মিস শৈলীর কথা জিজ্ঞেস করতেই ইমরান স্যার তো বলেই ফেলেছেন, 'দেখেন কারো না কারো ফ্ল্যাটে পাবেন। উনার তো আবার মাসে এক দুইদিন স্পেশাল ছুটি লাগেই।আল্লাহ জানেন কই যায়। উনার তো কোন আত্মীয় স্বজনও আছে বলে মনে হয় না। '
আমার ডেস্ক থেকে যাওয়ার সময় আমার ঘাড়ে হাত রেখে স্যার বললেন- 'মুহসিন সাহেব, হঠাত শৈলী ম্যাডামকে নিয়ে এত সিরিয়াস হয়ে গেলেন যে? বয়সে তো উনি আপনার চেয়ে বড়ই হবেন। হা হা হা!'
আমি উত্তর দিলাম, না স্যার, এমনিতেই।উনি অনেকদিন আসেন না অফিসে। তাই ভাবলাম আপনি কিছু জানেন কিনা।
মিস শৈলী গত সাতদিন অফিসে আসছেন না। যদিও এই নিয়ে অফিসে কারো কোন মাথাব্যথা নাই।থাকারও কথা না। আমাদের বস ইমরান স্যারের পছন্দের কেউ না মিস শৈলী তাই উনাকে নিয়ে কেও কথাও বলতে চায় না।কর্পোরেট পাড়ায় অফিসের বসের মন রক্ষা করা অতি অত্যাবশ্যকীয় নিয়ম। সেটা করতে না পারলে আপনি কোনঠাসা হয়ে পড়বেন।
মিস শৈলীকে মিস ডাকাতেও ইমরান স্যারের আপত্তি। উনার ভাষায় এই মধ্যবয়সী মহিলা আবার কিভাবে মিস হয়! কিন্তু আমি জানি মিস শৈলী এখনো বিয়ে করেন নি।উনি মোটেও মধ্যবয়সী কেউ নন। উনার বয়স ৩৫। আর মধ্যবয়সী হলেও অবিবাহিত থাকা যাবে না এই নিয়ম কে করেছে?
আমার ডেস্ক থেকে যেতে যেতে ইমরান স্যার বললেন, 'মুহসিন সাহেব, নিজের কাজ গুলো ঠিকমতো করেন।শৈলী ম্যাডাম উনার কাজ করবেন ফিরে এসে। '
এই অফিসে মিস শৈলীকে নিয়ে মোটামুটি আমিই একটু আগ্রহী। আর যার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ সে অফিস এসিস্ট্যান্ট হানিফ। আগ্রহ মানে অন্য কিছু না।আগ্রহ মানে উনার ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখা।
অফিস এসিস্ট্যান্ট হানিফ মিস শৈলী সম্পর্কে সব ইনফরমেশন সংগ্রহ করে গেটম্যান কিসলুর কাছ থেকে। আর আমি হানিফের কাছ থেকে।
"হানিফ ভাই, আজকে কি হইসে জানেন? আমগো স্যার তো শৈলী ম্যাডামরে নিয়া এখানে সেখানে প্রায়ই যাইতে চান। আজকেও গাড়িতে উঠার জন্য অনেকটা জোর জবরদস্তি শুরু করেন।আজকে স্যার এক পর্যায়ে শৈলী ম্যাডামের হাত ধরে ফেলেন। শৈলী ম্যাডাম হাত টান দিয়ে স্যারের গালে দেন এক থাপ্পড়। "
এটা হচ্ছে মিস শৈলীকে নিয়ে গেটম্যান কিসলুর কাছ থেকে পাওয়া অফিস এসিস্ট্যান্ট হানিফের সর্বশেষ আপডেট। এই আপডেট আমার কানে এসেছে মাত্রই।
আমি আর বস যখন কথা বলছিলাম তখন হানিফ চা নিয়ে আসছিল। আমাকে চা দিচ্ছে দেখে বস সেটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন, 'হানিফ, যাও তোমার মুহসিন স্যারের জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসো। চিনি আর দুধ বেশি দিও। তোমার স্যারের গ্লুকোজ কমে যাচ্ছে শৈলী ম্যাডামের অভাবে। '
যাওয়ার সময় আমার জন্য আনা চায়ে মুখ দিয়ে ইয়াক বলে টেবিলের উপর ফেলে চলে যান।
হানিফ এই কাপ চা নিয়ে গিয়ে আমার জন্য সত্যিই অনেক চিনি দিয়ে আরেক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসলো। আমি মুখে দিয়েই বললাম- হানিফ ,তুমি জানো আমি চায়ে দুধ- চিনি কিছুই খাই না। কি করলে এটা এখন?
হানিফ সব দাঁত দেখিয়ে একটা ভেটকি দিয়ে বলল, বড় স্যার যে বললেন!
'এজন্য তুমি এত চিনি দিবে?'
