কাগজের প্রথমেই খেলার পাতায় চলে যান স্নেহময়বাবু। প্রথম পাতাটা ইদানিং আর পড়েন না। কী হবে ওসব অশান্তির খবর পড়ে? দিনরাত খালি যুদ্ধ, খুন-জখম, শুয়োরের রাজনীতি, আর নাবালিকার শ্লীলতাহানি। মানুষগুলো জন্তু হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।
কলেজজীবনে তিনিও ক্রিকেট, ফুটবল কম খেলেননি। ফুটবলে রাইট উইঙ্গার, ক্রিকেটে উইকেট কিপার। আজ দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কে বলবে এই স্নেহময় চ্যাটার্জি ডিস্ট্রক্ট লেভেলের এ্যথলিট ছিল? এই ডানপা দিয়েই পঞ্চাশবার বল নাচাতো?
সেদিনের সেই ছেলেটাকে মনে পড়ে। তরতাজা প্রাণবন্ত যুবক। পাক্কা স্পোর্টস্ম্যানের চেহারা। দাপিয়ে বেড়াতেন স্কুল, কলেজ, মাঠ। বাবার কাছে কম বকুনি খেয়েছেন? এক এক সময় এক একটা ঝোঁক চাপত মাথায়। একবার তো নিজে নিজে সাঁতার শিখতে গিয়ে মরতেই বসেছিলেন।
আজ নউই ডিসেম্বর। আজ যেন বড় একা মনে হচ্ছে নিজেকে। আজ যদি সরমা পাশে থাকতো। হঠাত্ করে চোখে জল এল স্নেহময়ের। কাগজটা সরিয়ে রাখলেন পাশে। ঘাড়টা এলিয়ে দিলেন ব্যাকরেস্টে। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস মেশানো হাসি ফুটলো ওর মুখে। প্রতিবার এই দিনে সক্কালবেলা একগোছা রজনিগন্ধা গুঁজে দিত টেবিলের ফুলদানিটায়। আর তারপর -- দরজাটা ভেজিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে ..............। করুণা বড় হয়ে যাওয়ার পরেও। কি ছেলেমানুষ ছিল! শেষ বছর ও কম্মোটি তিনিই করেছিলেন। ও তখন বিছানায় শয্যাশায়ী। বাহাত্তর বছর বয়সে স্ত্রীকে ওই উপহারটুকু দিয়ে বিছানায় মিশে যাওয়া কঙ্কালসার বুকে মাথা রেখে শুয়েছিলেন কিছুক্ষণ। আপনমনে হাসতে হাসতে চোখদুটো মুছলেন স্নেহময়। এই প্রথম ৯ই ডিসেম্বর উনি একা।
দুপুরের খাওয়ায় কুচো মাছ ছিলো স্পেশাল। সরষেবাটা দিয়ে ঝাল। স্নেহময়ের দারুণ প্রিয় পদ। ছোটবেলায় মা করে দিত। মায়ের কাছ থেকে সরমা শিখে নিয়েছিলো ওই পদখানার খুঁটিনাটি। তবে পায়েসটা কোনদিনই মা'য়ের মত পারেনি সরমা। সেজন্য কম রাগাতেন ওকে স্নেহময়।
অতীত, সমস্ত অতীত। আজ তিয়াত্তর আর চুয়াত্তরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে পঙ্গু স্নেহময় চ্যাটার্জিকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় তিনি মোটামুটি সুখেই আছেন। মেয়েকে ভালভাবে পাত্রস্থ করেছেন। দুই ছেলেই প্রতিষ্ঠিত। সংসারের সমস্ত কর্তব্য মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে। তার কাজ শেষ।
এরা বোধহয় ভুলেই গেছে আজ ৯ই ডিসেম্বর। আর যাবে নাই বা কেন? একজন অপ্রয়োজনীয় মানুষের আবেগ নিয়ে কে আর কবে মাথা ঘামায়। আবার কাগজটা তুলে নিলেন স্নেহময়। বহুদিন বাদে আবার খুললেন প্রথম পাতাটা। বাঁচার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার, অথচ মরার অধিকার যে কেন মানুষের নিজস্ব নয়! অথবা এই বয়সে এসে কিছু চাওয়াটাই ভুল। এদের তো কারো ফুল এনে রাখার দায় নেই। 'সঞ্চয়িতা'টা খুব পড়তে ইচ্ছে করছিলো। চাইতে সাহস করলেন না।
হুড়মুড় করে ঢুকলো করুণাময়। ব্যাগটা ধপ্ করে রেখেই চিত্কার করে উঠলো, 'তোমার জন্য কি আমি পাগল হয়ে যাবো?'
বিস্মিতভাবে স্নেহময় দেখলেন কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে।
মালতি বেরিয়ে এল, 'আঃ, কী ষাঁড়ের মত চেল্লাচ্ছ? কী হলটা কী?
ব্যাগ থেকে একটা ক্যারিব্যাগ বার করলো করুণাময়। 'নাও, এবার বাছো বসে বসে। কাল বাজারে প্রদীপকে উনি বলেছেন আধকিলো কুচোমাছ রেখে দিতে। আমি আজ নিয়ে আসবো। আধকিলো! বাজারে কুচোমাছ ওঠেনি আজ, দেড়া দামে এসব ছাইভস্ম নিতে হল আমায়।'
'অন্যমাছ এনেছ নাকি?'
রাগে থমথম করছে করুণাময়ের মুখ। 'আবার কী আনবো? এগুলোই গেলো বসে। এতেও শান্তি নেই। হোসেন মিস্ত্রির ছেলেকে আবার নেমন্তন্য করা হয়েছে দুপুরে খাওয়ার জন্য। কেন, কী উত্সবটা আছে আজকে শুনি? এইজন্য তোমাকে নিচে বসতে দিইনা। যত আদিখ্যেতা ওই থার্ডক্লাস লোকগুলোর সঙ্গে।
'ওমা..। হোসেন মিস্ত্রির ছোঁড়াটা আবার আসবে নাকি?'
'পাগল না মাথা খারাপ তোমার? ওসব ফোরটোয়েন্টি ছেলেকে কেউ ঘরে ঢোকায়? বারণ করে দিয়েছি আমি।'
কাগগুলো এখনো ডাকছে। ওরা গজগজ করেই চলেছে। মুণ্ডপাত হচ্ছে স্নেহময়বাবুর। নির্বাক চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্নেহময়। এই বারান্দা থেকে আকাশটা ভালো দেখা যায় না। একটা হিমেল বাতাস এসে স্নেহময়ের গায়ে হাত বুলিয়ে গেল। হোসেন মিস্ত্রির ছেলেটাকে বড় ভালোবাসতো সরমা।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০০৭ রাত ৯:৫২