somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: সোনালী বালির প্রাচীর

১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“Destiny's what you make of it. You have to face whatever life throws at you.”
― Darren Shan, Hell's Heroes



‘’কলার খোসাটা এভাবে রাস্তার উপর ফেললেন কেন?’’ লোকটা উঁচু স্বরে কথাটা বলে চলে যাচ্ছিল। সাথে সাথে আমার মেজাজ গেল হট হয়ে। কাছে গিয়ে ঠাস করে দেড় টনি চড় হাঁকালাম। ঘটনার আকস্মিকতায় লোকটা মারাত্মক ভয় পেয়ে গেছে। আমি কুৎসিত কিছু গালি দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। এই সাধু বাবাদের জন্য সমাজে যে নিজের খুশি-রুচিতে চলব সেটাও হওয়ার জো নেই। এই ভদ্রলোকদের পাছার কাপড় খুলে প্যাঁদানো দরকার। এত ভদ্রগিরি কোথা থেকে আসে এদের!

আশেপাশে দুএকজন ঘটনাটা দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কারণ তারা আমাকে চেনে। এ ব্যাটা মনে হয় পাড়াতে নতুন ভাড়াটিয়া। আমাকে চিনলে আমার কর্মকাণ্ড নিয়ে বেগড়বাই করত না। আজ থেকে নিশ্চয় চিনবে। এই ভাড়াটিয়ারাও এক একটা হা*জাদা। মনে করে বাসা ভাড়া নিয়েছে মানে দুনিয়া কিনে নিয়েছে। এদের সবসময়ের জন্য শাল্টিং এর উপর রাখতে হবে। তাহলেই টনটাইট থাকবে।

মেজাজটাই খারাপ করে দিলো সকালবেলা। গলির মোড় থেকে বাসায় ফিরে আসলাম। বাসার ঢুকার আগে নিজেদের ঝাঁ-চকচকে বিল্ডিংটার দিকে তাকালে মনটা বেশ ফুরফুর হয়ে যায়। আজকেও তাই হল! আর ঘরে শিলার উপস্থিতি তো বেহেশতের এন্তেজাম! শিলা মাই ডিয়ার শিলা।

অথচ বছর দশেক আগেও এখানে ছোট্ট তিনটা টিনশেডের ঘরে গাঁদাগাদি করে থাকতাম বাবা-মা সহ আমরা চার ভাইবোন। সে সব কষ্টের দিনগুলো ভুলেও স্মরণ করতে চাই না আর। পাশে নিজেদের টিনশেডে থাকত দুটো হিন্দু পরিবার। উনারা ভিটেমাটি অামাদের কাছে অল্পদামেই বিক্রি-বাটা করে ভারতে স্থায়ীভাবে চলে গিয়েছে। এজন্য অবশ্য লোকে আমাদের দুই ভাইকে দোষ দেয়। ভূমিদস্যু বলে। ভাইয়া বলত মানুষ দোষ দিবেই। মানুষের কথা শুনলে উন্নতি হবে নাকি! এখন সেই জীর্ণ টেনশেডের ঘরগুলো আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়াতে জঁমকালো উনিশটা দামী অ্যাপার্টমেন্টে রূপ নিয়েছে। মাঝে মাঝে নিজেই চমকিত হই। ভাবি সবি ভবের লীলাখেলা!

অবশ্য বড় ভাই এজন্য প্রচুর খেটেছে। ওই আমার গুরু। কীভাবে চাঁদা তুললে আম-ছালা দুটোই বজায় থাকবে। কীভাবে মারামারী-কোপাকুপি করলেও পুলিশের অগ্রিম মিষ্টি পাওয়া যাবে? সবই ভাইয়ের শেখানো। টেন্ডার ধরার কলাকৌশল রপ্ত করা সবই বড় ভাইয়ের অবদান। সেই আমার নিষ্পাপ নিষ্কলুষ বড় ভাই দু দুটো কথিত খুনের মামলায় সাত বছর ধরে পলাতক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের লং বীচে বাস করছে। কমিশনার টেংরি সালামের খুনের ব্যাপারে ভাইয়াকে ফাঁসানো হয়েছে। এ ব্যাপারে আমার ভাইয়ের প্রতি শতভাগ আস্থা আছে। আমি নিজেও কিছু অপারশনে ছিলাম। এগুলো পাড়াতে হয়। নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে হলে এগুলোতে শামিল হতে হয়। না হলে অন্যরা ঘাড়ে চড়ে বসবে। এতে দু একটা বিলাই যদি মারাও যায় তাহলেই মামলা দিতে হবে! আজব এক দেশে বাস করছি আমরা। একটু দাদাগিরি করে যে ভালো মতো চলব সেটাও সুষ্ঠু মতো হবে না। ভদ্রলোকেরা এখানেও তাদের নোংরা নাকটা গলিয়ে দেবে।

