শুক্রবার অফিস বন্ধ । সারাদিন বিশ্রাম করার পর সন্ধার জমপেশ আড্ডাটা সেই পুরনো । আড্ডায় এখন দিন দিন লোক বাড়ছে । আগে ৩ জন হলে ও এখন সংখ্যায় আটজন । গাণিতিক হারে লােক বাড়ছে । এই সব লােকগুলোই সেই বাল্যকালের ইশকুল বন্ধু । প্রত্যাকটা বন্ধুই প্রতিষ্ঠিত এবং শিক্ষিত । তবে বেশির ভাগই স্কুল ও কলেজ শিক্ষক। যদিও আমার কাছে একজনকে ও ভালো শিক্ষক মনে হয় না । তাদের আচার আচরন আর মেয়ে সংক্রান্ত উচ্ছাস গল্প উপস্থাপনা আমি বরাবরই বিরক্ত । এরা গার্লস স্কুল ও কলেজের শিক্ষক তাই হয়তো মাথায় মেয়েলি ব্যাপারগুলো গিরপিক খায় । তবে খারাপ স্বভাবের নয় । তাই হয়তো এখনো বন্ধুর সঙ্গ ছাড়িনি । আমি কেমন তা জানি না , তবে খারাপ সঙ্গের সাথে মেলামেশা করা স্বভাব চরিত্র আমার কােন দিনই হয়নি । পশ্রয় ও দেয়নি । যারা এহেন বাজে আচরনে অভ্যাস্ত্য তারা অন্তরকূলে আজীবন ঘ্রিনিত । বন্ধুদের এই অবসর আড্ডাটা ব্যাস্ত বিরতি দিনে চলছে সব বারের মতো । আলোচনা সমালোচনায় মুখরিত সেই অন্ধ পােলের উপর । বৃহৎ পােলে একটু রাত হলে মানুষ ও যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ বললেই চলে । আর সেই সুযোগে আমাদের আড্ডার আসর জমতে থাকে অনেক সময় ধরে। হঠাৎ ব্যাস্ত আড্ডা থেকে আতিক মােবাইল দেখে বিস্মিত কন্ঠে স্তব্ধ করলো সবাই কে । বলতে লাগলো এই দেখ ফেসবুকে রবের কি নিউজ । সবাই তার মােবাইলে কাছে গিয়ে দেখলো ফেসবুকে রব একটা ছবি আপলোড দিয়েছে । সবার দােয়া চেয়েছে সবাই যেনো তার জন্য দােয়া করে । কিন্তুু রবের কি হয়েছে ? তা ছবির সাথে লেখা ছিলো না । রােগা একটা ছবি দিয়েছে । একটা সাদা সেন্ডু গেঞ্জি পড়া । মাথার নিচে একটা বালিশ , উপরে মশারিটা ঝুলানো । রবের পরিচয় রব আমাদের স্কুল বন্ধু । একটানা ১০ বছর এক সাথে পড়াশুনা করেছি । তবে ঠান্ডা স্বভাবের ছেলে আবার খুব মিশুক । তার সাথে যেকোন মানুষের একটা ভাব জমে যায় খুব তাড়াতাড়ি । গানওয়ালা মানুষ , সূরে সূরে কখন যে কার মন জয় করে কেউই বুজতে পারে না । তাই সবাই তাকে ভালোবাসি । ঢাকার একটা ছােট ব্যাংকে সে চাকরি করে । নামটা জানি না । বছরে দুইটা ঈদে তার সাথে আমাদের দেখা হয় । আতিক আর কিছু না ভেবে সাথে সাথে তার নাম্বারে কল দেয় । নাম্বার সংযোগ বিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে । এই মুহত্ত্বে কল যাচ্ছে না । তাই তার চাচাতো ভাইয়ের নাম্বারে কল দেওয়া হলো । চাচাতো ভাইয়ের কথা শুনে আতিক কিছুটা বিস্মিত ভাবে চােখ বড় বড় করছে । আতিক বলছে, এতো বড় রােগ কিন্তুু কিছুই জানলাম না আমরা । আতিক মুখ কালো চেহারায় সবাইকে জানালো রবের ক্যান্সার হয়েছে । সবাই সংবাদটা শুনে হতবম্ব , ক্যান্সার । সবার চেহারায় দুখের ছাপ পড়ে গেছে ক্ষণিকের ভিতরে । সংবাদটা শুনে আমার কষ্টটা মনে হয় বেশিই লেগেছে । এই একটা রােগ মানুষের জিবনের প্রতিদিন এক এক করে গনে রাখতে হয় । কবে যে হঠাৎ করে শেষ ডাক চলে আসে কেউ জানে না । অথবা বলে দেওয়া হয় আর মাত্র কয়েকটা দিন আপনার হাতে বাকি আছে । আমার বাবার ও একি সমস্যা হয়েছে । হঠাৎ ডাক্তার রিপোর্ট করলো বাবার ক্যান্সার হয়েছে আর বেশিদিন বাচঁবেন না । তারপর বেশিদিন বাচেঁন ও নাই । হঠাৎ আমাদেরকে একা ফেলে চলে গেছেন যেখান থেকে আর কেউ কখনো ফিরে আসে না । এই ব্যাথিত