ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগের নিষিদ্ধ হওয়ার ইতিহাস ১৯৬৮-২০২৪
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন। এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন গণআন্দোলন ও রাজনৈতিক সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ছাত্রলীগের সক্রিয়তা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে তাদের কার্যক্রমের জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারিভাবে আক্রমণের শিকার হলেও, ১৯৭১ সালের আগে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হয়নি।
ছাত্রলীগের প্রারম্ভিক বছর এবং ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকেই শাসকগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এই আন্দোলন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি থেকে শুরু হয় এবং ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এর নেতৃত্ব দেয়। ছাত্রলীগের এই সাহসিকতা এবং সংগঠিত আন্দোলনের কারণে তারা জাতীয় রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাদের এ সফলতা পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
১৯৬৮ সালের নিষেধাজ্ঞা
ছাত্রলীগের ওপর ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর পেছনে মূল কারণ ছিল ছয় দফা আন্দোলনে ছাত্রলীগের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তাদের প্রতিবাদী ভূমিকা। ছয় দফা আন্দোলন, যা মূলত পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল, তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে জনসমর্থন আদায়ে বড় ভূমিকা পালন করে। ছাত্রলীগের তৎপরতা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের শাসনব্যবস্থা দুর্বল করে তোলে, যার ফলে তারা ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এই নিষেধাজ্ঞা ছাত্রলীগের কার্যক্রমকে থামাতে, পারেনি থামাতে পারেনি তাদের গণঅভ্যুত্থান।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং আইয়ুব খানের পতন
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনটি ছাত্র সমাজের মাধ্যমে শক্তি পায় এবং ছাত্রলীগ এর অগ্রভাগে ছিল। এসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিরলসভাবে গণআন্দোলন পরিচালনা করে, যা শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খানের শাসনকে ভেঙে দিতে সহায়ক হয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে করা পাকিস্তান সরকারের 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' এবং ছাত্রলীগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে তারা আবার প্রকাশ্য সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসে। রেসকোর্সে ১০ লাখ লোকের সমাবেশে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেন। এই আন্দোলনই স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের সূচনা করে।
১৯৭১ সালের নিষিদ্ধকরণ
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ উভয়কেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ছাত্রলীগ তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সামনের সারিতে অবস্থান করছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি এবং পরিচালনায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলো। পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খান ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে দমন করতে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, কিন্তু এটি সফল হয়নি। বরং, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ এবং সামরিক অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
১৯৭৪ সালের নিষেধাজ্ঞা
স্বাধীনতা অর্জনের পর, ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্রলীগের কিছু কর্মকাণ্ডের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সে সময় ছাত্রলীগের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয় এবং সহিংসতা বৃদ্ধি পায়, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। সেই প্রেক্ষিতে সরকার ছাত্র রাজনীতির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। এখানে, উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে ৭ মার্ডার কেইস। যাতে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই এই খুনের বিচার হয় এবং অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর, এদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়নি। বরং, খুনিদের মুক্ত করে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। সরকারে থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ করা কোন ব্যক্তিকে অপরাধের দায়মুক্তি দেয়া বা প্রশ্রয় দেয়নি আওয়ামী লীগ। সেভেন মার্ডার কেইস, আবরার বা বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে যারাই অভিযুক্ত হয়েছে তাদেরই বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। বরং, বারবার প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের আদর্শে বিশ্বাসী নয় যারা তারাই সুযোগ সন্ধানী হিসাবে দলে ঢুকে অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে এবং দলের বদনাম করতে চেয়েছে। শিবির যেমন নিকট অতীতে ছাত্রলীগে মিশে খুন খারাবীতে লিপ্ত হয়েছিলো, তেমনি মুসলিম লীগ নেতার ছেলে শফিউল আলম প্রধানও ছাত্রলীগে মিশন নিয়ে এসেছিলো। জিয়াউর রহমানের দায়মুক্তি এবং পরবর্তিতে আওয়ামী লীগে বিরোধী রাজনীতিতে তাদের সক্রিয়তা সেটাই প্রমাণ করে।
সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা (২০২৪)
২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর, বাংলাদেশ সরকার পুনরায় ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে, এই নিষেধাজ্ঞার ভিত্তি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সরকার “সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯” এর অধীনে ছাত্রলীগকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে। সরকারি গেজেটে অভিযোগ করা হয় যে, সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগের জড়িত থাকার কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন। কোন ব্যক্তির অপরাধের দায় সংগঠন নিতে পারে না। ছাত্রলীগের অতীত ইতিহাস এবং দেশপ্রেমিক ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে যে, এটি কখনোই একটি সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল না, বরং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
উপসংহার
ছাত্রলীগের ইতিহাসকে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের ইতিহাস হিসেবে দেখা যাবে না; এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। যদিও বিভিন্ন সময়ে এটি অন্যায়ভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে এবং এর কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা হয়েছে, তবুও ছাত্রলীগের মূল পরিচয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগামী সংগঠন হিসেবে অমলিন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের বিরুদ্ধে আনা সন্ত্রাসের অভিযোগগুলো বিতর্কিত এবং অনেকের মতে, এগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
রেফারেন্স:
1. “Bangladesh Students’ League.” Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh, Asiatic Society of Bangladesh.
2. Ahmed, Rafiuddin. The Bangladesh Liberation War and the Six-Point Movement. Dhaka: Bangladesh Studies Publications, 1985.
3. Salik, Siddiq. Witness to Surrender. Karachi: Oxford University Press, 1977.
4. Rahman, Sheikh Mujibur. The Unfinished Memoirs. Dhaka: University Press Limited, 2012.
5. Maniruzzaman, Talukder. The Bangladesh Revolution and Its Aftermath. Dhaka: University Press Limited, 1980.
6. “Bangladesh Government Gazette: Official Declaration on October 23, 2024.” Government of Bangladesh.