যাহোক ভাইয়া এখন নিউইয়র্কে ক্ষমতাসীন দলের বড় পদে আছেন। ওখান থেকেই অনেক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত দেশে। কিছুদিন আগেই লেকের পাড়ের একটা জায়গা নিয়ে ঝামেলা চলছিল অন্য দুই পরিবারের। শেষে সামান্য কিছু টাকা খরচে ওটা আমরা কিনে নিয়েছি। ওটা দখলে নিতে ভাইয়া ও আমি বেশ খেটেছি। এখন ঐ বারো কাঠার প্লটে হাই রাইজ বিল্ডিং তোলার জন্য ডেভালপারদের সাথে কথা চলছে। ভাইয়ার এই গুণগুলোর জন্যই আমি উনার ভীষণ ভক্ত। বিদেশে থেকেও দেশের জন্য উনার কত মায়া! আর ঠিক এই বিষয়গুলোই শিলার একদম পছন্দ না।



ঘরে ফিরেই শিলাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু ওর বেঢপ পেটটার কারণে তা পুরোপুরি সমর্থ হলাম না। তাছাড়া ও আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়েও দিল। ওর আটমাস চলছে। আমাকে কাছে খুব একটা ভীড়তেও দেয় না। বলে আমার মতো কুলাঙ্গার থেকে বাচ্চাটি যতই দূরে থাকবে ততই মঙ্গল। আমিও মেনে নিয়েছি। কিন্তু বেবিটি শিলার পেটে আসার পর থেকেই সারাদিন মা ও বাচ্চার স্বপ্নে আমি বিভোর থাকি। ওর পিছে পিছে ঘুর ঘুর করি নেড়ি কুকুরের মতো। আমার জগত ইদানিং কিছুটা ছোট হয়ে এসেছে। ও সেটা লক্ষ করে আমি জানি।

এই অতীব রূপসী মেয়েটাকে আমার কেন জানি একটু ভয় ভয় লাগে। এটা কি নিজের অতি প্রিয় জিনিসটি হারিয়ে ফেলার ভয়? সব ক্ষমতাবান পুরুষেরাই কি এরকম কোনো না কোনো অজানা ভয়ের রাজ্যে বাস করে? দুনিয়ার আর কাউকেই ভয় পাই না শুধু শিলাকে ছাড়া। কেন? অনেক চিন্তা করেও এর উত্তর খুঁজে পাই নি।

একটু পরেই প্রিয় ডুকাতি সুপারবাইকটি নিয়ে নেতার বাসায় রওয়ানা দিলাম। আজকে তিন ও চার নম্বর ব্লকের ড্রেন ও ফুটপাত তৈরির দশ কোটি টাকার টেন্ডারের ব্যাপারে নেতাকে জানাতে হবে। কাজটা বাগাতে পারলে ইতি-উতি দিয়ে-থুয়েও কমছে কম তিন কোটি টাকা পকেটে আসবে। শুনছি হাতকাটা মকছুদের লোকজনও তদবীর করছে। এ তেলাপোকাটা ইদানিং উড়তে শিখেছে মনে হচ্ছে। ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করতে হবে। ভারতীয় গোদরেজের নতুন একটা কীটনাশক নেমেছে। তেলাপোকা বিনাশে বেশ কার্যকর শুনেছি। কাজে লাগাতে হবে মনে কয়।

