তিনতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সাদা চামড়ার জার্মান ছেলেটার এই নিয়ে সিগারেটের সংখ্যা ৩ ।এক-দুই-তিন।
আজকের তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। অনেক ঠাণ্ডা । ছেলেটার পরনে একটা কালো রঙয়ের হুডি ।তারপরো কাঁপছে ।
রাস্তার ওপাশে কালো রঙয়ের হুডি পরা সাদা চামড়ার জার্মান ছেলেটা আর এপাশে একটা ফুল হাতা টিশার্ট পড়া তামাটে রঙয়ের এক বাঙ্গালী কবি।
এদিকে দুই বাসার মধ্যবর্তী রাস্তা দিয়ে এই সময়ে পার হওয়া গাড়ির সংখ্যাও তিন। এক-দুই-তিন।
আজকের গল্পের প্রধান চরিত্র কে হবে এই নিয়ে একটা বিরাট টেনশনে লেখক। আর এটি কি আদৌ গল্প হবে কিনা তা নিয়েই তো চিন্তিত লেখক।যাই হোক ধরে নিই এটি একটি গল্প।। সাদা চামড়ার ছেলেটাকে গল্পের নায়ক বানালে লেখককে গালি শুনতে হতে পারে। আবার তামাটে রঙয়ের বাঙ্গালি কবিকে গল্পের নায়ক বানালে পাঠক ঠিক কীভাবে নিবেন তা নিয়েও বিরাট টেনশনে লেখক। একটা মেলবন্ধন করা যেতে পারে। গল্পের কিছুটা জুড়ে থাকবে সাদা চামড়ার জার্মান ছেলেটা আর কিছুটা তামাটের রঙয়ের বাঙ্গালি কবি।
সাদা চামড়া আর তামাটে চামড়া বলতে বলতে লেখক নিজেই বিরক্ত হয়ে যাচ্ছেন। দুইজনের জন্য দুইটা নামের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? লেখক সিদ্ধান্ত নিলেন সাদা চামড়ার জার্মান ছেলেটাকে একটা খাঁটি বাঙ্গালী নাম দিবেন আর তামাটে রঙয়ের ছেলেটাকে কোন নাম দিবেন না । উনি যেহেতু কবিতা লিখেন উনাকে কবি বলেই সম্বোধন করা হবে। কবিদের কোন নাম থাকা উচিত না । যাকে নাম ধরে ডাকার কেউ আছে সে কবি হতে চাইবে কেন !
নাম দেয়াতে বাঙ্গালি লেখকের গল্পে একটা বাংলা স্বাদ পাবেন পাঠক। বিশেষ করে একের পর এক সিগারেট ধরানো ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে ৭ নাম্বার বাসের অপেক্ষায় থাকা ছেলেটা ।তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে হবে।বাস আসতে দেরি করছে। বাস আসলে বাসে উঠার পর যে কিনা এই গল্পটা পড়তে পড়তে মুচকি হাসবে ।
যাক গল্পে ফেরা যাক।
গলির কোণায় একটা কফিশপ আছে।এই জার্মান কফিশপের একটা সমস্যা হলো এই কফিশপে বসে কফি খাওয়া যায় না। এখান থেকে কফি কিনে লোকজন এখানে সেখানে বসে খায়।আমি একটা কফিশপ দিলে সেখানে অবশ্যই বাহিরে বসে কফি খাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।ছোট্ট একটা কফিশপ কিন্তু বাহিরে বিশাল জায়গা জুড়ে কফি খাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এখানে শীতকালে প্রায় সবসময়ই বৃষ্টি লেগে থাকে । তাই উপরে কিছু একটা দেয়া হবে। বৃষ্টিতে বসে বসে কফি খাওয়াটা মানায় না। কফি হয়তো খাওয়া যাবে কিন্তু কফির সাথে সিগারেটটা ভিজে যাবে। রুদ্র আবার কফির সাথে একটা সিগারেটও খায়।রুদ্রকে আমি প্রথম সেখানেই দেখি। রুদ্র? হ্যাঁ , ঐ যে সাদা চামড়ার জার্মান ছেলেটার বাঙ্গালি নাম! হা হা হা।
সেদিন মনে হল রুদ্রের সাথে এই বিষয়ে একটা আলাপ করা যেতে পারে।
- রুদ্র ।
- তুমি কীভাবে জানো আমার নাম রুদ্র?
- গল্পটা বাঙ্গালি পাঠকদের জন্য । সুতরাং তোমার নাম রুদ্র।
- রুদ্র নামে তোমাদের একজন কবি আছেন না ?
- হ্যাঁ । রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ ।
-হুম। উনার একটা কবিটা আমি পড়েছি ।
- কোনটা ?
- ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।
- এটা তুমি কীভাবে জানো ?
