আজকের পৃথিবীতে বর্তমানে বহুল আলোচিত বিষয় হচ্ছে উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশ ক্রান্তিয় (Topical) মৌসুমি (মৌসুমি জলবায়ু হচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে যে অঞ্চলের বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তন হয়ে থাকে) জলবায়ু অন্তর্গত একটি দেশ তাই কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তির নিকটবর্তী অঞ্চলের মধ্যে বিস্তৃত এ অঞ্চলে জলবায়ুর ব্যাপক তারতম্য ঘটেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগ রয়েছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার।
ক্রমবার্ধমান জনসংখ্যার চাপ আর পৃথিবীব্যাপী জীবাশ্ব জ্বালানীর (কয়লা, পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাসকে জীবাশ্ব জ্বালানী বলা হয়) অতিব্যবহারে দ্রুতহারে তৈরী হচ্ছে উষ্ণায়ন। আর উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহের বরফ গলতে থাকায় সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দিন দিন প্রানঘাতী দুর্যোগের ঝুকিঁ প্রবল হচ্ছে। বরফ গলে যাবার এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ পানির নিচে চলে যাবে বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। হুমকির মুখে পড়ছে জগতের জীব বৈচিত্র, বিলুপ্ত হয়ে যাছে প্রণিকুলের অনেক প্রজাতি।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারন হিসাবে আমরা দেখিঃ
জীবাশ্ব জালানীর সর্বোচ্চ ব্যবহারঃ বিশ্বের মোট শক্তি ব্যবহারের ৮১শতাংশ জীবাশ্ম জালানি। গ্যাসোলিন (গ্যাসোলিন হলো প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া ক্রুড ওয়েল বা জ্বালানী তেল যা পরিশোধের মাধ্যমে পাওয়া যায় আমরা সেটাকে পেট্রোল হিসাবে চিনি) কয়লার মতো জীবাশ্ব জালানীর ব্যবহারে বায়ু মন্ডলে কার্বন নিঃসরন বেড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে পৃথিবীব্যাপী জীবশ্ম জালানির অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে আজকের বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকির নাম এখন কার্বন নিঃসরণ। বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের শির্ষ তালিকায় রয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ সমুহ।
কার্বন নিঃসরণ সীমিত করার মাধ্যমে পৃথিবীর উত্তাপকে কমিয়ে আনা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার একমাত্র উপায়। এ লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৩০ সালের মধ্যে ৫৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরন কমিয়ে আনার অঙ্গিকার করেছে এবং চীন ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ দেশ হবে বলে অঙ্গিকার করেছে। তাহলে বন্যা, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ফসলের বিপর্যয়ের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
তেজক্রীয় দুষনঃ তেজস্ক্রিয়তাজনিত দূষণ মানুষের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর এক ধরনের অদৃশ্য দূষণ।বিশ্বজুড়ে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য অপসারণের সমস্যা জনসমাজে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে যা সমুদ্রের চারপাশে বসবাসরতদের জন্য একটি বড় আতঙ্কের বিষয়। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিক্ষেপের ঘটনায় দক্ষিণ এশিয়াসহ ভারত উপমহাদেশের জনগণের উদ্বেগ বেড়েছে। পারমাণবিক চুল্লি থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ , চিকিৎসা ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপগুলি থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক কণা এবং পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর ওর ভস্মগুলি পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে যে দূষণ ঘটায় , তাকেই তেজস্ক্রিয় দূষণ বলা হয় ।
বনভুমির তথা বনাঞ্চল ধ্বংশ করাঃ জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ইউনেপ- এর মতে, বিশ্ব জলবায়ু পবিবর্তন বা উষ্ণায়নের জন্য যেসব বিষয় দায়ী তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বৃক্ষনিধন। জলবায়ুর ক্রমশ উষ্ণতার জন্য ২০ ভাগ দায়ী করা হয় পৃথিবীতে বন ধ্বংসের ধারাবাহিক কার্যক্রমকে।
ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের হিসাব বলছে, ২০২০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রায় ২ লাখ ৫৮ হাজার বর্গকিলোমিটার বন ধ্বংস হয়েছে, যা আয়তনের দিক দিয়ে যুক্তরাজ্যের চেয়েও বড়।