নেতার অফিসে বসে অপেক্ষা করছি। মনে মনে ভাবছি একদিন আমিও ঠিক এভাবেই তদবীরকারীদের অপেক্ষা করাব। ভাবতেই মনটা চনমন হয়ে উঠল।

শিলা ফোন দিয়েছে। ও বিপি মাপার জন্য মোড়ের শফিক চাচার ফার্মেসীতে যেতে চায়। আমি জানালাম চাচা গিয়েই প্রেশার মেপে আসবে। ও প্রতিউত্তরে জানাল নিজে গেলে একটু হাঁটাহাটিও হবে।

শিলা। আমার দিলের টুকরা। আমার কেন জানি মনে হয় শিলা আমাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে। আবার একই পরিমাণ ভালোও বাসে। যদিও ব্যাপারটি বিদ্ঘুটে শুনায়। কিন্তু সত্য। ও নিজেও মাঝে মাঝে বলে সেইরকমই বলে। অবশ্য ঘৃণা না করাটাই অস্বাভাবিক হত। কারণ আমি যেভাবে ওকে বিয়ে করেছি তা কোনো মেয়েরই ভালোলাগার কথা না।

আসলে শিলাকে বিয়ে করাটা আমার অনেক অপরাধের মধ্যে একটি বড় অপরাধ। বছর পাঁচেক আগে যখন আমাদের নতুন বিল্ডিং হয়েছে, সেখানে শিলারা ভাড়াটিয়া হিসেবে আসে। ওর বাবা পেশায় একজন ডাক্তার। শিলা তখন হলিক্রসে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। একদিন লিফটে উঠার সময় ওকে প্রথম দেখি। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলে কথা আছে না! ওকে দেখার পর থেকেই বুকের বামপাশে চিকন একখান ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। এই পরীর মতো মেয়েটা কোথা থেকে আসল। শিলাও আমার হাভাতে তাকানো দেখে নিশ্চয় অামাকে এতক্ষণে কুকুর গোত্রীয় ভেবে বসে আছে।

যদিও আমি ঐ বিশেষ প্রাণীটির চেয়ে খুব একটা ভালো কেউ নই। ধাক্কাধাক্কি করে তিনবারের প্রচেষ্ঠায় এসএসসির ফাঁড়া কাটিয়েছি। বাবা-মার আরেক পশলা ধাক্কাধাক্কির চাপে পড়ে কারিগরী প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডিগ্রি নিয়েছি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। খালি মনে হয়েছে এত কষ্ট কেন লেখাপড়ায়? কানে ধরে শপথ নিয়েছি বেঁচে থাকতে আর বেলতলা মানে পড়াশুনার ধারে কাছেও যাব না। শুনে বিধাতা মুচকি হেসেছিল মনে হয়।

শিলাকে দেখার পরের দিনই পাশের একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে বিএসসি ইঞ্জিয়ারিং এর জন্য ফরম তুলে আনলাম। এ কাজ কেন করলাম, কি জন্য করলাম আমি নিজেও কিছুটা ধন্ধের মধ্যে। বাবা আমার নতুন করে পড়াশুনার খবর শুনে পাশের মসজিদে বিশাল মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করেছে।

তখনও তারা জানে না কেন এই পরিবর্তন আমার। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে শিলার পরিবারের শিক্ষার শানে নুযুল জানার পর মনে হয়েছে, এ জনমে তো দূর কি বাত, পরজনমেও শিলার বাবা আমার মতো লাফাঙ্গার সাথে ওর বিয়ে মেনে নিবে না। তাই নিজেকে একটু জাতে তোলার ধান্ধা আর কি! যদিও জানি এটা কোনো কাজ দিবে বলে মনে হয় না!

