কেন এরকম হয়? এর পেছনের কারণ কী? লাস্ট বলে ছক্কার পরে কেন অন্ধকার রুমে চোখের পানিরা বাঁধ উপচে পড়ার পাঁয়তারা করে? কেনই বা এমনটা মেনে নিতে ভীষণ ভীষণ রকম কষ্ট হয়?
আমার মনে আছে। এশিয়া কাপের যে ফাইনালে বাংলাদেশ পাকিস্থানের কাছে হেরে গিয়েছিল তখন আমি ভারতের একটি বড় শহরে। খেলা দেখার জন্য তাই ভারতীয় বন্ধুদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে পপকর্ন নিয়ে বসে পড়লাম। সেদিন আশা জাগিয়েও দুই রানে হেরে গেলে আমার চোখের জলের বন্যা দেখে ভারতীয় বন্ধুরাও ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তারাও বাকরূদ্ধ। তারাও ব্যথিত। কেন এমনটা হয়?
হলি আর্টিজনে হামলার পর বিদেশী বিভিন্ন সংবাদ-মাধ্যম কিংবা ফোরামে বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক খবর দেখে তখন কেন চোখ জ্বালাপোড়া শুরু করে? কেন গরীব এই দেশটির নেতিবাচক খবর অন্য দেশের পত্রিকায় সহ্য হয় না?
অথচ দেশে আমি নিজেই নানান নেতিবাচক দিক নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কারো সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি। কেন এটা হচ্ছে? কেন ওটা হচ্ছে? ওটা করলে কী আরো ভালো হত না? কেন শিক্ষায় ব্যয় এত কম? কেন মৌলিক গবেষণায় আমাদের দৃষ্টি নেই? অথচ একই কথা কোনো বিদেশী বন্ধু বললে কেন চোখে জল চলে আসে?
কেন বিদেশী পত্রিকায় দেশের পজিটিভ খবর হাতড়ে-পাতড়ে খুঁজে ফিরি এবং তা দেখতে পেলে চোখ জলে ভরে উঠে? কেন নেক্সট-১১, ২০৫০ এ বাংলাদেশ অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ, বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলা বিদেশীর মুখে শুনে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে?
কেন ইউটিউবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জাওয়েদ করিম, খান একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা সালমান খানদের নামের সাথে বাংলাদেশ যুক্ত থাকায় ভালোলাগার উষ্ণধারা চোখ দিয়ে গড়ে পড়তে চায়? যদিও জানি বাংলাদেশের সাথে তাদের এখন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। কেন হাই-রাইজ বিল্ডিং তৈরির জন্য টিউব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর জনক ফজলুর রহমান খানের নাম দেখলেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি? কেন শিল্পপতি কালিপ্রসাদের যুক্তরাষ্ট্রে নিজের অবস্থান দাঁড় করানো আর দেশে তার বিনিয়োগের খবর শুনে ভালোলাগার স্রোত বয়ে চলে?
কেন ডঃ ইউনুসের নোবেল পাওয়ার খবর শুনে চোখের পানি হু হু করে ঝরে পড়ে? কেন দীপঙ্কর তালুকদার, অমিত চাকমা, ইকবাল কাদিরদের নামের সাথে বাংলাদেশ যুক্ত থাকায় চোখের পানি বাঁধ মানতে চায় না?
কেন পদ্মাসতুর স্প্যান বসিয়ে সেতু দৃশ্যগত হলে চোখে জলে ভর উঠে? যখন ভাবি অন্য সব বিখ্যাত বড় শহরের মতো ঢাকা শহরেও মেট্রো রেলে চড়ে যাত্রীরা চলাফেরা করছে কেন চোখে পানি চলে আসে?
কেন ভোরবেলা কক্সবাজার বীচে দাঁড়িয়ে এর সৌন্দর্য্য দেখে আবেগে চোখে ঝাপসা দেখি? কেন সাজেকে মেঘ থেকে জল চোখের জলের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে?
কেন গুগল ম্যাপে বাংলাদেশের ম্যাপটা দেখে, সুন্দরবনের সবুজ আর সর্পিল নদীগুলোর চিত্র দেখে বুকটা হু হু করে উঠে?
কেন বিদেশী বন্ধুরা বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করলে চোখের জল উপচে পড়তে চায়?
কেন চার কিমি আইল কিংবা কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে স্কুলে যাওয়ার রাস্তাটা পাকা হওয়া দেখে টুপটুপ করে চোখের পানি ঝরতে চায়? কেন হারিকেনের আলোয় পড়া বাচ্চাটি বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি দেখে চোখ খুলে রাখতে পারে না? কেন সাঁওতাল বিগাল দা’র ছেলেটা মিশন স্কুল থেকে এসএসসি পাশের খবর শুনে চোখ জলে ভরতে চায়?
ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটাও একদিন চার লেন হবে কেন ভাবতে ভাল লাগে? কেন ভাবতে ভালো লাগে নোংরা দূষিত বুড়িগঙ্গাটাও একদিন টেমস বা রাইনের মতো হবে? কেন ভাবতে ভালো লাগে চট্রগ্রাম বা কক্সবাজারটা একদিন ব্যাংকক কিংবা মিয়ামীর মতো হবে?
কেন ভাবতে ভালো লাগে আমরাও একদিন হাই-স্পিড রেলে চড়ে কক্সবাজার কিংবা রংপুর যাব? কেন ভাবতে ভালো লাগে ২৮ কোটি বাঙালীর বাংলা সিনেমাও একদিন বিদেশীরাও হুমড়ী খেয়ে দেখবে? কেন ভাবতে ভালো লাগে টিভি-ফ্রিজের মতো একদিন বাংলাদেশী ব্রান্ডের প্রাইভেট কার, বাস-ট্রাক দেশে বিদেশের রাস্তাগুলো দাপিয়ে বেড়াবে?
হয়ত আমি একটু বেশিই আবেগী; হয়ত আমার ভাবনাগুলো একটু বেশিই অপরিপক্ক; হয়ত আমার চিন্তাগুলো একটু বেশিই অগোছালো; হয়ত আমি এখনো এই যান্ত্রিক নগর সভ্যতার কংক্রিটের সাথে নিজেও কংক্রিটের মতো শক্ত মনের হতে পারি নি; হয়ত আমার...।
আমি স্বপ্ন দেখি আমার ভাবনার চারাগাছগুলো একদিন লাল-নীল-হলুদ পুষ্পে মহীরুহ হয়ে উঠবে। আমি স্বপ্ন দেখি বিগাল দা’র ছেলেটিও একদিন এ দেশের উন্নয়নে জীবন বাজি রাখছে। আর তাঁর স্বপ্নকে কিংবা আমাদের সকলের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য দেশের কর্তারাও দেশপ্রেমের চুড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছে। হয়ত সেদিন আমি থাকব না। কিন্তু থাকবে আমার কিংবা আমাদের স্বপ্নের বাস্তব প্রতিবিম্ব!!!!
ছবি: নিজ। প্রথমটি জাতীয় স্মৃতিসৌধে; দ্বিতীয়টি সাজেক ভ্যালিতে পাহাড়ি বাচ্চার সকালবেলা একাকী ছুটে চলা।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:৩৪