শিউলি আর আকাশ বসে ছিল পার্কের বেঞ্চে। সেখানে শুধু বসা যায় মাত্র। ফিসফিস কথা বলা যায়। কিন্তু হাতে হাত রাখতে সময় চুরি করতে হয় আচম্বিতে।
-"কোন শুভদৃষ্টি ভবিষ্যতই কি আছে?"
শিউলির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা কেন্দ্রীভুত সময়। গড়িয়ে পড়লো ঘাসের ডগায়। ক্ষণিকের জন্য পৃথিবীর সমস্ত রঙ মেখে নিয়ে হারিয়ে গেল নিঃশব্দে। ঠিক তখনই আকাশ ঘড়ি দেখলো। সন্ধ্যা নামছে ধীরে। গোধুলিতে থেমে আছে রোদ। ফেলে দেওয়া কলার খোসা থেকে বোঁ বোঁ শব্দে উড়ে গেল মাছিগুলো।
-"পৃথিবীতে কোন বিশুদ্ধ সম্পর্ক তৈরি হয় না শি-। আমরা যা করি সে শুধু প্রাপ্তির উচ্ছলতা বা ত্যাগের অভিমান। বিমুর্ত ভোগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আকাঙ্খা।"
আকাশের জমাট ভুরুতে অন্তর্গত আঘাতের চিহ্ন পরিস্কার।
-"কিন্তু এই যে আমি তোকে অন্তর্লীন পেতে চাই এইটে কি আমার প্রাপ্তিসুখ? আমি কি বুঝিনা পাওয়া কেবল মুহুর্তের রসনাতৃপ্তি! তারপর অনন্ত স্মৃতিচারণ। যে পেতে জানে সে জানে প্রাপ্তির ক্ষণিকসত্য আশ্বাস। সম্পুর্ণ পাওয়াও খুব একরকম হারানো বৈ নয়।
-"তবে কেন অমন মাতাল করিস হঠাৎ হঠাৎ?"
আকাশের চুলে এসে পড়া উড়ো পাতাটাকে হাতের মুঠোয় তুলে নিল শিউলি। বসন্তের গন্ধ মাখা রঙ। আকাশের আঙ্টির উদাস করা পাথরটার মত।
-"তোর সমস্ত বিগ্ঞানকে এই পাতার মত মলিন করবো বলে। তোর জ্বর হয়না আকাশ? আমার শহরের গায়ে জ্বরের গুটি বেরোয় অবিশ্রান্ত। পাকে। পুঁজ হয়ে ফেটে পড়ে। ওরা সবাই চায়। শুধু চায়। অভিমন্যুর মত ওরা কেবল চাওয়ার মন্ত্র শিখেছে। পাওয়াটাকে অনুভব করার কৌশল শেখা হয়ে ওঠেনি। আমাদের ঝরা পাতার গান ওদের কানে গেলে ওরা বুঝবে সমস্ত বর্তমানটাই একটা বিশাল প্রাপ্তি। এই-ই একমাত্র সত্য।"
আকাশ উঠে দাঁড়ালো। ওর পাঞ্জাবি থেকে খসে পড়লো দু'এক ঝুরো বাদামের খোসা। ভালবাসার সমীকরণটা আজো ওর কাছে স্পষ্ট নয়। প্রেমই মুক্তি নাকি প্রেমেই মৃত্যু? নাকি দুটোই সম'। ছাদকেই ভালবেসে আকাশ ভেবে নেওয়া নাকি আকাশকেই ছাদ করা চরম নৈর্বক্তিকতায়।
দোমড়ানো কাগজের মত চিন্তাটাকে ছুঁড়ে ফেলতে চেষ্টা করে আকাশ। পাত্রাধার তৈল নাকি তৈলাধার পাত্র? হাঃহ্ !!
মহাশুণ্যের শব্দ যার বুকে আগুন হয়ে ফুটেছে সে ত্রিকালদুষ্ট।
তাহলে শিউলি! সজোরে মাথা ঝাঁকায় আকাশ। ওটা একটা ভ্রম। আদ্যোপান্ত ভ্রম। শিউলির দিকে তাকায় আকাশ। মাথা নিচু করে বসে আছে। একটুকরো করুণ আলোর রেখা ওর বাঁ চোখের কোনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ওর টিয়াসবুজ শাড়িতে গ্রাম্য পটের মোটিফ। এত বিষাদময় সবুজ আগে কখনো দেখেনি আকাশ।
-"শি-"।
মুখ তুলে তাকালো শিউলি। চোখে চোখ। ছেঁড়া স্বপ্ন উপচে পড়ছে ওর দুচোখে। কোন অনুযোগ নেই। কোন আকুতি নেই। শুধু শিথিল অপেক্ষা।
হঠাৎ দৌড়তে শুরু করলো আকাশ। জোরে, আরো জোরে। আরো আরো আরো জোরে। পিছন ফিরে দেখলো শিউলি উঠে দাঁড়িয়েছে আকস্মিকতায়। পালাচ্ছে আকাশ। ওর পাশে হারিয়ে যাচ্ছে সুখ। আরো আরো দুরে। যেন পৃথিবীর শেষ কিনারায় দাঁড়িয়ে লাফ দেবে অনন্ত স্তব্ধতায়। ছোট হয়ে আসছে শিউলি। ছোট, আরো ছোট। বিন্দুবৎ। তবু থামে না আকাশ।
"I have miles to go before I sleep
I have miles to go before I sleep."
শিউলি হাসছে। বসলো। পাগল একটা। আকাশের কবিতার খাতাটা আলগা শুয়ে আছে শিউলির কোলে।
ওকে ফিরতেই হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০০৭ রাত ৯:৪৬