ধর্ম একটি বায়োবীয় ধারণা। যেটা পুরোটা একটা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। অতীতের বিভিন্ন সময় সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে মানুষের পরিমিতি বোধ ও জাতীয় জীবনের নিয়ন্ত্রণারোপের নিমিত্তে ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। তখন মানুষের প্রণোদনার জন্য, নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্মের ব্যবহার হলেও সমাজ ব্যবস্থার বাস্তবতায় এখন মানুষই ধর্মের উপর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বা হচ্ছে এবং এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে বৈ কমবে না। মানুষ এখন ধর্মকে অনেকটা তার প্রয়োজনে ব্যবহার করছে। ধর্মের যে দিকটা পালন করা, ধারণ এবং নিজ স্বার্থে ব্যবহার করা সহজ সেই দিকটা আকড়ে ধরছে আর যে দিকটা নিজের প্রার্থিব স্বার্থ বহির্ভূত সেটা এড়িয়ে যাচ্ছে নয়তো নিজের মত করে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নিচ্ছে। আর বিপত্তিটা বাঁধছে সেখানেই। যার ফল স্বরূপ ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী ধর্মীয় উগ্রবাদের দুইটা ধরণ আছে। একটা ভূ-রাজনৈতিক অন্যটি আন্তর্জাতিক। এই দুটি রূপই বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল।
এই ভূরাজনৈতিক দিকটিও আবার ক্ষেত্র বিশেষে তার রঙ বদলায়। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশে সনাতন ধর্মের মানুষেরা ভূমির অধিপতি হিসেবে ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত। বংশ পরম্পরায় সেই সনাতন ধর্মের মানুষগুলিই কালানুক্রমে মুসলিম ধর্মে দ্বীক্ষিত হয়েছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বর্ণ প্রথায় নিষ্পেষিত হয়ে সমাজের নিচু স্তরের মানুষেরা নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করতেই নিজ ধর্মের ছায়া ছেড়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। ইসলামের ঝান্ডা নিয়ে নিজে এক সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু যারা বাবা-দাদার ধর্ম ত্যাগ না করে রয়ে গেছে তাদেরকেই প্রতিবেশি হিসেবে পেয়েছে। স্বভাবতই প্রতিবেশির সাথে পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থায় দৈনন্দিন যাপিত জীবনে অনেক রকম হিসেব নিকেশ থেকে যায়। সেই হিসেবের জের ধরেই সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত বাহু বলে বলিয়ান মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে যখন নিজের প্রভূত্ব ধর্মীয় ভাবে সংখ্যা লুঘু প্রতিবেশীর উপর খাটাতে যায় তখন সেটা ধর্মীয় উগ্রবাদের তকমা লেগে যায়। অথচ একই ঘটনা যদি অন্য দুজন প্রতিবেশী মুসলিমের মধ্যে ঘটে সেটা ধর্মীয় উগ্রবাদের পর্যায় পড়ে না। এটা গেল একটি দিক। এই দিককে বড় করতে গিয়ে সত্যিকারের উগ্রবাদকে ঢেকে দেয়ার প্রয়াস চলবে না। মূলত ধর্মের ভিত্তিতে ৪৭’র দেশ বিভাগকে ধর্মীয় উগ্রবাদের ভিত্তি সময় হিসেবে বহুল আলোচিত। তবে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে সম্রাট আকবরকে ধর্মীয় উগ্রবাদী নেতা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মন্দির ভাঙ্গার সাথে সাথে তৎকালীন মোঘল সাম্রাজ্যে পাঁচটি মন্দির নির্মান ও একটি মসজিদ ভাঙ্গার ইতিহাসের সাথেও তাঁর নাম জড়িয়ে আছে। ৪৭’র দেশ বিভাগের পর থেমে থেমে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় কখনো বিচ্ছিন ভাবে, কখনো আসক্ত ভাবে, কখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে উগ্রবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে ১৯৯২ খ্রীস্টাব্দে ভারত জুড়ে উগ্রবাদের যে ঢেউ মাথা তুলেছিল তার আঘাত বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ এশিয়ার দেশ গুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। আর এর পেছনে কাজ করেছে রাজনৈতিক বিষয়। আশির দশকে শেষ দিকে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে রাম মন্দির করার পরিকল্পনাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। ২০০১ খ্রীস্টাব্দে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যে নির্যাতন চালিয়ে তাদের ভূমি ও সম্পদ দখল করা হয়েছে তাকেও একটি রাজনৈতিক মোড়কে বন্দি করা হয়েছে। এতে করে স্বার্থ হাসিল করতে বৃহতর জনগোষ্ঠির সমর্থন পাওয়া যায় এবং নিরাপদে কাজ সম্পাদন করা যায়। দ্বিতীয় আর একটি ঘটনা ২০১২ খ্রীস্টাব্দে মহাজোট সরকারের নেতার সম্পৃক্ততায় রামুর বৌদ্ধ মন্দির ভাঙ্গা। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সেখানে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়েছে সেখানকার রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বরা। ধর্মীয় তীক্ষ্ণ অনুভূতির অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষ গুলোকে সেদিন স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের প্রভাব জাহির করতে কাজে লাগিয়েছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের স্কুল শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে জড়িয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদ যে যুদ্ধংদেহী অবস্থান নেয় সেটার পিছনেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাত ছিল। ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার ঘটনা কিংবা গাইবান্ধার সাঁওতালদের ঘটনাতেও ভূ-রাজনৈতিক বিষয় জড়িত। ধর্মীয় উগ্রবাদের ধূয়াতুলে মূলত একটি সুবিধাবাদী শ্রেণী সব সময় নিজেদের স্বার্থ কব্জা করে নেয়। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের আখেরে না স্বার্থ থাকে, না সম্পৃক্ততা থাকে।
অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ের মত আন্তর্জাতিক বিষয়ের সাথেও স্বার্থ জড়িত। সোভিয়েত প্রভাবকে টেক্কা দিতে আশির দশকে তৎকালীন আমেরিকা আলকায়দা সৃষ্টি করে। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তৎকালীনও জেনারেল জিয়া সরকার ভারত ও সোভিয়েত বলয় থেকে বের হয়ে আমেরিকান বলয়ে ঢুকতে বিষয়টিতে নিরবতা দেখায়, হয়তো গোপনে সমর্থনও জানায়। যেটা পরবর্তীতে ধর্মীয় উগ্রবাদকে বংলাদেশে উৎসাহিত করে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ঐক্যজোট সরকারের সময় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে জেএমবি, জেএমজেবি ছাড়াও বিভিন্ন উগ্রবাদী গ্রুপের সাথে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সখ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ফলশ্রুতিতে ২০০৫ খ্রীস্টাব্দে উগ্রবাদীরা দেশের ৬৩টি জেলায় বোমা হামলার মত ঘটনা ঘটানোর মত শক্তি দেখায়। সম্প্রতি গুলশান হামলা বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছে, যদিও এর উৎস মূল এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এটা যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের অংশ সেটা নিশ্চিত। এক্ষেত্রেও ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বিপথগামী তরুণদের জড়ানো হচ্ছে নিজেদের স্বার্থে মহাদেশ ভিত্তিক অস্থিতিশীলতা বজায় রাখতে। দলছুট হয়ে মূল শ্রোতের বাইরে গিয়ে বিপথগামী তরুণরা কতটা অসহায় হয়ে পড়ে সেটা উগ্রবাদের রাস্তা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা দু একজন তরুণের কথা শুনলেই বোঝা যায়। কিন্তু উগ্রবাদী গ্রুপ গুলো ঐসব তরুণদের বিষণ্ণতা ও আর্থিক দীনতাকে পুজি করে দলে ভেড়ায়। তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্মীয় উগ্রবাদ-সন্ত্রাসবাদ বেশ প্রভাব বিস্তার করে। যেমনটা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, পাকিস্তানসহ এই অঞ্চলের রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থা দেখলে প্রতীয়মান হয়।
মানুষের ধর্মের প্রতি একটা দুর্বলতা এবং ধর্মগ্রন্থে বর্ণীত পরকালীন জীবনে ভোগের লোভ সহজ রাস্তায় পেতে গিয়ে বিপথগামী হয়ে পড়ে। এই ক্ষেত্রে ধর্ম গ্রন্থগুলোর অস্পষ্ট বিষয়গুলোর আরো অনেক সহজ ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এবং স্কুল কলেজ পর্যায়ে উগ্রবাদ নিয়ে ও তার ক্ষতিকর দিক নিয়ে সহজ অথচ বিস্তারিত পাঠ পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্তি করা যেতে পারে। বাবা মায়েদের সন্তানের প্রতি আরো বেশি বন্ধু সুলভ আচরণ বিষয়টার সমাধান হতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:২২