গাছপালা নিধনের ফলে আমরা যে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছি। অন্যদিকে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ুপ্রবাহের উষ্ণতা স্বাভাবিকভাবেই শীতল অবস্থায় থাকা বনভূমির বায়ুর সংস্পর্শে কমে এবং এর ফলে বৃষ্টি হয়।
ওজোন স্থরের ক্ষয়ঃ বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকে রয়েছে ওজোন স্তর, যা সূর্য থেকে নির্গত ক্ষতিকর রশ্মিকে আমাদের এই পৃথিবীতে আসতে দেয় না। ওজোন স্তর যদি না থাকে তাহলে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি আমাদের এই পৃথিবীতে এসে পৌঁছাবে যা মানুষ, প্রাণী এবং উদ্ভিদের জন্যে ক্ষতিকর । ওজোন স্তরের হ্রাসের ফলে আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান, যেমন— উষ্ণতা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহের দিক ও গতি প্রভৃতির পরিবর্তন ঘটেছে।
ওজোনস্তর রক্ষার জন্য ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কানাডার মন্ট্রিলে ‘মন্ট্রিল প্রটোকল’ গৃহীত হয়েছিলো। জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্র এই প্রটোকল স্বাক্ষরও করেছিলো।
মন্ট্রিল প্রটোকল (Montreal Protocol) হলো বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তর রক্ষা বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি বা প্রটোকল, যার পুরো নাম Montreal Protocol on Substances that Deplete the Ozone Layer। ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, কানাডার মন্ট্রিলে প্রটোকলটি গৃহীত হয় এবং কার্যকর হয় ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি। মন্ট্রিল প্রটোকলের লক্ষ্য হলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে অবস্থিত ওজোন স্তরের ক্ষয়কারী রাসায়নিক পদার্থের উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা। প্রাথমিকভাবে, প্রটোকলটিতে ৪৬টি দেশ স্বাক্ষর করে, এই চুক্তিতে এখন পর্যন্ত বর্তমানে ১৯৭ টি দেশ এই প্রোটোকলের সাথে চুক্তিবদ্ধ আছে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট মন্ট্রিল প্রটোকল অনুস্বাক্ষর করে।
মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়ন হলে ওজোন স্তরের ক্ষয় অনেকটাই রোধ করা যাবে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কেবল তাপমাত্রাই বাড়বে না, বর্ষাও হবে দীর্ঘমেয়াদি, বাড়বে খরা। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এশিয়ার ৪ কোটি মানুষ জলবায়ুজনিত উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।
বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এই মুহুর্তে বাংলাদেশের করনীয় কি তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা, গোলটেবিলে বৈঠক সভা সেমিনার প্রায় প্রতিদিনিই কোন না কোন সংস্থা, সরকারি বেসরকারি সংগঠন আয়োজন করছে এবং অনেক পরিকল্পনাও করছে।
তবে বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ) গঠন করে তা বাস্তবায়নের জন্য জলবায়ু ট্রাস্ট আইন-২০১০ নামে একটি আইনও প্রনয়ন করেছে। (Click This Link)
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রকল্প বা কর্মসূচি গ্রহণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অভিযোজন (Adaptation), প্রশমন, (Mitigation), প্রযুক্তি হস্তান্তর (Technology Transfer), এবং অর্থ বিনিয়োগ (Finance & Investment) এর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক গবেষণা এবং অনেক কর্মসূচি রয়েছে এ ট্রাষ্টের।
ছবি ও তথ্য সুত্রঃ
১। জার্মান ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষনা সংস্থা ‘জার্মান ওয়াচ’-২০২১
২। বিবিসি বাংলা
৩। উইকিপিডিয়া
৪। প্রথম আলো
৫। গুগল
১. ২৩ শে নভেম্বর, ২০২২ রাত ৮:৪৬ ১
উন্নয়ন, সূখ আর ভোগ বিলাসিতার নামে এমন আত্মঘাত- পৃথিবীর অন্য কোন প্রাণীকুলে সম্ভব নয়।
এবারের কপ২৭ লস এন্ড ড্যামেজ দিতে সম্মত হয়েছে মাত্র।
কিন্তু ক্ষতিপূরণের চেয়ে এই ক্ষতিটা যাতে না হয় সেই উদ্যোগের আহবান কেউ রাখছে না।
কারণ- ঐ যে আমরা আমরাই!
চার্টে সবচে বেশি কার্বন নিস্বরণকারী যে তারা তারাই....
তবে প্রকৃতি ছেড়ে কথা কয়না। আর বাছ বিচারও করেনা!
ধ্বংস যখন শুরু হবে - আমরা তোমরা কেউই তা থেকে রেহাই পাবো না।
মানুষের হুশ ফিরুক।
ক্ষমতাবানদের অর্থহীন ক্ষমতার দম্ভের প্রতিযোগীতা বন্ধ হোক।
আপাত বাহ্য সূখের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী বিশ্ব সুরক্ষায় সকলের চেতনা জাগ্রত হোক।
+++