- বাহ! আমাকে নিয়ে গল্প লিখা হচ্ছে আর আমি জানবো না ? তাও আমার নাম রুদ্র !
- হা হা হা ।আচ্ছা তোমার সাথে একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি।
- আমার সাথে ?
- হ্যাঁ ।
- হ্যাঁ বলো।
- আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাদের দেশে একটা কফিশপ দিবো। আর এর বাহিরে টিনের ছাউনি থাকবে। টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়বে আর কফির মগে চুমুক যাবে।
- আর সিগারেটে একটার পর একটা টান পড়বে।
- একদম ।
রুদ্র আর আমার এই আলাপচারীতা সম্পূর্ণ কাল্পনিক আর স্বেচ্ছাচারী ।লেখক মাত্রই স্বেচ্ছাচারী।
রুদ্র ছেলেটা আমার সামনেই ছিল তখন । অর্ডার দিচ্ছে - Eine Kaffe, Zwei Milch und Zwei Zucker. খাঁটি বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায় একটা কফি , সাথে দুইটা দুধ আর দুইটা চিনি। জার্মান ভাষার আক্ষরিক অনুবাদ।
ঠিক ঐ সময়ে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে দাঁড়ানো ৭ নাম্বার বাসের অপেক্ষায় থাকা ঐ ছেলেটা টঙয়ের দোকানদারকে বলছিল , মামা ,কড়া পাতি দিয়া একটা চা আর একটা গোল্ডলিফ দিও তো।
ওর সামনে দিয়ে এতক্ষণে অসংখ্য গাড়ি চলে গেছে। গোণা যায় নাকি! শুধু ৭ নাম্বার বাস যাই নি এটা সে নিশ্চিত। হঠাতই ছেলেটার ভার্সিটির এক বড় ভাই এসে হাজির।
- কেমন আছো?
- এইতো ভাই চলতেসে।আপনার কি খবর?
- এই চলতেসে ।কোথাও যাচ্ছ নাকি ?
- একটু মিরপুর যাব ।
- মিরপুর কেন ?
- এক বন্ধু হাসপাতালে। ঐ যে আমাদের সাথে একটা ছেলে ঘুরতো ? লম্বা চুল।
- কে রুদ্র ?
- আরে ওর নাম রুদ্র না।কবিতা লিখে বলে ওকে আমরা রুদ্র বলে ডাকি ।
- তা বুঝলাম । তো হাসপাতালে কেন ?
- সিগারেট খাইতে খাইতে শরীরের ১২ টা বাজাইয়া দিসে। একটার পর একটা । ওর ডেইলি ৩ প্যাকেট সিগারেট লাগে।আমিতো মাত্র ডেইলি ৩ তা খাই! এক-দুই-তিন।
- তোমরা না যা তা। নিজের জীবনটারে এমনে নষ্ট করে দিচ্ছো।
- বাদ দেন ভাই। আপনার কি খবর ? শুনলাম আপনি নাকি একটা নতুন বই লিখছেন ।
- নতুন আর পুরাতন কি ? আমার এইটাই প্রথম বই হবে। যদি কেউ প্রকাশ করে আর কি!
- হবে ভাই। রুদ্রের সাথে অনেক প্রকাশকের পরিচয় আছে । ও সুস্থ হলে আপনার সাথে একদিন দেখা কতে বলব।
ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারের এই কথোপকথন অনিচ্ছাকৃতভাবে ঢুকে গেছে । তাই একে অসম্পূর্ণ ভাবেই রেখে দিলাম। কারণ এতক্ষণে বাস এসে গেছে। " ভাই, আমার বিলটা দিয়েন " - বলে ছেলেটা বাসে উঠে গেল । সুতরাং আমরা এখন আবার জার্মান কফিশপের দিকে নজর দেই। গল্পটাও তো শেষ করা দরকার!
রুদ্র কফি নেয়ার পর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল , হ্যালো । আমি হ্যালো বললাম। এরপর কফি নিয়ে যে যার মত চলে গেলাম ।
এই ছেলেটাকেই একটু আগে তিনতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে একের পর এক সিগারেট টানতে দেখছিলেন কবি । একটার পর একটা সিগারেট টানছে। কবির জানতে ইচ্ছে করছে ওর ডেইলি কয় প্যাকেট সিগারেট লাগে?
কবি ভাবলেন ওর বাসায় যাবেন গিয়ে একটা ধমক দিয়ে বলবেন রুদ্র , আজ থেকে আর একটা সিগারেটও খাবে না ।
এ কথা ভাবতে ভাবতেই ঘড়িতে ১২.৩০ বাজে। আর ১০ মিনিট পর কবিকে বের হতে হবে। চাকুরী আছে তো !
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৪৫