'সরি, স্যার।'
'স্যার, বড় স্যারের তো মেজাজ কেমন জানি হয়ে আছে এক সপ্তাহ ধরে। '
'কেন? জানো কিছু?'
হানিফ বলল, বাহিরে চলেন। বাহিরে গিয়ে বলি।
বাহিরে গিয়ে হানিফ বড় স্যারের চড় খাওয়ার ঐ বিষয়টা বলল গেটম্যান কিসলুর রেফারেন্স দিয়ে । এখন আমি মোটামুটি নিশ্চিত মিস শৈলী ইমরান স্যারের সাথে এই ঘটনার জন্যই অফিসে আসেন না।
অফিসে আসবেন না ভালো কথা কিন্তু মিস শৈলীকে মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না কেন তাহলে?
আমাকে আর মিস শৈলীকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন অফিসে।সব আমি শুনি হানিফের কাছ থেকে।
'স্যার, শৈলী ম্যাডামরে আপনার সাথে জড়াইয়া অমুক স্যার এটা বলেছে। '
'স্যার, ইমরান স্যার বললেন আপনি আর শৈলী ম্যাডাম বিয়ে করতেসেন?'
'স্যার, শৈলী ম্যাডামকে নাকি আপনার মারাত্মক পছন্দ?'
'স্যার, শৈলী ম্যাডাম.......'
এরকম আরো অনেক বাক্য কানে আসে। যদিও এসবের কোনটাকেই আমি খুব বেশি পাত্তা দেই না। অফিস এসিস্ট্যান্ট হানিফ এগুলো আমাকে বলে মুক্তি পেতে চায়। আমিও তাকে বলার সুযোগ করে দেই। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কারাগার হচ্ছে কথা না বলতে পারার কারাগার। এই কারাগারে বসবাস করা খুবই কঠিন।
'স্যার, শৈলী ম্যাডামের কোন খোঁজ জানেন?'
'না। বড় স্যার অফিস থেকে কোন খোঁজ নিচ্ছেন?'
'একটা চড় খাওয়ার পর আবার খোঁজ নিবেন উনি?
'তারপরও।উনি তো আমাদের অফিসেরই কলিগ।'
'শৈলী ম্যাডাম আমাদের অফিসে অনেকটা নিষিদ্ধ। উনাকে নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু তার সবটাই খারাপ। আচ্ছা স্যার, আপনার কি মনে হয় শৈলী ম্যাডাম খারাপ মেয়েছেলে?'
'কি বলছো এসব?'
'বড় স্যার তো সবাইকে তাই বলে। স্যার জানেন, বড় স্যার শৈলী ম্যাডামকে অনেকদিন রুমে গিয়ে নানান রকমের প্রস্তাব দিত।আমি নিজে দেখেছি। কিন্তু উনাকে কোনদিন একবারও সাড়া দিতে দেখি নি। এমন একটা মানুষ কি খারাপ হতে পারে?'
'দেখ, হানিফ, কে কি বলল এসব কানে নিয়ে লাভ নাই। আমাকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। কিন্তু তুমি কখনো দেখেছো আমি এই নিয়ে কারো সাথে কথা বলেছি?
'না, স্যার।'
'তাহলে, বুঝতে হবে। মিস শৈলী একজন ভালো মানুষ।এই জগতে ভালোমানুষফের চলাফেরা করা একটু কঠিন।'
'স্যার, গতমাসে আমার স্ত্রীকে হাসপাতালে নিতে হয়। আমার একটা বাচ্চা হয়েছে।স্যার, জানেন শৈলী ম্যাডাম আমার হাসপাতালের সব বিল দিয়েছেন?'
'কি বলো?'
'হ্যাঁ। উনি এও বলেছেন আমি যাতে এই কথা কাউকে না বলি।'
হানিফের সাথে কথা শেষ করে আমি আমার ডেস্কে চলে আসি। মিস শৈলীর প্রতি সম্মানে আমার মাথা নুয়ে আসছে। ভদ্রমহিলা একা একা থাকেন একটা ফ্ল্যাটে। এখনো বিয়ে করেন নি। তার ভাষায়,' তিনি বিয়ের জন্য যোগ্য কাউকে পান নি। কিংবা উনি নিজেই অযোগ্য।'
খুব সকালে আমার ঘুম ভেংগে যায় অফিস এসিস্ট্যান্ট হানিফের ফোন কলে। হানিফ যা বলেছে তাকে একটা দুঃস্বপ্ন বলে চালিয়ে দিতে মন চাইছে। হানিফ যা বলেছে তার সারমর্ম টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজের একটা খবর।
"বেড়িবাঁধে তরুণীর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার পুলিশের। পুলিশের ধারণা ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তাকে। তরুণীর ভ্যানিটিব্যাগে একটা আইডি কার্ড পাওয়া যায়। নাম শৈলী হক, বয়স ৩৫। "
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:১০