ক্বদর রাতের দিনক্ষন সম্পর্কে সর্বদা কিছু বিতর্ক রয়েই গেছে যুগ যুগ ধরে। বাংলাদেশে, আমরা যেন প্রায় নিশ্চিত যে ২৭তম রমজানই সেই দিন। যদি আমরা এমনকি এটি সঠিক বিবেচনা করি তবেও বিভ্রান্তির বিষয় আসে যে, বাংলাদেশের রমজানের ২৭ তারিখে মক্কায় ২৮ তারিখ হয়, যে স্থানে কোরআন নাজীলের ঘটনাটি ঘটেছে সেখানকার সাথে সময়ের তারতম্য রেখে কীভাবে মক্কা ব্যতিত অন্য স্থানে সঠিক দিনক্ষণ পাওয়া যেতে পারে। Traditional মোল্লা / মৌলোভিগণ কিছু খোঁড়া উত্তর দাড় করেই খুব খুশি থাকবেন, যেমন বলবেন এটি অলৌকিক বিষয়; কিংবা লাইলাতুল কাদের সন্ধানের জন্য শেষ ১০ দিন ধরে সন্ধান করে যাওয়ার কথা। অন্য দল নবীজির বক্তব্যকে রিজিডলি মেনে চলার পরামর্শ দেবেন এর সত্যিকার সমাধান খুঁজে পাবার চেষ্টা না করেই। তাঁরা এমনকি এই কথাতে সীমাবদ্ধ না থেকে বলেন যে, ইসলাম ইচ্ছাকৃতভাবে এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করে নি। আমার বিবেচনায় এ বিষয়ে জানার জন্য চেষ্টা বলবৎ রেখে বর্তমানে এভেইলেবল বিজ্ঞান ব্যবহার করেই উত্তর পাওয়া সম্ভব। আমাদের অবশ্যই এ জাতীয় বিভ্রান্তি বা সন্দেহ নেওয়া উচিত নয় যে নবী (সাঃ) এর বাণীর কোনও অংশ পর্যাপ্ত হবে না। এমনকি উপলব্ধ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও এটি বোঝা সম্ভব যে ইসলামী সকল রিসোর্স কর্তৃক সরবরাহিত সমস্ত তথ্য বৈজ্ঞানিক প্রমাণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এ বিষয়কে অনুমানমূলক বর্ণনা বলে উপেক্ষা করা যায় না। মুল বিষয়টি খুবই কম্প্লেক্স এবং এটি বোঝার জন্য কিছু ভৌতবিজ্ঞানের তথ্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এখানে বিভ্রান্তি হচ্ছে দুটি ভিন্ন সময় নিয়ে, যাকে বলা যায় সময় বা টাইম ডাইমেনশনের দুটি পয়েন্ট। তবে এ দুই পয়েন্টর সাথে যে দুটি বা তারঅধিক স্থান জড়িত তা ভুলে গেলে চলবে না, একটি হ'ল মক্কা এবং অন্যটি হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকের জন্য আমাদের নিজস্ব সংশ্লিষ্ট স্থান যেখানে আমরা ঠিক অবস্থান করছি। স্পষ্টভাবে বুঝতে, আমরা কেবল একক সময় বা স্থান সম্পর্কে ভাবতে পারি না, আমাদের স্পেস-টাইম ধারাবাহিকতা (স্পেস-টাইম কনটিনিউয়াম) বিবেচনা করা দরকার। এই সংজ্ঞাটি প্রথমবার আইনস্টাইন দিয়েছিলেন যখন তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, স্থান এবং সময়, পৃথক এবং সম্পর্কযুক্ত ঘটনার পরিবর্তে, আসলে একক ধারাবাহিকতায় (স্পেস-টাইম) অন্তর্নির্মিত যা একাধিক মাত্রা বিস্তৃত। স্পেস-টাইম ধারাবাহিকতা চারটি মাত্রা নিয়ে গঠিত: স্থানের তিনটি মাত্রা (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা… বা উপরে / নীচে, বাম / ডান এবং সামনের / পিছনে, আপনি যেভাবেই ভাবতে চান) এবং সময় হচ্ছে চতুর্থ মাত্রা। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বগুলি অন্যান্য বিজ্ঞানীদের স্থান এবং সময়ের মধ্যে সম্পর্ক বের করতে উৎসাহিত করেছিল। কারণ স্পেসের রয়েছে ৩টি মাত্রা এবং সময় ১-মাত্রিক, স্পেস-টাইম তাই ৪-মাত্রিক বস্তু বলে বিবেচিত হবে। এটি একটি 'ধারাবাহিকতা' বলে মনে করা হয় কারণ যতদূর আমরা জানি, স্থান বা সময়ের মাঝে কোনও অনুপস্থিত পয়েন্ট নেই এবং আকার বা সময়কালের কোনও আপাত সীমা ছাড়াই উভয়ই বিভক্ত হতে পারে। সুতরাং, পদার্থবিজ্ঞানীরা এখন নিয়মিতভাবে আমাদের বিশ্বকে এই ৪-মাত্রিক স্পেস-টাইম ধারাবাহিকতায় এম্বেড করার জন্য বিবেচনা করেন এবং সমস্ত ঘটনা, স্থান, ইতিহাস, ক্রিয়া স্পেস-টাইমে তাদের অবস্থানের ভিত্তিতে বর্ণনা করেন। অতএব, সময়ের সাথে সম্পর্কিত আন্তঃ বোনা বা ইন্টারওভেন স্পেসের একটি নির্দিষ্ট জায়গার একটি ইভেন্ট অন্যান্য স্পেস-টাইম পয়েন্টের জন্য একই ইভেন্ট হতে