মাস তিনেক পরে শিলাকে যেদিন প্রথম আমি আমার ভালোলাগার কথা জানাই, সেদিনের ওর প্রতিটা কথা আমার মনে আছে। জবাবে স্পষ্ট উচ্চারণে শিলা বলেছিল, ‘আমি জানি আপনি আমাকে সেই শুরু থেকেই ফলো করছেন। আপনার চেহারা সুরত মাশাল্লা। দশে দশ। অর্থবিত্তে দশে দশ। সমস্যা হচ্ছে আপনার শিক্ষা ও দীক্ষা নিয়ে। এই জায়গাতে আপনি দশে এক। আমার বাবার কথা অনুসারে মানুষের উপরের দুটো বড় কোনো বিষয় নয়। পরেরটাই সব। সেই মতে আপনি আমাদের কাছে গার্বেজ। আর গার্বেজের অবস্থান কোথায় হয় তা নিশ্চয় জানেন। সুতরাং আপনার আর না এগুনোই বেটার। বেস্ট অব লাক মিঃ রবিন’। বলে আমার শিলা রাজেন্দ্রীর মতো মৃদ মন্দ কোমর দোলায়ে আমার চউক্ষের সামনে দিয়ে চলে গিয়েছিল।

আর হ্যাঁ, তখনি আমি বিয়েটা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। সেটা দশে এক থেকে দশে দুই-তিনে উত্তরণের পরেই।

পড়ার প্রতি দারুন মনোযোগী হলাম। এদিকে চলতে ফিরতে শিলাকে দেখি আর ভালোবাসার সুনামী বাঁধ দিয়ে আগলায়ে রাখি। কিছুতেই যেন উপচে না পড়ে। মনে মনে বলি আর কিছুদিন সবুর কর হে চান্দ্রেয়ী!

গুণ্ডাগিরি করা কিছুটা হলেও কমেছে। তবে বাদ দেই নি। হাড় বেআদবের খাতা থেকে ‘হাড়’ শব্দটি কেটে বেআদবে উওরণ ঘটেছে। পাড়ার মুরুব্বীরা কানাঘুঁষা করছে পোলা কিছু আদব লেহাজ শিখছে ইদানিং। সবি শিলার অদৃশ্য অবদান। শিলাও নিশ্চয় এগুলো লক্ষ করছে।

একদিন লিফটে শিলাকে একা পেয়ে মাথা আউলা-ঝাউলা হয়ে গেল। ভালোবাসার বাঁধ ভেঙ্গে যায় যায় অবস্থা। বালির জিও ব্যাগ ফেলতে শুরু করলাম কিনারায় যেন কিছুতেই না ভাঙ্গে। কংক্রিটের বোল্ডার ফেললাম। মনে হয় না আজকে তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। কি সুন্দর করে সেজেছে! মনে পড়ল আজকে পহেলা বসন্ত। হলুদ শাড়ি পড়েছে। সাথে মাথায় ফুলের মালা। ওফ, পাগল হয়ে যাব আমি। এই দুষ্টু পরীগুলোও ক্যামন যেন? বসন্ত হলেই এমন মারদাঙ্গা সাজতে হবে। এখনই গিটারে সুর তুলতে ইচ্ছা করছে। থাকতে পারলাম না। আবার আমি বেআদবের খাতা পাশে রেখে হাড় বেআদবের খাতা নতুন করে খুললাম। পরের দশ সেকেন্ড হাল্কা একটু ধস্তাধস্তি হয়েছিল লিফটে। গিটারের তার ছিঁড়ে ফেলেছি সুর তুলতে গিয়ে। একজনের কান্না আর আরেকজনের সিগারেট খাওয়া ঠোঁটে লিপস্টিক ও সাথে গালে পাঁচ আঙুলের দাগ নিয়ে দুজন দুদিকে চলে গিয়েছিলাম।

ফলাফল। শিলাদের পরের মাসে বাসা ত্যাগ। যাওয়ার আগে ওর বাবা মানে ডাক্তার সাহেব আমাকে বিশ শিক্কার একটি রামচড় দিয়ে গেলেন। শিলা ডান হাতি হলেও শিলার বাবা বাম হাতি। আদর্শবান পিতা ও মেয়ের এই সামান্য অমিলটুকু আমাকে আশাবাদী করল। আমি হাড় বেআদব থেকে ভীষণ ভদ্র হয়ে মাথা পেতে নিলাম এই আশির্বাদটুকু। হাজার হলেও হবু শ্বশুর। অন্য কেউ হলে চড় মারা হাতটা পাশের বিলাইছড়ির খালে পাওয়া যেত পরের দিন।



নেতার রুমে বসে বসে এসব পুরোনো কথা ভাবছি। তখনই ছোট বোন নায়লা ফোন দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে ছোড়দা তাড়াতাড়ি ইউনাইটেড হসপিটালে আস। শিলা ভাবীর অবস্থা ভালো না। আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। শিলা আটমাসের প্রেগনেন্ট। একটু আগেই ওকে সুস্থ দেখে আসলাম। এক ঘন্টাও হয় নি। হঠাৎ কি ঘটল! ঝাঁপ দিয়ে নেতার বাসা থেকে বের হলাম। গোল্লায় যাক টেন্ডার। আমার শিলা হাসপাতালে। আমার এই একটাই দুর্বলতা। শিলার কিছু হলে আমি জীবন্মৃত হয়ে যাব।

নায়লা কাঁদতে কাঁদতে জানালো শিলার ব্লিডিং হয়েছে অনেক। প্রিম্যাচিউর ডেলিভারী। বাচ্চাটা বেঁচে নেই। ভাবীর অবস্থাও আশঙ্কাজনক। আর কি বলছিল? ফোনটা পকেটে রেখে বাইকের দিকে দৌড় দিলাম।

কীভাবে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল? বাসাতে সকল প্রকার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া আছে, যাতে ওর কোনো প্রকার সমস্যা না হয়। বাবা-মা ও নায়লা সার্বক্ষণিক চোখ রাখে ওর উপর। এরপরও দুর্ঘটনা ঘটল। শিলার কথা যতই ভাবছি ততই বুকের ভিতর কান্না দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। কেন এমন হয়? এ নিশ্চয় আমার অতীত পাপের ফল। কিন্তু সেটা শিলার উপরে কেন? কেন আমি নই? ওর প্রতি আমার ভালোবাসার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আমার বাইকের পেছনে শান্টু বসে ছিল। আমি কাঁপছি দেখে শান্টু চালকের আসনে বসল। শিলাকে নিয়ে কত স্মৃতি! আমি শুধু ওকে কষ্টই দিয়ে গেলাম। একবুক চাপা ক্ষোভ, ঘৃণা ও কিছুটা ভালোবাসা নিয়ে হয়ত ও আমার সাথে থাকছে।

মনে আছে কিছুদিন আগে এক ভাড়াটিয়ার ভাড়া দু মাসের বকেয়া রেখেছিল। বেচারা নাকি গার্মেন্টেসের চাকরি খুয়ে এখন খুব খারাপ অবস্থায় আছে। এই কাড়ি কাড়ি টাকা কামাইকারী গার্মেন্টেসের মালিকপক্ষও হাড়ে হা...জাদা। একটুতেই কর্মচারীর চাকরি নট। আর এর ঝামেলা আমাদের মতো বাড়িওয়ালাদের পোহাতে হবে। কাঁহাতক ভালো লাগে। আমেরিকা থেকে ভাই পরামর্শ দিল পাছায় লাথি মেরে বের করে দে ছারপোকাটারে। ভাড়া বাকি রাখবে। এগুলো কোত্থেকে যে ঢাকা শহরে আসে। বড় ভাইয়ের কথা মতো লোকটাকে আল্টিমেটাম দিলাম। সময় চাচ্ছিল। ধমক দিলাম। নো সময়। পরে বেকার লোকটি আমাকে ভাড়াটিয়ার অধিকার নিয়ে কথা শুনাচ্ছিল। আমার মেজাজ সপ্তমে উঠে গেল। শান্টুকে ডেকে ঐ বিকেলেই লাথি মেরে বিদায় করলাম মালপত্র ছাড়াই। সে কি কান্নাকাটি ভাড়াটিয়ার বউয়ের। সাথে ছোট দুটো বাচ্চাও ভ্যাঁ ভ্যাঁ করছিল।

ঐ দিন সন্ধ্যায় দেখি শিলা লাগেজ নিয়ে বাপের বাড়ি যাচ্ছে। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে তো শিলা কখনও এভাবে যায় না। আমি কারণ জিজ্ঞেস করাতেই গোখরা সাপের মতো ফোঁস করে উঠল। মানে হচ্ছে আমার মতো নিকৃষ্ট জীবের সাথে আর এক মুহূর্তের জন্যও নয়। বাবা-মা ওর এই চলে যাওয়ার ব্যাপারে সায় দিয়েছে। মনে মনে বললাম, রসুনের গোয়া এক জায়গায় হয়েছে।

কথা দিলাম ঐ ভাড়াটিয়াকে আজকেই আবার এই বাসাতেই ফেরানো হবে। আমি মানুষ খারাপ হতে পারি কিন্তু বউয়ের অবাধ্য নই (সব ব্যাপারে নয়)। পরে সেই ভাড়াটিয়ার হাতে পায়ে ধরে আবার ফিরে আনলাম। এ কি সহজ কাজ! শুধু আমার শিলার জন্য। আর ভাড়াটিয়ারে বলে দিলাম যতদিন নতুন চাকরী না হয়েছে ততদিন ভাড়া দিতে হবে না। আজ থেকে আপনি আমার মায়ের পেটের ভাই। আজীবন এই ফ্লাটেই থাকুন নিজের মনে করে। সাথে এও বলে রাখলাম নগদ কিছু লাগলেও যেন আমাকে বলে।

ঐ দিন রাতে শিলা আমাকে ভীষণ আদর করেছিল। নানা অঘটন-ঘটনের বিয়ে। সেই বিয়ের একবছর ধরে ভিক্ষুকের মতো দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকলেও শিলা আদর ভিক্ষা দেওয়াতে দেশের সেরা কৃপণকেও হার মানিয়েছে। যে একমুঠো দুমুঠো দিত কাড়া-আঁকাড়া না ভেবে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতাম। কিন্তু সে রাতে আদরের সিডর উঠেছিল আমাদের পনেরো বাই আঠারো-ফুটের দেয়ালঘেরা রুমে। যার আটমাস পরে শিলা এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। শুধু আদরের ফসলটুকু ঘরে তুলতে পারলাম না। এগুলো ভাবতে গিয়ে চোখে পানি বাধা মানছে না।

যে আমি শুক্রবারের নামাজও ঠিকমত পড়ি না সেই আমি ওয়াদা করলাম শিলা সুস্থ হয়ে ফিরলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী হয়ে যাব। মনে মনে এবার ওমরা হজ করারও প্লান করলাম। কাতল পীরের দরবারে গরু সদকার ওয়াদা করলাম। হাতি খাদে পড়েছে।

শিলার ছোটভাই মবিন দেখি হাসপাতালের গেটেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি যাওয়ার সাথে সাথেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদাকাটি শুরু করে দিল। আমার চোখও দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। বুকটা খালি খালি লাগছে। ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। মনে হচ্ছে আমি শিলাকে বিয়ে না করলেই হয়ত ওর এরকম অবস্থা হত না!

মবিনকে জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে এটা ঘটল? মবিন বেশ রাগত স্বরে চিৎকার করে বলল, ‘শিলাপা, শফিক সাহেবের ফার্মেসিতে ব্লাড প্রেশার মাপার জন্য নেমেছিল আপনার ছোটবোনের সাথে। কোন শুয়োরে নাকি আপনাদের গলির মুখে রাস্তার উপর কলার খোসা ফেলে রেখেছিল। ওটার উপর পা পিছলেই শিলা আপা পাশের…’

মবিন আর সব কি যেন বলছিল! আর আমার কানের কাছে কথাগুলো গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের মতো এসে বিঁধছে। এভাবেও প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে পারে। মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। খালি মবিনকে একটি কথা আস্তে করে বলতে পারলাম, ‘‘শুয়োরটা তার নিজের বাচ্চাকেই খেয়ে ফেলেছে রে মবিন। বাচ্চার মাকেও...’’। ...এরপরই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশে...।

***********************************************************************
অাখেনাটেন/অক্টো-২০১৮


সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:৩১
৬৩টি মন্তব্য ৬৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×