বাবা বললেন, রিকশার হুডটা তুলে দে তো ।
আমি হুড তুলব নাকি তুলবো না সেটা ভেবে একটু ইতস্তত করছিলাম।
প্রেমিকাকে পাশে বসিয়ে রিকশায় হুড তোলার প্রচলন আমাদের শহরে আছে কিন্তু বাবাকে পাশে বসিয়ে রিকশার হুড তোলার ব্যাপারটায় শহরটা কেমন জানি এক ধরণের আপত্তি জানায় ।
বাবা আবার বললেন, কিরে হুড তুলছিস না কেন ?
আমি রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম , মামা হুডটা তুলে দাও তো।
তিন দিন ধরে ঢাকা শহরের রাস্তায় ঘুরাঘুরি করছি বাবাকে নিয়ে। কখনো ধানমণ্ডির রাস্তা তো কখন মিরপুরের রাস্তা। কিংবা কখনো যাত্রাবাড়ীর । আরো সহজ করে বললে এই রাস্তাগুলোর জ্যাম পেরিয়ে যেতে হয় এক একটা হাসপাতালে। কোথাও চোখের ডাক্তার তো কোথাও হার্টের ডাক্তার।
বাবা অসুস্থ অনেক দিন ধরেই। কখনো বলেন নি একবার ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যা আমাকে। কেন বলেন নি সেটা খুব স্বাভাবিক। কোন রকম দিন পার করা মানুষেরা চাইলেই ডাক্তার দেখাতে পারেন না। উনারা নিজেরাই এক একজন ডাক্তার। জ্বর কিংবা যে কোন ব্যাথায় প্যারাসিটামল আর একটু গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা হলে গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট তো আছেই। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে কারো প্রচন্ড হার্টের ব্যাথা আর সেই লোক অনবরত গ্যাস্ট্রিকের বড়িই খেয়ে যাচ্ছেন। যেন, সব ব্যাথার ঐ একটাই সমাধান।
বাবার শরীরটা বেশি খারাপ ছিল। এই কয়েকদিনে বেশ কয়েকজন ডাক্তার দেখানো হয়েছে।ডাক্তারগণ অনেকগুলো টেস্ট দিয়েছেন যার জন্য বেশ কয়েক হাসপাতালে যেতে হয়েছে। বাবার শরীরটা এখন বেশ ভালো তবে প্রচন্ড দুর্বল। এতই দুর্বল যে বাবা আমাকে এতদিন ঝাড়ির উপর রাখতেন এখন কোন কিছু করার আগেই একবার আমার দিকে তাকান আরেকবার আকাশের দিকে।একটা সিগারেট খেতে চাইলে আমাকে যে কতবার অনুনয় করেন!
বাবা একদিন বলেছিলেন, ছেলেরা বড় হলে বাবা হয়ে যায় আর বাবারা ছেলে হয়ে যায়। আমি কি তবে বড় হয়ে গিয়েছি? আমার তো ঐ ছেলে হয়ে থাকাতেই বেশ আনন্দ ছিল।দিন দিন আমার মাথার উপর আকাশটাকে মেঘে মেঘে ঢেকে যেতে দেখছি। বাবা কি তবে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে নিজের অস্ত যাওয়া দেখছিলেন?
আমার বাবার প্রিয় যানবাহন রিকশা। বাবা বেশ রোমান্টিক মানুষ। এই কথা আম্মার কাছ থেকে শুনেছি যে বাবা সবসময়ই রিকশা পছন্দ করেন। রিকশা বসে ঢাকা শহরকে যত সুন্দর দেখা যায় আর কোন যানবাহনে বসে সেটা দেখা যায় না।
হুমায়ূন আহমেদ বলে গেছেন, "রিকশায় চড়ায় একটা রাজকীয় ব্যাপার আছে। মাথা সামান্য উচু করলেই আকাশ দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।"
বাবাও কি ঐ রাজকীয়তা উপভোগ করতে পছন্দ করেন?
এবার ঢাকায় আসার পর তাই আমি চেয়েছি বাবাকে সবসময় রিকশায় করে নিয়ে যেতে। সিএনজিতে যেই ভাড়া তার চেয়ে কিছুটা কমে রিকশায় করে যায়। আর পাবলিক বাসে উঠার মত অবস্থা বাবার ছিল না। প্রথমে একদিন মিরপুর রোডে একটা পাবলিক বাসে করে গিয়েছিলাম। সিটিং সার্ভিস বাস অথচ আমরা কোন সিট পাই নি। বাবা বেশ কষ্ট করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর থেকে আমি আর বাবাকে নিয়ে আর পাবলিক বাসে উঠি নি।
আজকে ডাক্তার দেখিয়ে এখন রিকশায় করে ধানমণ্ডি থেকে মিরপুরে যাব আমি আর বাবা। ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে যখন আমরা বের হলাম তখন প্রায় রাত ১১ টা। এই সময়টায় ঢাকা শহরটাকে অদ্ভুত মায়াবী লাগে।আর এই সময়টায় ভি আই পি রোডগুলোতেও রিকশায় যাতায়াত করা যায়। সাধারণভাবে রিকশা এই রোড দিয়ে না গেলেও এই সময়টায় যায়। আমি একজন রিকশাওয়ালা মামাকে ১৫০ টাকায় ঠিক করলাম। ল্যাবএইড থেকে মিরপুর সাড়ে এগার পর্যন্ত। সিএনজিতে করে গেলে এই সময়ে হয়তো ২০০ টাকা লাগতো কিন্তু আমি বাবাকে নিয়ে রিকশায় যাব ঠিক করলাম।
বাবা রিকশায় বসে নানান গল্প জুড়ে দিলেন। কখনো ছোটফুফুর বিয়ের গল্প কখনো বা বড়ফুফুর বিয়ে ভেংগে যাওয়ার গল্প।ছোটফুফুর কেন জানি বিয়ে হচ্ছিল না। দাদা এই নিয়ে বেশ খারাপ ব্যবহার করতেন ফুফুর সাথে।সব দোষ নাকি ছোটফুফুর। একবার নাকি বাবা এই নিয়ে দাদার সাথে বেশ ভয়ংকর ভাবে রেগে গিয়েছিলেন। এরপর বাবা অনেকদিন দাদার সাথে কোন কথা বলেন নি। শেষমেশ বাবা উনার বন্ধু রফিক আংকেলের সাথে ছোটফুফুর বিয়ে দেন।বড়ফুফুর গল্পটা বলতে গিয়ে বাবা বেশ ক'বার চোখ মুছছিলেন। বড়ফুফুর গল্পটা বাবা শেষ করেন নি তাই অর্ধসমাপ্ত গল্পটা এখন বলছি না।
গল্প করতে করতে বাবা এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে গেছেন। একটা সময় আমার দিকে হেলে পড়েন।বাবা এখন আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন। ছেলের কাঁধে বাবা ঘুমাচ্ছেন এই দৃশ্য হয়তো হ্যালির ধুমকেতুর মত ৭৫ বছর কিংবা তার চেয়েও বেশি বছর পর একবার দেখা যায়।
মিরপুর চলে আসার পর রিকশাওয়ালা মামা রিকশা থামাতে গেলে আমি ইশারা দিয়ে বলি সামনে যেতে। রিকশাওয়ালা মামা সামনের দিকেই যাচ্ছেন।কোথায় যাচ্ছেন আমরা কেউই জানি না। বাবা আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন।
রিকশা চলছে। চলুক!
বাবা ঘুমাচ্ছেন। ঘুমাক!
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০২১ দুপুর ২:১৭