দৃঢ়তা, একাগ্রতা, ইচ্ছাশক্তি ও সংকল্প আর এসবের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস থাকলে বাঙালীরা যে অসাধ্য সাধন করতে পারে তা বিশ্ব এর আগেও দেখেছে। জাতি এবারও তা অবলোকন করল যে, কচ্ছপের কামড়ের মতো লেগে থেকে কোনো কাজ করতে চাইলে তা--সুচারুভাবে না হোক--সম্পাদন করা অসাধ্য নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা এটি বিশেষ কিছু ক্ষেত্র (স্থান-কাল-পাত্র) ছাড়া করতে পারি নি বা পারি না বলেই একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেও এসে সালমা-করিমাকে মিডল ইস্টের শেখ-দের ‘শিশার তামাক’ সাজাতে হয়।
ব্যক্তিগতভাবে সেই শুরু থেকেই আমি অসংখ্যবার পদ্মা সেতুর আপডেট জানার চেষ্টা করেছি। ইউটিউবে ভিডিও দেখে আপ্লূত হয়েছি। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর প্রচেষ্ঠাতে চিন্তা করেছি--এই সেতুর ফলে কী ধরনের পরিবর্তন হতে পারে দক্ষিণ অঞ্চলের। যেমনটা যমুনা সেতুর কারণে উত্তরাঞ্চলে কাছের জেলাগুলোতে কিছুটা হয়েছে। পদ্মা সেতু, কালনা সেতুর পাশাপাশি আর কী কী পদক্ষেপ নেয়া যেত? এগুলো নিয়ে নিজের মতো করে ভেবেছি? লুপহোলগুলো খোঁজার চেষ্টা করেছি। একটি-দুটি ব্রিজের অভাব যে একটি জনপদকে পিছিয়ে দিতে পারে, এত কাছে থেকেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারে তা পদ্মা সেতুর পূর্বের ও পরের অবস্থা চিন্তা করলে আঁচ করা যেতে পারে।
কিছুদিন আগে মনে হয় এক সরকারী কর্মকর্তার জন্য দীর্ঘসময় পদ্মার ফেরির অপেক্ষার কারণে এক আহত কিশোরের মৃত্যুর ঘটনা নাড়া দিয়েছিল দেশবাসীকে। এইসব জমিদারি খামখেয়ালি (নাকি নিমকহারামী--জনগণের টাকায় খেয়ে পরে গতর মোটা করে জনগণের উপর জুলুমকে কি খামখেয়ালি বলা যেতে পারে?) ভোগান্তিরও অবসান হবে।
২
বিশ্বব্যাংক যখন এই প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল দুর্নীতির অভিযোগে, তখন অনেকের মতো আমিও ধরে নিয়েছিলাম আপাতত এই সেতু হচ্ছে না। এমন কি শুরুতে পিএম নিজেও এটা হয়ত বিশ্বাস করেন নি? সে সময়ের নিউজফিডগুলো দেখলেই তা বুঝা যায়; এর কারণও ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করা গেছে কারণ প্রবাসী ভাইদের (যাদেরকে আমাদের দূতাবাসের জমিদারেরা কামলা বলে এবং সেই অনুযাযী চরম খেদমতদারীও করে?) পাঠানো পেট্রো ডলার/ডলারের ঢল। রিজার্ভ বাড়তে শুরু করলে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে ‘ব্যালান্স অব পেমেন্টে’ কিছুটা ভারসাম্য আসলে পিএম-এর বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে। এর সাথে চীনা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের আশ্বাসও আস্থাকে সুদৃঢ় করেছে। ফলেই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি দেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রকল্পের (৩.৬ বিলিয়ন ডলার) বাস্তবায়ন। যে দেশের উন্নয়ন (এডিপি) বাজেটের অর্ধেক ক্রেডিট নামক হ্যাংগারে ঝুলানো থাকে, সে দেশে এ পরিমাণ ডলার ব্যয় করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কোনো পাগলেও একসময় চিন্তা করেন নি। প্রধানমন্ত্রী চিন্তা করেছেন এবং দীর্ঘ সময় নিলেও বাস্তবায়ন করেছেন এ জন্য দেশবাসীর প্রাণঢালা অভিনন্দন উনার শতভাগ প্রাপ্য। এ প্রকল্প দেশের ইতিহাসেও একটি মাইলফলক হিসেবেও বিবেচিত হবে এ কারণে।
এখন বিষয় হচ্ছে প্রকল্পটি সাসটেইনেবল ও সর্বোচ্চ ডিভিডেন্ট তোলার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি ও সুদূরপ্রসারী এক্সিট প্লান। পুরো দক্ষিণবঙ্গকে একটি সিঙ্গেল এনটিটি বিবেচনায় নিয়ে কানেক্টিং রোডগুলোকে চার লেনে উন্নিত করা। মংলা ও পায়রা পোর্টকে দ্রুত আধুনিকায়ন ও কনটেইনার হ্যান্ডেলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাতে ঐ অঞ্চলের শিল্পকারখানার পণ্য আমদানী-রপ্তানীতে চট্টগ্রামমুখী না হতে হয়। মৃতপ্রায় খুলনা শিল্পনগরীকে পুনর্জীবিত করে ঢাকার উপর চাপ কমানো। কুয়াকাটাকে দ্বিতীয় পর্যটন হাব বিবেচনায় নিয়ে সরকারী-বেসরকারি উদ্যোগে সহায়তা করা। এসব পরিকল্পনা ও টেকসই বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল পদ্মা সেতুর ফলে কাঙ্খিত ১.২ শতাংশ দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা পূরুন করা সম্ভব।
যে আশা-আকাঙ্খা বা স্বপ্নের বীজ পদ্মা সেতু বপন করেছে তার ফসল যেন দক্ষিণবঙ্গের মানুষ ঘরে তুলতে পারে দেশবাসী হিসেবে আমাদের সকলের এই কামনা। আর এর জন্য যমুনা সেতু ও উত্তরবঙ্গ একটি কেস স্টাডি হিসেবে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। বিশ বছরে যমুনা সেতুর ফলে অনেকটা পরিবর্তন হলেও এখনও কেন দেশের চরম দরিদ্র লোকের বাস সেখানের জেলাগুলোতে? এখনও কেন ভিটে-মাটি ছেড়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে খোলা ট্রাকের ছাদে স্বপ্ন ফেরি করে ছুটে আসতে হয় কংক্রিটের জঞ্জালে?
নেতা ও আমলারা এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী টেকসই পদক্ষেপ নিলে আশা করি জনগণের--না দক্ষিণবঙ্গ, না উত্তরবঙ্গ, না চলমান বন্যাপিড়িত পূর্ববঙ্গ--আক্ষেপ নিয়ে ঢাকাতে স্বপ্ন ফেরি করতে হবে না ভবিষ্যতে?
সুখী হোক দেশের সকল মানুষ।
********************************************************
@আখেনাটেন/জুন-২০২২
ছবি: পদ্মা সেতু
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০২২ রাত ৮:২৩