্য একটি অঙ্গহানির কারণে মায়ের দরজা হারিয়ে ফেলেন, তখন আক্ষরিক অর্থে একজন মা কি আসলেই মা থাকেন?
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
# আগের পর্বের লিংকঃ Click This Link
★ মামুনের ছোটগল্প
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩৫