শীত যাই যাই করছে। এবারের শীত লোকাল ট্রেনের মত দেরিতে এলেও চলে যাচ্ছে মৈত্রী এক্সপ্রেসের মত। তবুও শীতের দিন বলে কথা। সকালের কোমলীমা রোদ পোহাতে বেশ আরাম লাগে। যেন প্রেয়সীর কোমল হাতের আদুরে ছোঁয়া। যে ছোঁয়া ঘাস ফুলের ছোঁয়ার মতই নরম আর সুবাশিত। একটা দাঁড কাক এই মাত্র রেলিং এ উড়ে এসে বসল। সাথে জোড়া কাকটিও এলো। এসেই খুনসুটি করে ঠোটে ঠোট গুজে ভালবাস্র জানান দিল। হেলাল হাফিজ হিরণবালা কে বলেছিল, আঙুল দিয়ে তোমার আঙুল ছুঁয়েছিলাম বলেই আমার
আঙুলে আজ সুর এসেছে। নিশ্চয় কাকের ঠোটেও এখন সুর এসেছে। অদূরের পাহাড় গুলো কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মত ঢলঢল করে কুমারী রোদের মায়া হরিণ চোখে তাকিয়ে আছে। একটুও ক্লান্তি নেই। কুমারী রোদও দুষ্টু আছে। হা করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়কে দুষ্টুমি করে খোঁচা দিতেই পাহাড়ে বেড়ে উঠা গাছ গুলো ভেবাচেকা খেয়ে ডালপালা সমেত নড়েচড়ে উঠল। প্রণয় চোখে মোহাবিষ্ঠ পাহাড় কিছুটা লজ্জায় মুচকি হেসেও উঠল। কর্নেলহাট, বিশ্ব ব্যাংক কলোনী, তাজমহল ভবনের চিলেকোঠা। এটাই গত এক জানুয়ারি থেকে সায়ানের নতুন ঠিকানা। গত পাঁচ মাস হলো অফিসে এক ঝামেলায় জড়িয়ে শ্যাভরনের সোনার হরিণ চাকরিটা খুইয়েছে সায়ান। এদিক সেদিক ছুটাছুটি করেও নতুন চাকরি আর জুটাতে পারেনি। এই অবস্থায় আট বছরের সম্পর্ককেও বিদায় জানাতে হয়েছে সায়ানের। পৃথা এসেছিল। শেষমেষ ফুপিয়ে কাদতে কাদতে চলে গেছে। নিজের জীবনেরই যেখানে থিতু নেই, সেখানে পৃথার জীবনকে জড়িয়ে পৃথার স্বপ্ন ভঙ্গ করতে চায় না সায়ান। পৃথার অনেক স্বপ্ন ছিল সুন্দর একটা বাড়ি হবে, সামনে বাগান করার যায়গা থাকবে। বেলকনিতে বসে জ্যোৎসনা বিলাস করবে। সেই স্বপ্ন এখন আর পূরণ হবার নয়। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য কোন রকম একটা চাকরিই যখন গত পাঁচ মাসে যোগানো যায় নি সেখানে স্বপ্ন পূরণের চিন্তা করার দুঃসাহস সায়ানের নেই। চাকরি হারানো এতদিন গোপন থাকলেও গত মাসে বাসা বদল করার সময় জানাজানি হয়ে গেছে। পৃথার বাগদান হয়ে গেছে জানুয়ারিরতেই। ছেলে আমেরিকা প্রবাসী। ভেলেন্টাইন ডে তে আকদ সম্পন্ন হবে। কথাও ছিল তাই। ভেলেন্টাইন ডে তেই সায়ান-পৃথার আকদ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। ১৪ ফেব্রুয়ারি সায়ানকে রেখে পৃথা অন্য কাওকে মালা পড়াতে যাচ্ছে। এর জন্য সায়ানই দায়ী। সেই পৃথাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। যদিও তখন পৃথা জানতো না কেন সায়ান তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। হয়তো এখনও জানে না। পৃথার ফোন এখন আর রিসিভ করে না। অপরিচিত নম্বর থেকে প্রথম প্রথম ফোন করে কথা বলতে চাইলে সায়ানই ইগনোর করতো। ইদানিং আর ফোন করে না। করবে কি করে? একটা মানুষে কত আর অবহেলা সহ্য করতে পারে। একটা বাইং হাউজে ঢুকার ব্যাপারে এক বন্ধুর সাথে কথা হয়েছে। এখন সারাদিন বিডিজবসে একবার করে ঘুরা আর বিভিন্ন জায়গায় সিভি ড্রপ করেই দিন কাটছে। রেজাল্ট আর শ্যাভরনের এক্সপেরিয়েন্সের কথা শুনে সবাই ভাইভাতেই দুঃখ প্রকাশ করে যে ওর জন্য উপযোক্ত পদ তাদের কোম্পানীতে নেই। বাইরে চলে যাওয়ার কথাও ভেবে রেখেছে কিন্তু সাড়া পাচ্ছে না কোথা থেকেই। ফোনটা বেজে উঠল। ভাবনায় ছেদ পড়লো সায়ানের। ফারহান কলিং…। টাইগার হিলে ওদের বাসা। ইউনিভার্সিটির কাছের বন্ধুদের একজন। এখন নারায়নগঞ্জের ইউএনও। ও জানালো আজ রাতে আরেক বন্ধু রাফিঙ্কে নিয়ে বাসায় আসবে। ঘড়িতে রাত ১১.৩০ মিনিট। বাইরে বেস শীত পড়েছে। দিনের বেলায় শীত ততটা অনুভুত না হলেও, রাতের দিকে বেশ শীত পড়ে। দরজা শব্দ হতে বড় দুইটা লাগেজ হাতে ফারহান আর রাফিন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। কিছু বুঝে উঠার আগেই ধাক্কা দিয়ে সায়ানকে খাটে ফেলে দিয়ে দুজনে কিল ঘুসি মারতে থাকলো। বেশ হইহুল্লোড় হলো মিনিট খানেক। এরপর ফারহান রাফিনকে নিয়ে তাদের টাইগার হিলের বাসায় যাবে বলে উঠে দাঁড়ালো। কিছু বুঝতে না পেরে সায়ান চোখের চশমাটা নাকের উপরে বসাতে বসাতে একবার লাগেজ দুটির দিকে আর একবার ফারহানের দিকে তাকাতে থাকল। তা দেখে হুংকার ছেড়ে ফারহান বলল, সালে কানা, চশমা ভালো করে পড়ে নে। ওই লাগেজ আমার বউয়ের, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ও। আজ রাতে বাসায় নিয়ে যেতে পারছিনা। বাড়িতে না জানিয়েই বিয়ে করেছি তো। তাই আজ আমার বউকে তোর কাছেই রেখে যাচ্ছি। সাবধানে রাখবি। আর শুন তুই মাটিতে শুবি কিন্তু। চল বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।ঘোর কাটার আগেই আরেক ঘোরে পড়ে গেল ফারহান। পৃথা তোমার না কাল বিয়ে। রাফিন মাথায় এক গুতা মেরে বলে উঠল, হ্যা সালে বিয়ে কালই হবে। তোরা থাক আমরা সকালে আসব বলে ফারহান আবারও মনে করিয়ে দিল পৃথা কিন্তু আমার। আজ রাত শুধু দেখে রাখিস। ফারহান আর রাফিন চলে গেল। এবার ফনা তুললো পৃথা, স্বার্থপর, এত দিন তুমি আমাকে এই চিনেছ? কি ভেবেছিলে, তোমার চাকরি নাই শুনলে আমি তোমাকে ছেড়ে বাবার পছন্দের ওই আমেরিকা প্রবাসীকে বিয়ে করতাম? আমার সম্পর্কে এত নিচ ধারণা রাখ তুমি? সায়ান মিনমিন করে বলতে চাইলো, না সে রকম না। সেরকম না তো কি, আরও নিচু ধারণা? গত মাসে সোনালী ব্যাংকে যে ভাইবা দিয়েছিলাম সেটার জয়নিং লেটার এসেছে। ১২টা বেজে গেছে। আজ ভেলেন্টাইন ডে। আমার রোজ কই? সায়ান আলতো করে পৃথার মুখটাকে ধরে ঠোটে ঠোঁট ছোয়ালো। কুয়াশা ভেদ করে আবছা জ্যোৎসনা ওদের উপর তুলোর মত ঝড়ে পড়চ্ছে। যেন ঘাঁস ফুলের মত নরম আর সুবাশিত অনুভূতি।