আমি হাসপাতালে বসে আছি আধা ঘন্টা যাবত।ব্লাড দেওয়ার জন্য যে ভদ্রমহিলাকে ফোন দিয়েছিলাম তিনি ফোন ধরছেন না।কেউ ফোন না ধরলে এক সময় প্রচণ্ড বিরক্ত লাগত।যদিও আর এখন লাগে না।মনকে বুঝাই ওপাশের মানুষটা হয়তো অন্য কোন কাজে ব্যস্ত আছে কিংবা ফোন ধরার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন তিনি।
আধ ঘন্টা পর ভদ্রমহিলা আমাকে ফোন দিলেন।আমাকে বললেন বাবা আমি আসলে খুবই দু:খিত।তুমি আর একটু বসো আমি আসছি দশমিনিটের মধ্যে।অপরিচিত মানুষদের রক্ত দিতে গেলে মাঝে মধ্যে একটু ঝামেলায় পড়তে হয়।তবে আমি যে দশবার রক্ত দিয়েছি এর আটবারই অপরিচিত রোগী ছিল।ফেসবুক থেকে নাম্বার টুকে নিয়ে ফোন দেয়া এরপর ব্লাড দিতে যাওয়া।অপরিচিত একজন ডোনার হয়ে রোগীর আত্মীয়স্বজনের বিস্ময় মাখা চেহারা দেখতে ভালোই লাগে আমার।এই অপরিচিত মানুষগুলোর আচরণ দেখলে নিজেকে মহান মহান মনে হয়।মনে হয় নাহ, আমি ভালো কিছু করতে পারলাম।মাঝে মধ্যে নিজেকে মহান ভাবে দেখার আনন্দ আছে।যদিও রক্তদানে মহত্ত্ব টাইপ কিছু আমি পাই না।উপরওয়ালা আমাকে দিয়েছেন আর আমি অন্যজনকে দিচ্ছি।আমি শুধু মিডিয়া।আর এজন্য আমাকে উপরওয়ালা কত কিছু দিয়ে টোল দিচ্ছেন! বরং রক্ত না দেয়াটা অন্যায়। দায়িত্বে অবহেলা।এজন্য কঠিক কোন শাস্তির প্রয়োজন ছিল।
মিনিট দশেক পরেই ওই ভদ্রমহিলা আসলেন।আমার মায়ের বয়সী একজন।আমাকে অনেক বার সরি বললেন। আমি বেশ বিব্রত হচ্ছিলাম।আমি বললাম আন্টি এটা কোন সমস্যা না।আপনি হয়তো অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন।ভদ্রমহিলা বার বার বলছিলেন।আমি বারবার বিরক্ত হচ্ছি।মায়ের বয়সী কারো কাছে কেউ সরি আশা করে না।মায়েদের সরি বলার রেওয়াজটা ধরাধামে চালু নাই। এই কাজটা উপরওয়ালা চালু করেন নি। দেখতে ভালো লাগে না।আমি তাকে বললাম আপনি আমার মায়ের মত।এভাবে বললে আমি খুব বিব্রত হচ্ছি।উনি এরপর স্বাভাবিক হলেন।আমাকে বললেন দেখ বাবা, আসলে এখানে আমি আর তোমার আংকেল আছেন আর আমার একমাত্র মেয়ে।ও তার বাবার সাথে আছে।আমাকে একটু অন্যজায়গায় টাকা আনতে যাওয়া লাগল।বুঝলা বাবা, মেয়েটাকে এই শহরে একা একা ছাড়তে খুব ভয় লাগে।আমি বললাম আমার কোন কাজ ছিলো না ,আমি কিছু মনে করি নি ।
একটা ফর্ম পূরণ করার পর আমার কাছ থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত নিলো স্যাম্পল হিসেবে।এরপর বলল বাহিরে গিয়ে বসুন। ১ ঘন্টা পর আসবেন।ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন তুমি কিছু খেয়ে আস।আমি একটু তোমার আংকেলের কাছে যাই।আমি বললাম আন্টি ,আমি এখানে বসি।আপনি ঘুরে আসেন।উনি বললেন না তুমি যাও কিছু খেয়ে আস।আমি বাধ্য হয়ে নীচে গেলাম।৩০ মিনিট পর ফিরে আসলাম।দেখলাম ভদ্রমহিলা ব্লাড ব্যাংকের সামনে বসে আছেন।আমাকে দেখে হাত ধরে বললেন কি খেয়েছ? আমি এটা সেটা বলে পার পেলাম কোনভাবে।হঠাত মায়ের কথা মনে পড়ছছিল খুব।নারীর মাতৃরূপ ব্যাপারটা অদ্ভুত সুন্দর।
-তোমার বাসা কোথায়,বাবা ?
-এইতো আন্টি কাছেই ,কলাবাগান।
-কে কে আছে এখানে?
-আমি একাই।বন্ধুদের সাথে থাকি,মেসে।
-ও আচ্ছা।দেশের বাড়ি কোথায়?
-কুমিল্লা।
-আমাদের গাজীপুর। তোমার আংকেল কুমিল্লায় চাকুরী করতেন।আমরা কুমিল্লা ছিলাম অনেকদিন।
-কুমিল্লা কোথায়?
-শহরেই।
-ও আচ্ছা।
এরপর উনার সাথে অনেক কথা হলো।এক ঘন্টা পর আমি রক্ত দিতে গেলাম।রক্ত দেয়ার পর উনাকে নিয়ে ক্যান্টিনে গেলাম।কিছু খেয়ে এরপর আমি চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।হঠাত মনে হলো রোগী তো দেখা হলো না।আমি উনাকে বললাম আন্টি আমি কি আংকেলকে দেখে আসতে পারি একবার?
আন্টি বললেন কি বলো! অবশ্যই। আমি ভাবলাম তুমি ব্যস্ত তাই আর আমি তোমাকে বললাম না।আচ্ছা আসো।কি মনে উনি কাকে কল দিচ্ছিলেন।সম্ভবত তার মেয়েকে।কিন্তু উনি যে নামটা বললেন তার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।
অবন্তী বলেছিল কখনো তার সামনে না যেতে।আমি কি তবে আজ তার সেই বারণ অমান্য করছি?সব কিছু মিলিয়ে আমি উপরওয়ালাকে বারবার দোষারোপ করছি তিনি আমাকে এভাবে না মেলালেও পারতেন।আমি আন্টিকে বলছি আমি যাব না।আমাকে একটু বাসায় হবে।উনি কোনভাবেই আমাকে যেতে দিলেন না।আমি ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছিলাম দরজার সামনে।উনি বারবার কলিংবেল দিচ্ছেন কিন্তু ওপাশ থেকে দরজা খুলছে না।আমি চাইছিলাম এই দরজা যাতে কখনো না খোলে।আমি বললাম আন্টি ইলেক্ট্রিসিটি নাই।উনি বললেন, ওহ তাই নাকি !এরপর উনি দরজায় টোকা দিলেন।অবন্তী দরজা খুলল।অবন্তী আমাকে দেখে রাগ করল না ।কারণ এই অবন্তী আমার অবন্তী ছিল না ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৪১