ছোটো কাকির জন্য এত আয়োজন দেখে আব্বা আম্মাকে বললেন, আমার ভাই কি নতুন বিয়ে করেছে? এত আয়োজন কেন?
আম্মা কিছু বললেন না। আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বললেন, কিরে, ইলিশ মাছ পাওয়া গেছে?
আমি বললাম, ইলিশ,বোয়াল,রুই সব পাওয়া গেছে। আর ছোট মাছের মধ্যে পাবদা, টেংরা আর পুঁটিও পাওয়া গেছে।
আব্বা আমার আর আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন,আর কিছু?
আমি আর আম্মা ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি। কেউ কাউকে কিছু বলছি না। সময়ে সময়ে মুখ দিয়ে কিছু বলা লাগে না। এমনিতেই সব বুঝা হয়ে যায়।এই দুনিয়াতে সময়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ছোটো কাকিকে আমাদের বাসায় দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। আজ সকালে উনি আসলেন। ছোটো কাকি, রাফি ভাই আর ১০ বছর আগে বিয়ে হওয়া আমার নতুন ভাবী।
ছোটো কাকা আসেন নি। কাকা ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত আছেন। আব্বাকে কল দিয়ে বলেছেন, ভাইজান, রাফির আম্মা, রাফি আর ওর বউ আসবে। আমি একটু ব্যস্ত। ভাইজান, বউটা তো প্রথম যাচ্ছে একটু দেখবেন। নরমালি তো ওরা গ্রামে যায় না। আপনি আর ভাবী এতবার বলাতে আর না করতে পারি নি। আমি আসতে পারলে ভালো লাগতো।
রাফি ভাইয়ের বিয়ের সময়টাতে আমরা ঢাকায় ছিলাম। আম্মাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। আব্বা আম্মাকে বলেছেন ঢাকায় গেলে যাতে উনার ভাইয়ের বাসায় উঠি।আম্মা কেন জানি ছোটো কাকার বাসায় যাওয়াটা পছন্দ করতেন না। তবুও আব্বার চাপাচাপিতে আমরা ছোটো কাকার বাসায় উঠলাম।
ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তার বেশ কিছু টেস্ট দিলেন। এগুলো করানোর জন্য আমাদের আরো একদিন এক্সট্রা থাকা লাগবে।যদিও কাকি কে বলেছিলাম যে আমরা ডাক্তার দেখিয়ে সেদিনই চলে যাব। আমি খুব খেয়াল করে দেখলাম আমরা একদিন থাকবো বলাতে ছোটো কাকি কেন জানি বেশ কষ্ট পেলেন। আম্মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন।রুমে যাওয়ার পর আমাকে বললেন, আমরা সকালে একেবারে বের হয়ে যাব।
পরদিন সকালে আমরা ছোটো কাকি কে একেবারে বিদায় বলে বের হয়ে গেলাম। কাকি বললেন দুপুরে এসে খেয়ে যেতে। আমার পরীক্ষা আছে বলে আমরা কোন মতে বের হয়ে গেলাম।
ডাক্তার দেখানোর পর আম্মাকে কুমিল্লার বাসে তুলে দিলাম। বাসস্ট্যান্ড থেকে আব্বা আম্মাকে বাসায় নিয়ে যাবে। আমার ক্লাস আছে তাই আমি আর যাই নি। নারায়ণগঞ্জ পার হওয়ার পর আম্মা আমাকে কল দিলেন।
- কি হয়েছে আম্মা?কোন সমস্যা?
- না। তোর আব্বা কল দিয়েছে।
- কেন?
- আমি কেন কুমিল্লা ফিরে যাচ্ছি তোর ছোটো কাকা নাকি বেশ রাগ করেছে।
- রাগ কেন করবে? উনারা তো খুশি হওয়ার কথা।
- রাফির বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছে। তোর কাকা কল দিয়ে বলেছে আমরা সবাই যাতে যাই।
- রাফির বিয়ে তো এক মাস আগে ঠিক হয়েছে।আম্মা, তুমি যাও। আমি যাব না।
- আমিও যাব না।
একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো সেদিন আমার। আম্মার কেন জানি গলা থেমে আসছিল। এই থেমে আসাটা কি জন্য হয়?
এই কথা সত্য ছোটো কাকা আর আমাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক।ছোটো কাকা ঢাকা শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী। আর রাফি ভাই লন্ডন থেকে ব্যারিষ্টারি পড়েছেন। উনার স্ত্রীও আমেরিকা থেকে পিএইচডি নিয়েছেন। আর আমার বাবা এলাকার ছোটো খাটো একজন রেস্টুরেন্ট ব্যাবসায়ী। ছোটো কাকি হয়তো চান নি আমরা বিয়েতে থাকি। আমাদের চেয়ে একটু কম পয়সাওয়ালা আত্মীয় -স্বজনদের আমরা মানুষ মনে করব কেন?
যাক অবশেষে ছোটো কাকি,রাফি ভাই আর রাফি ভাইয়ের বউ আসলেন। আমরা সারাদিন উনাদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম।
কাকি আম্মাকে বলছিলেন,
আমার বোনের একটা মেয়ে আছে। নাম তুলি। একটু কম ফরসা কিন্তু আমাদের শাফির সাথে বেশ মানাবে,ভাবী। ছেলে তো বড় হয়েছে মাশাল্লাহ। ভালো একটা চাকুরীও করে।
আম্মার সম্মতি না পেয়েও ছোটো কাকি তুলির সাথে আমার বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন।আমি এই বিয়েতে রাজি না। অবশ্যই, মেয়ে কম ফরসা এটা কোন কারণ না। পরে বুঝলাম, ছোটো কাকি আমাদের বাসায় এসেছেনই তুলির সাথে আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে।
যাক, সন্ধ্যায় উনারা সবাই চলে গেলেন। আম্মাকে ঢাকায় গেলে কাকার বাসায় যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে গেলেন ছোটো কাকি। ঢাকায় গেলে তুলির আর আমার বিয়ের ব্যাপারটাও উনি ফাইনাল করে ফেলবেন। আম্মা, আচ্ছা, বলে উনার রুমে চলে গেলেন।
আম্মার রুম থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল।
আব্বা বারবার বলছেন, আরে ওরা তো আবার আসবে। তুমি এত কান্না করছো কেন? অবশ্য খারাপ লাগাই স্বাভাবিক। আমারও খারাপ লাগছে অনেক।
আম্মা তারপরো কান্না করেই যাচ্ছেন। আমি দেয়ালে কান পেতে সেই কান্না শুনছি।কি অদ্ভুত সুন্দর কান্না! একবার ভাবলাম আম্মার সামনে গিয়ে আমিও বলি, আরে উনারা তো আবার আসবে। তুমি এত কান্না করছো কেন ?
আম্মা তখন হেসে দিলে বিশ্রী একটা ব্যাপার হবে!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০২১ রাত ১০:০২