পারে। কিভাবে? এখানে সে পয়েন্টটি যদি কোন বায্যিক শক্তি দিয়ে কম্প্রেস্ড করে সিঙ্গুলারিটি বা একক পয়েন্টে নেয়া হয়। এটি অলৌকিক নয়, বরঞ্চ এটি আমরা দেখতে পাই মহাকর্ষীয় এককত্বের বিশ্লেষণে। মহাকর্ষীয় এককত্ব, স্পেসটাইম সিঙ্গুলারিটি বা কেবল এককত্ব এমন একটি অবস্থা যেখানে মহাকর্ষ এতটাই তীব্র যে স্পেসটাইম নিজেই বিপর্যয়করভাবে ভেঙে যায়। এই হিসাবে এককত্ব সংজ্ঞা অনুসারে তখন আর নিয়মিত স্পেসটাইমের অংশ থাকে না এবং "কোথায়" বা "কখন" সেখানে থাকে না। সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে মহাকর্ষের বর্তমান তত্ত্ব ব্যবহার করে এককত্বের একটি সম্পূর্ণ এবং সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ এখন পর্যন্ত একটি কঠিন সমস্যা হিসাবে রয়ে গেছে। মাধ্যাকর্ষণ এককত্বগুলি মূলত সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রসঙ্গে বিবেচনা করা হয়, যেখানে ঘনত্ব স্পষ্টতই একটি ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রে অসীম হয়ে ওঠে এবং বিগ ব্যাং / হোয়াইট হোলের সময় মহাবিশ্বের প্রথম দিকের সময়ে ছিল বলে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক মতামত দিয়েছেন। এর অর্থ হ'ল একবার যখন মহাবিশ্বের ইভেন্টটি শুরু হয়েছিল, তখন এক ধরণের স্পেস-টাইম সিঙ্গুলারিটি বিদ্যমান ছিল। পবিত্র কুরআনের অবতরণ অত্যন্ত স্পেশাল একটি ঘটনা, এবং এটি হিউম্যান রেসের অন্য রকম প্রবাহের সূচনা ছিল। যদি আমরা হিউম্যার রেসকে একটি নদী হিসাবে বিবেচনা করি, তবে কুরআন অনুসরণকে বিবেচনা করা যায় নদীর একটি স্রোতের সাথে, যে স্রোত হিউম্যান রেসকে চূড়ান্ত এবং সফল গন্তব্যে নিয়ে যাবে। সুতরাং, মহাবিশ্বের এই জাতীয় ইভেন্টে সন্দেহাতীতভাবে এমন একটি অনন্য স্পেস-টাইম সিঙ্গুলারিটি পয়েন্ট থাকা সম্ভব যেখানে "কোথায়" বা "কখন" প্রশ্নটির অস্তিত্ব থাকবে না। লাইলাতুল ক্বদর খোঁজার জন্য রমজানের শেষ ১০ দিনের প্রতিদিনকে বিবেচনা করা বেশি বেশি ইবাদাত করার পক্ষে একটি কারণ সৃষ্টির ভাল আইডিয়া হতে পারে, তবে মুল প্রশ্নের একটি খোঁড়া সমাধান হবে। আবার ধর্ম এই নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সময় সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করেনি, এমন ধরনের চিন্তা করাটাও কোনভাবে ঠিক হবে না। ধর্ম, নবী(সাঃ) এর বাণীগুলো ঠিক যা দরকার, যে পরিমান দরকার, তেমনই সঠিক পরিমাণেই সরবরাহ করেছে। নবী(সাঃ), যিনি এতবড় কোরআনের প্রতিটি শব্দ হৃদয়ঙ্গমে পারদর্শি হওয়া সত্বেও, তাঁর পক্ষে ক্বদরের তারিখ ভুলে যাওয়ার ঘটনাটি মূলতঃ স্পেস-টাইম ধারাবাহিকতায় সিঙ্গুলারিটির অবস্থানের মূল বিষয়টি কতটা কম্প্লেক্স তার লক্ষণ হিসেবে দেখানো হয়ছে! মহাবিশ্ব স্পষ্টতই প্রতি বছর সেই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বা মাহেন্দ্রক্ষণে এসে উপস্থিত হয় এবং আমাদের স্রষ্টা চান যে তাঁর সেরা সৃষ্টিজীব মানুষ এটি সন্ধান করতে উদ্যত হোক। মুল উদ্যেশ্য কি, কেবল তাঁকে স্মরণ করার জন্য এবং তাঁর বাণীকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, নাকি এর ব্যবহার আরও বড় এবং অন্য কোন স্তরের সাফল্য অর্জনের জন্য, তা দেখার বা বোঝার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। শুধু এটুকুই এখন আমরা বুঝতে পারছি যে, স্পেস-টাইম কন্টিনিউয়ামের একটা মাহেন্দ্রক্ষণ রয়েছে যেটিতে এই স্পেস-টাইমের সৃষ্টিকর্তা একটি বিশেষ ঘটনার (ক্বোরআন মানুষের প্রতি অবতরণের) সংঘটন করেছিলেন, এবং এটি বর্তমান সময় অবধি আহরিত মানুষের জ্ঞান দ্বারা বোধগম্য বিষয়, কোন ম্যাজিক নয়। আল্লাহ আমাদের সমস্ত প্রার্থনা, ইবাদাত এবং ভাল কাজগুলো গ্রহণ করুন! আমিন!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০২২ রাত ১১:৩২