প্রথমেই বলি আমি বাঙ্গালী না, ভাল বাংলা বলতে পারিনা। যশোরে আমার এক বন্ধু আছে, যে আমাকে প্রায়ই বলে আমি বাঙ্গালী হয়ে, বাংলাদেশী হয়ে কেন ভাল বাংলা বলতে পারিনা।
আমি বলি, আমি বাংলাদেশী বটে কিন্তু বাঙ্গালী না। আমার মাতৃভাষা বাংলা না। আমার মাতৃভাষা সিলেটী। সিলেটি ভাষা কোন আঞ্চলিক বা উপভাষা নয় ব্যাপারটা অনেকে বুঝতে চায়না বা বুঝেনা। এমনকি অনেকে বিশ্বাসও করেনা। কারণ, এব্যাপারে যথেষ্ট গ্যাপ রয়ে গেছে। ব্যাপারটা নিয়ে উল্লেখযোগ্য একাডেমিক পর্যালোচনাও হয়নি। তাই সহজে কাউকে দোষারোপ করাও যায়না। এমনকি আমাদের সিলেটি লোকজনেরও এব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য ও জ্ঞানের অভাব রয়েছে।
আজকে আমরা সিলেট তথা বৃহত্তর সিলেট বলতে বাংলাদেশের প্রশাসনিক অঞ্চল "সিলেট বিভাগ" এর অধীনস্থ সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এই চারটি (০৪) জেলাকেই বুঝি। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের এই চারটি জেলা সহ বরাক উপত্যকার বিস্তির্ন জনভূমি নিয়েই বৃহত্তর সিলেট গঠিত ছিলো। আর সিলেটি ভাষা আজকের ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর, করিমগঞ্জ, কাছাঢ়, হাইলাকান্দি, মনিপুর রাজ্যের জিরিবাম এবং বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সিলেটের পার্শ্ববর্তী আরো কয়েকটি জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। এখনো বরাক উপত্যকার প্রায় সকল মানুষই সিলেটি ভাষায় কথা বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ২০ মিলিয়ন (২ কোটি) লোক এই সিলেটি ভাষায় কথা বলে।
সিলেট নৃতাত্ত্বিক, ভৌগলিক এবং ঐতিহাসিকভাবে আসামের অংশ ছিলো, ভাষাগত দৃষ্টিকোণ থেকেও সিলেটী এবং অসমীয়া একই ঘরানার। সিলেট ভৌগোলিক ভাবে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাথে সম্পৃক্ত হবার ইতিহাস খুবই সাম্প্রতিক। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময়ই রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সিলেট পাকিস্তানের সাথে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত হয়। অর্থাৎ রাজনৈতিক কারনে সিলেট তার ভৌগোলিক পরিচয় হারিয়ে বিলিন হয়ে যায় পূর্বতন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি তথা পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের সাথে।
তাই বলে কি সিলেটি লোকজনও বাঙ্গালী হয়ে গেলো? সিলেটের নিজস্ব কৃষ্টি কালচার ও সংস্কৃতি তাও হারিয়ে গেলো?
বিশ্বায়নের এই যুগে পরিবর্তনের হাওয়া লাগলেও সিলেটি সংস্কৃতি এখনো অম্লান, সিলেটি ভাষায় অনেকের অস্বস্তি থাকলেও এখনো ঠিকে আছে সিলেটি ভাষা। সিলেটি ভাষার লিখিত রুপ, নাগরি হরফে পঠন-পাঠনের ব্যাপক প্রচলনের জন্য সামাজিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। আমরা চাই নাগরি হরফে সিলেটি ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। চাকমা জন গোষ্ঠী তাদের ভাষার স্বীকৃতি পায়, তাদের ছেলে সন্তান তাদের ভাষায় প্রাথমিক স্থরে সরকারি বই পায়। আমরা এটাকে সাধুবাদ জানাই। সিলেটি ভাষাকেও একই ভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হোক। আমাদের অনাগত প্রজন্ম প্রাথমিক স্থরে সিলেটি ভাষায় যেন প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে সেই ব্যবস্থা করা হোক।
সিলেটের পথে পথে, স্থানে স্থানে আসাম সংশ্লিষ্ট অনেক কিছুই এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেটা ক'জনেরই বা নজরে আসে!
সিলেটের ট্রেডমার্ক হলো ঐতিহাসিক ক্বীন ব্রিজ, এটা চালু করেছিলেন আসাম প্রেসিডেন্সির গভর্নর উইলিয়াম ক্বীন, তার নামেই আজও পরিচিত এই ব্রিজটি ক্বীন ব্রিজ নামে। ঐতিহ্যবাহী এম,সি কলেজ, সিলেট এর বর্তমান শিক্ষক মিলনায়তন ভবন এর গোড়াপত্তন করেছিলেন আসাম প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী। আমরা ক'জনই বা এসব খবর রাখি।
আমার আজকের এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য এই নয় যে, সিলেটিদের অসমীয়া প্রমাণ করা।
আমার উদ্দেশ্য সিলেটিরা বাঙ্গালী নয়, এটাই প্রমাণ করা, এবং সিলেটি ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা ধরে রাখার জন্য উৎসাহিত করা। সিলেটি একটি জাতির নাম তা স্মরণ করে দেয়া।
জানা যায়, "সিলেট নগরের বন্দর বাজারস্থ ইসলামিয়া প্রেস থেকে নাগরি পুঁথি প্রকাশিত হতো। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালিয়ে প্রেসটি ধ্বংস করে দেয়। এরপর থেকে নাগরি লিপির পুঁথি প্রকাশ ও চর্চা পুরোপুরিই বিলুপ্ত হয়ে যায়।"
বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য ছিলো ভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা রক্ষা করা। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী হয়েই গেলো প্রায়, বাংলা একাডেমী কি আমাদের অর্থাৎ সিলেটি ভাষার স্বকীয়তা রক্ষায় কোন ভূমিকা পালন করছে? সিলেটি ভাষার স্বকীয়তা ও সৌন্দর্য রক্ষায় বাংলা একাডেমির দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ দেখছিনা। আমি আশা করি অচিরেই বাংলা একাডেমি সিলেটি ভাষার সৌন্দর্য ও স্বকীয়তা রক্ষায় যথাযথ উদ্যোগ নিবে।
এব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশন এর মেয়র মহোদয়কে একটি ধন্যবাদ দিতেই হয়। সিলেট কোর্ট পয়েন্ট এ একটি স্থম্ভ স্থাপন করে নাগরি হরফ তথা সিলেটি বর্ণে সাজিয়েছেন এবং ঐতিহাসিক এই কোর্ট পয়েন্টকে "নাগরি চত্বর" নাম দিয়েছেন, যা অবশ্যই আশা জাগানিয়া এবং সাধুবাদ পাবার যোগ্য।
বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, বার্মিংহাম, ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, মনিপুর রাজ্যের জিরিবাম সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নাগরি পূনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান আছে।
আমি আশাকরি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হবে, সিলেটি ভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবে তালিকাভুক্ত হবে। কেননা, যে বাংলাদেশ বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ভীতের উপর দাড়িয়ে আছে, সেই বাংলাদেশ অন্যান্য সকল ভাষার যথাযথ মর্যাদা দিবে বলেই বিশ্বাস করি।
ব্রিটেনে বাংলা ভাষার পাশাপাশি সিলেটি ভাষাও একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছে যার ফলে সেখানকার এই প্রজন্ম মাতৃভাষা শিক্ষার সু্যোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশেও আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ পায় সেই ব্যবস্থা যাতে করা হয় সেই আশা করি।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২০ রাত ৮:০০