কষ্ট লালন করতে কত কষ্ট হয়েছে তার অনুতাপ যে পেয়েছে সেই জানে। যাই হউক রব এখন নিজ বাড়িতে আছে । তাকে সবাই দেখতে যাবো বলেই উঠে পড়লাম । ৫ জনের ৪ টা বাইক নিয়ে সোজা তার বাড়ির পথে । একটু সময় হলে ও তার বাড়িতে আমরা সবাই উপস্থিত হলাম । বাড়ির সামনা থেকে রব বলে ডাকতে লাগলাম । ঘর থেকে সবার আগে রবই বাহির হলো । আমাদের হতাশার ডাক শুনে বাসার সবাই বাহির হয়ে আসে । রব আমাদের দেখে কিছুটা অবাক হলে ও নিশ্চয় বুজতে পেরেছে তার অসুস্থের খবর শুনেই আমরা এসেছি । কিন্তুু রব কে দেখে বুজার কােন উপায় নেই সে কত বড় একটা রােগ বহন করে আছে । আমাদের দেখে প্রাণ খােলা হাসি হেসে আমিন্ত্রিত অতিথীর মতো ঘরে নিলো । তোরা আসবি এমনটা ভাবিনি । বন্ধ সালেহ সাথে সাথে বলে উঠলো বন্ধু অসুস্থ থাকবে আর আমরা দেখতে আসবো না। আমি বললাম কেমন আছিস এখন । তাের সমস্যাটা কি একটু বলতো ? আরে তেমন কিছু না । এই আছি ভালো । তােরা বস আমি আসছি । সবাই বললাম আরে তুকে কােথাও যেতে হবে না । তুই বস আমাদের সামনে । তার মাকে একটু আওয়াজ করে বললো মা আমার বন্ধদের নাস্তা দিও। আপ্যায়ন পরে হবে । তুর মাথার চুলতো দেখছি কিছুই নেই । হুমম, থাকবে কি করে । কেমু থেরাপি দিয়েছি । ক্যান্সার রােগী । ম্যালিগন্যান্ট টিউমার । গত ৩ মাসে চেন্নায় চিকিৎসা করেছি । কিন্তুু কােন লাভ হয় নি । এখন ঢাকা থেকে কেমু থেরাপি দিয়ে এসেছি । নিজের মতো করে সব বলে দিচ্ছে মনে হচ্ছে আমরা এ সব শুনতেই এসেছি । আর রােগ যেহেতু হয়েছে তার লােকানোর কি প্রয়োজন । তা যা বলার বলেই দিয়েছে । তবে কথা বলার সুস্থ্য মানুষিকতা দেখে বুজার কোন উপায় নেই বন্ধু ক্যান্সার রােগী । কখনো কখনো মানুষ অতি শােকে পাথর হয়ে যায় । হয়তো সেই রকম কিছু । আমার শরীরের অবস্থা দিন দিন খারাপের পথে ভালো থাকলে ও ভালো থাকতে পারছি না । মনে হয় আর বেশি দিন বাচঁবো না । ডাক্তার ও কিছু বলে না । আমার জন্য তাে আমার নিজের কােন ভয় নেই । মায়া ও নেই । কিন্তু মা আমার একা হয়ে যাবে । আমি ছাড়া যে আমার মায়ের আর কেউ নেই । এমন বলতে বলতে শিশুদের মতো চিৎকার করে কাধঁতে লাগলো , আজস্র পানি জড়ছে চােখের দুই কােনে । চােখ গুলো লাল হয়ে গেলো । আমি মারা গেলে আমার মাকে তোরা একটু দেখিস । এ একটা মিনতি তােদের কাছে আমার । তার কাদঁতে থাকা দেখে সান্তনা দিতে গিয়েও ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না । কি বলে সান্তনা দিবো ? আতিক ঘা ঘেষে জড়িয়ে বললো আরে পাগল, রােগ বালাই আল্লাহ প্রদত্ব , আল্লাহ মানুষকে রোগ দেন আবার ভালো করেন । তুই ও ভালো হয়ে যাবি । খালাম্মা আসলেন (রবের মা ) এমন পাগলামি করলে সুস্থ মানুষ ও অসুস্থ হয়ে যায় । বাবারা তােমরা একটু বুজিয়ে যাও ওকে , আমি আর পারছি না । রবের মন খারাপের ব্যাপারটা কবে ভালো হবে সেই খবর আমাদের জানা নেই । তারপরেও নিজেদের মতো করে বন্ধুর মন কে খুশি রাখার চেষ্টা করেছি । বিদায় নিয়ে বন্ধুর ঘর ছাড়লাম । এ যেনো শেষ বিদায় না হয় বন্ধুর সাথে । আল্লাহ কাজে প্রার্থনা করি বন্ধু যেনো সুস্থ্য হয় । ফিরে আসে আমাদের সেই আড্ডায় । গান ওয়ালার সুরেলা সুরে আবার গাইবে সেই গান :
বন্ধু তোরা কই আয় ফিরে আয়
ফিরে চল আবার আড্ডায় ।।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:১৮