একজনের প্রেমে পড়েছিলাম আমি, সে এক কঠিন প্রেম।
২০০৯-১০ সালের কথা, তখন আমার বয়স ২২-২৩। সে আমার সমবয়সীই। মার্জিত রুচিশীল, স্মার্ট আর দারুণ সুন্দরী, ভীষন ভাল লাগতো তাকে। আর হাতের লিখা!!! প্রতিটি অক্ষর যেন এক-একটি মুক্তার দানা। মাইগ্রেনের সমস্যা ছিলো, চোখে চশমা পরতো। সাদা ফ্রেমের সেই চশমাতে অপরুপ লাগতো।
একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করতাম, ঐ বছর একইসাথে পাঁচ জন জয়েন করেছিলাম আমরা। সবাই মেয়ে ছিল, ব্যতিক্রম শুধু আমি।
রাশভারী এক ভদ্রলোক ছিলেন আমাদের বস। নানাবিধ অভিজ্ঞতায় পূর্ণ ছিলেন তিনি। একইসাথে বেশ কড়া এবং সবার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতেও পটু। তারপরও দারুন একটা কর্মপরিবেশ ছিল সেখানে। অল্প দিনের মধ্যেই পুরনো কলিগদের সাথে ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে ওঠে আমাদের। কাজের ফাঁকে কিংবা লাঞ্চ টাইমে জমিয়ে আড্ডা হতো সবার, খুনসুটি লেগেই থাকতো। শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর পারস্পরিক সহযোগীতায় কুড়ি জনের সুখী একটা পরিবারের মতো হয়ে গেছিলাম আমরা।
অথচ আমি দিনদিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম সাদা ফ্রেমের চশমাওয়ালী রানু মন্ডলের প্রতি। এমন না যে আমার পরিচিতদের মধ্যে কিংবা এখানে তার চেয়ে সুন্দরী কেউ ছিলোনা, কিন্তু চোখ ফেরাতে পারতামনা। নিজেকে সংযত রাখার আপ্রান চেষ্টা সত্ত্বেও তার প্রতি ব্যাকুলতা বাড়তেছিল ক্রমশ।
অফিসে আমার কাজ ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। সবার কাজের একাংশের সমন্বয় করতে হতো আমাকে। সেই সুবাদে সকল কলিগদের সাথেই ওয়ান-টু-ওয়ান ডিল করতে হতো। অনেক সময় কেউ কেউ আমার টেবিলে এসে কাজ বুঝিয়ে দিতো কিংবা বুঝে নিতো। রানু আমার টেবিলে আসলেই আমি কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাই, খেই হারিয়ে ফেলি। এভাবেই চলতে থাকে দিন।
রোজ অফিসে যাই, কাজ করি। অধীর আগ্রহে সুযোগ খুঁজি রানুর সাথে কথা বলতে। কখনোবা কথা হয়, ভাল লাগে। ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করি, কিন্তু কাজের বাইরে ব্যক্তিগত কোন আলাপই হয়না।
বুঝতে পারি অদ্ভুত একধরণের ব্যক্তিত্ব তার; হাসি মুখে কথা বলে, ভালো ব্যবহার করে কিন্তু কাছে ভিড়তে পারিনা। এভাবেই কেটে যায় কয়েকমাস, নৈরাশ্য ভর করে আমার মাঝে।
সুযোগ খুঁজতেছিলাম ফোনে কথা বলতে। কিন্তু এই কয়েকমাসে কোন কাজের ছুতোও পাইনি কল দেবার। একবার সামারে ভ্যাকেশন পেলাম কয়েকদিনের জন্য। ভ্যাকেশনের মধ্যেই এক সন্ধ্যায় দুরুদুরু বুকে কল দিলাম রানুকে। স্বাভাবিক আলাপচারিতা হলো। স্বাভাবিক আলাপে যে-ধরনের দূরত্ব বজায় রাখতো তারচেয়ে ফোনে কথা বলতে তাকে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ মনে হতো। আমিও নিয়মিত বিরতিতে কল দিই, সে যথেষ্ট সময় দেয়, কথা বলি। একসময় ফোনে প্রচুর কথা বলতে লাগলাম তার সাথে। বুঝতে পারলাম তারও একটা সংবেদনশীল মন আছে। এভাবে একসময় খুবই ভাল এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে যাই আমরা।
কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না বন্ধু হয়ে, কেননা আমি আগেইতো প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম রানুর। সুযোগ বুঝে একদিন ফোনেই প্রপোজ করে বসি।
ফলাফলঃ সরাসরি রিজেক্ট।
রিজেক্টেড হয়ে মুষড়ে পড়ি আমি। এতো ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং সত্ত্বেও রিজেক্ট এর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলামনা। অনেক রিকুয়েষ্ট এর পর জানালো, সে আরেকজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে আছে তিন বছর যাবৎ। বিয়ে করবে বলে তারা কমিটেড।
নিজেকে খুবই অসহায় মনে হচ্ছিলো। খুবই খারাপ সময় যাচ্ছিলো আমার। চোখের সামনেই সে সারাদিন ঘুরাঘুরি করে, তার প্রতিটি মুভমেন্ট আমার বুকে কাপন ধরিয়ে দেয়। তাকে আমি ভালবাসি অথচ সে আমায় ভালবাসেনা, এ এক অসহ্য যন্ত্রণা।
নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সত্ত্বেও দিনদিন আবেগে কাবু হয়ে যাচ্ছিলাম। নিজের সাথে নিজের দ্বান্দ্বিক যুদ্ধে হেরে যাচ্ছিলাম। মনস্থির করেছি, চাকুরী ছেড়ে দেবো। চেষ্টায় আছি নতুন একটা চাকুরী জুটিয়ে নিতে। অবশেষে একদিন লাঞ্চ টাইমে একমাসের নোটিশে বস এর হাতে তুলে দিই রেজিগনেশন লেটার। এই তীব্র মানসিক যুদ্ধের সময়ও ফোনে অনেক কথাই বলতাম রানুর সাথে। যথেষ্ট আন্তরিকতা আর সহানুভূতি ছিল আমার প্রতি তার। একই সাথে ছেলেটার প্রতিও তার তীব্র ভালবাসা টের পাচ্ছিলাম, যা দেখে প্রচন্ড হিংসা হচ্ছিলো আমার।
সময় তার আপন গতিতে চলে, তবুও রেজিগনেশন দেবার পর চাকুরির এই একটি মাস আমার কাছে অনেক বেশী দীর্ঘ মনে হচ্ছিলো। খুবই দূঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একবছরের মাথায় চমৎকার একটা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে আসলাম। ©আলী আল মাসুদ
বিঃদ্রঃ এই গল্পের কথক এবং রানু মন্ডল চরিত্র সম্পূর্ণই আমার অনুর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। কেউ কারো জীবনের সাথে কিংবা আমার জীবনের সাথে মেলানোর চেষ্টা অর্থহীন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৯ বিকাল ৫:৪৯