আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। আইনের ছাত্র, কিছুদিন হলো স্নাতক করেছি, বার কাউন্সিলের পরীক্ষা দিয়ে তালিকাভুক্ত আইনজীবী হবার সুযোগ এখনো পাইনি। বর্তমানে ভিন্ন পেশায় থাকলেও ইচ্ছে আছে সময় সুযোগ হলে আইন পেশায় যোগদান করবো। আইন পেশার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর আগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন বারে প্র্যাকটিস করেন এমন অসংখ্য বিজ্ঞ আইনজীবী আমার ফেসবুক বন্ধু তালিকায় সংযুক্ত আছেন। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবীর সাথেও আমি ফেসবুকে সংযুক্ত আছি। পাশাপাশি আইন পেশা সংক্রান্ত বিভিন্ন ফেসবুক পেইজ এবং গ্রুপের সাথেও সংযুক্ত আছি, যাতে দেশের আইন অঙ্গনের খবরাখবর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে পারি।
গত ০৯/০৫/২০২০ তারিখ, শনিবার সরকার "আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ-২০২০" এর গেজেট প্রকাশ করেছে এবং তৎপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট নিম্ন আদালতের জন্য প্র্যাকটিস ডাইরেকশনও জারি করেছে।
যার ফলে ১২/০৫/২০২০ ইংরেজি তারিখ থেকে সুপ্রিম কোর্ট সহ অধঃস্তন আদালত সমূহের নির্ধারিত ভার্চুয়াল কোর্টে জামিন শুনানি ও আদেশ প্রদান শুরু হয়েছে।
ভার্চুয়াল কোর্টের ধারণা একেবারে লেটেস্ট এবং অত্যাধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভরশীল। আমাদের আদালত সমূহে প্র্যাকটিসরত অধিকাংশ বিজ্ঞ আইনজীবীই বয়স্ক এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কে খুব ভাল ধারণা বা দক্ষতা সম্পন্ন নন। যার ফলে দেশের বেশ কয়েকটি জেলা বার এসোসিয়েশন জরুরি বৈঠকে ভার্চুয়াল কোর্ট বর্জনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে মর্মে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আমার বন্ধু তালিকায় থাকা কয়েকজন আইনজীবী, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের দুই একজন সুপরিচিত সিনিয়র আইনজীবীও ভার্চুয়াল কোর্টের বিরোধিতা মূলক বিবৃতি দিয়েছেন পরিলক্ষিত হয়েছে।
ব্যাপারটা নিয়ে আমি বেশ চিন্তা করেছি, ভার্চুয়াল কোর্ট বর্জনকারী জেলা বার এসোসিয়েশন সমূহের আধিকারিকদের বিবৃতি, সিনিয়র আইনজীবীদের বক্তব্য পড়ার ও শোনার মাধ্যমে তাদের মনঃস্তত্ত্ব বুঝার চেষ্টা করেছি।
বাস্তবতা হলো, অনেক জাদরেল আইনজীবীও প্রযুক্তি সম্পর্কে এতোই অজ্ঞ যে, একটা বাটন ফোন কোনমতে ইউজ করতে পারেন, তাঁর এন্ড্রয়েড ফোনে ছোট ছেলেমেয়ে কিংবা নাতি-নাতনিরা ভিডিও গেমস খেলে, ইউটিউব দেখে। আর তার ফেসবুক একাউন্টটাও নাতি-নাতনিরাই মাঝেমধ্যে আপডেট করে দেয়। আর আইওএস চালানোতো তাদের কল্পনারও অতীত। বিপরীতে এমন অনেক সিনিয়র আইনজীবীও আছেন যারা স্মার্ট ডিভাইস চালনাতে তরুনদের মতোই সাবলীল।
পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে দেখা দিয়েছে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারি। সম্পূর্ণ নতুন এই রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন প্রতিষেধক কিংবা ভ্যাক্সিন কিছুই নেই। বিশেষজ্ঞদের মতামত, শুধুমাত্র সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমেই এই মহামারীর ছোবল থেকে নিজেকে বাচিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সমগ্র পৃথিবী থমকে গেছে, থমকে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা। কিন্তু তবুও মানুষ থেমে নেই, লড়াই চলছে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে জয়ী হবার জন্য, লড়াই চলছে কিভাবে বিকল্প উপায়ে মানুষের দৈনন্দিন অত্যাবশকীয় প্রয়োজন ও চাহিদা গুলো পূরণ করা যায় তার জন্য। এরকম চিন্তাভাবনার ধারাবাহিকতাই হলো ভার্চুয়াল কোর্ট।
এটা সত্য যে, আমাদের বিজ্ঞ আইনজীবীদের বড় একটা অংশের তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞান একেবারে সীমিত। ভার্চুয়াল কোর্ট ব্যবস্থা সংস্থাপনের সাথে সাথে তাদের এব্যাপারে প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এই বিশেষ পরিস্থিতিতে যেহেতু এধরণের সময়সাপেক্ষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করা অসম্ভব। তাই এব্যাপারে আমাদের বিজ্ঞ আইনজীবীদের আরেকটু নমনীয় হওয়া উচিত।
কেননা, যেসকল বিজ্ঞ আইনজীবী ভার্চুয়াল কোর্টের বিরোধিতা করতেছেন তাদের হাতের কাছেই এমন রিসোর্স রয়েছে যার মাধ্যমে তারা প্রযুক্তিগত এই দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। আইন পেশায় নিয়োজিত প্রায় সকল বিজ্ঞ আইনজীবীদের সাথে আছেন একেবারে নবীন জুনিয়র আইনজীবী এবং শিক্ষানবিশ আইনজীবী যারা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই বেসিক বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এদের একটু সহযোগিতা নিলেই ভার্চুয়াল কোর্টে অংশ গ্রহণ করা খুব কঠিন কিছু হবেনা।
মোদ্দা কথা, এই পরিবর্তনকে বিজ্ঞ আইনজীবী মহল ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করতে হবে। সময়ের সাথে সাথে নিজেদের আপডেট করে নিতে হবে। অভিযোজনের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। যেসকল বিজ্ঞ এডভোকেট এই পরিবর্তনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন না, নিশ্চিত তারা পিছিয়ে পড়বেন। যেসকল বার এসোসিয়েশন ভার্চুয়াল কোর্ট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, আর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে দক্ষ আইনজীবীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবেন। তখন আপনারা চাইলেও এমন নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। মনে রাখতে হবে, অতিকায় ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু ক্ষুদ্রাকায় তেলাপোকা এখনো টিকে আছে শুধুমাত্র পরিবর্তনের সাথে নিজেকে অভিযোজিত করে নেবার সক্ষমতার জন্যই। সুতরাং অভিযোজনের সাথে নিজেদের একাত্ম করুন, আগামীর পানে অগ্রসর হোন।
তাইতো বলি, প্রযুক্তির প্রতি অনীহা নয়, ইতিবাচক হোন। জুনিয়রদের সহযোগিতা নিন।
বিশ্বব্যাপী লক ডাউন চলছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি ই-কমার্স এর মার্কেট গ্রোথ হচ্ছে, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে, ডাক্তাররা অনলাইনে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন, সর্বোপরি মানুষের জীবনযাত্রা অনলাইন নির্ভর হয়ে যাচ্ছে, অথচ আইনপেশার মতো একটা গতিশীল পেশায় থেকেও আপনারা কেন গতানুগতিক চিন্তার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারতেছেন না?
বার কাউন্সিল এবং সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিশেষ অনুরোধ, বছরে অন্তত একবার এনরোলমেন্ট পরীক্ষার আয়োজন করুন। আমরা আমাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই এডভোকেট হিসাবে তালিকাভুক্ত হতে চাই, এবং এজন্য সুযোগ চাই।
আলী আহমদ মাসুদ
বিএসএস (অনার্স), এমএসএস (১ম শ্রেণী)
(সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, এন.ইউ)
এলএল.বি (এন.ইউ)
তারিখঃ মে ১৪, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:৫২