বাঁশের বেড়া আর খড়ের চালে তৈরি তিনটি কুঁড়েঘর। ওপরে স্বচ্ছ নীলাকাশ আর শরতের সাদা মেঘ। ঘরগুলোর আশপাশে বেশ কিছু লেবুগাছ, ধুলো আর ঘাস। দক্ষিণের ঘরটির খানিক সামনে পূর্ব ও পশ্চিম থেকে আসা দুটি পাহাড়ি জলধারা এসে এক হয়ে চলে গেছে দক্ষিণ দিকে। কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়নি এসব জলধারা কোথা হতে এল আর কোথায়ই বা গেছে। আমরা শুধু দেখেছি আর মুগ্ধ হয়েছি। জলধারার দুই পারে বাঁশঝাড়। দখিনের ঘরটির বারান্দায় বসে অবিরত বয়ে চলা এই জলধারা দেখতে বেশ লাগে।
এখানে যন্ত্রচালিত কোনো যানবাহনের শব্দ নেই। অন্য কোনো শব্দও কানে আসে না। যেন আকাশ, বাতাস, চারপাশের গাছপালা, বাঁশঝাড়, প্রকৃতি—সব ঘুমিয়ে আছে। আশপাশে তেমন মানুষও নেই। কদাচিত্ যে দু-একজনকে চোখে পড়ে, তারা তেমন কথা বলে না। কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করলে যতটা সম্ভব নিচু স্বরে সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়, পাছে প্রকৃতির ঘুম ভেঙে যায়! এই নীরবতায় বসে আপনি আপন মনে ভাববেন ‘নীরবতাই সৌন্দর্য’। তবে একটু উত্কর্ণ হলে দুই দিক থেকে আসা জলধারা বয়ে চলার ক্ষীণ শব্দ কানে আসে। একে যে-কেউ মধুর শব্দ বলবেন। অথবা ঘুমপাড়ানি গানের সঙ্গে তুলনা করবেন। এই গানই এখানকার প্রকৃতিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে!
হ্যাঁ, শ্রীমঙ্গলের রাধানগরে অবস্থিত নিসর্গ নীরব ইকো-কটেজের কথাই বলা হচ্ছে। আমরা ১০ বন্ধু ঈদ ও পূজা উপলক্ষে বেড়াতে গিয়ে এই কটেজে অবস্থান করে ঘুরে বেড়িয়েছি শ্রীমঙ্গল আর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে এই কটেজের দূরত্ব চার কিলোমিটার, যেতে হয় ফিনলে চা-বাগানের ভেতর দিয়ে। কটেজ থেকে লাউয়াছড়া বনের দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। ২৬ তারিখ ভোর ছয়টায় আমরা ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে বেলা ১১টায় পৌঁছে যাই।
আমরা ঠিক করেছিলাম, নিরিবিলিতে একটা ছোট্ট জায়গায় থাকব, যেখানে ভ্রমণকারীদের ভিড় নেই, নেই কোলাহল। সে মোতাবেক জায়গাটা বেশ পছন্দ হয়েছে। পৌঁছামাত্র সবার মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। আমরা সবাই জলধারা আর বাঁশঝাড় দেখতে দেখতে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। শুধু দেখে মন ভরছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই নেমে পড়লাম পানিতে। গান, আড্ডা আর লাফালাফিতে আমরা যখন ব্যস্ত তখন কটেজের ব্যবস্থাপক শামসুল সাহেব এসে ‘দেড়টা বাজে, দুপুরের খাবার প্রস্তুত’ বলতেই ক্ষুধা টের পেলাম। তড়িঘড়ি করে গোসল করতে গিয়ে বুঝলাম, দেখতে কুঁড়েঘর হলেও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছাড়া আর সব নাগরিক সুবিধাই রয়েছে।
গোসল ও খাবার সেরে লাউয়াছড়া বনে ঢুকলাম। এই বনে আমরা আগেও একাধিকবার এসেছি। তাই কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরে শেষবিকেলে যাই রামনগরের ‘নীলকণ্ঠ চা কেবিনে’। সাত রঙের চা পান শেষে শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন পূজামণ্ডপে ঘুরে বেড়াই। তারপর শ্রীমঙ্গল শহরের একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার সেরে ফিরে আসি। ততক্ষণে রাত ১১টা। সবাই হাত-মুখ ধুয়ে বসে পড়লাম জলধারার সামনের ঘরের বারান্দা ও তার আশপাশে। গিটার নিয়ে তারগুলো সব ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিচ্ছিল একজন। অন্য একজনের কণ্ঠ থেকে ভেসে এল ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’। যদিও তখন বাঁশঝাড়ের ওপর ছিল সপ্তমীর চাঁদ, যা বাঁকা নয়। এবার গিটারসহযোগে গান ‘ওরে নীল দরিয়া’। আরও কিছু গান হলো। এরপর যুগল কণ্ঠে ‘আজ জ্যোত্স্না রাতে’। এরপর যে বন্ধুরা এই ভ্রমণে যোগ দিতে পারেনি তাদের উদ্দেশে সমবেত কণ্ঠে ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’, ‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি’ ইত্যাদি গান গাইতে থাকি। সবাই যখন গাইছিলাম তখন ক্যামেরাগুলো ধরে রাখল স্মৃতি।
তখন রাত আড়াইটা। সকালে জাফলং যাওয়ার পরিকল্পনা থাকায় শুয়ে পড়লাম। জাফলংয়ে আমরা সবাই আগেও গিয়েছি। তাই সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ নৌকায় ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর কিছু করা হয়নি। নদীর ধারে বালুচরের কাশফুল আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু এসব নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকায় কাছে যাওয়ার উপায় ছিল না। তাই ক্যামেরা জুম করে ছবি তুলে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে ফিরে এলাম কটেজে। টানা দুই দিন ঘুরে বেড়িয়ে সবাই ক্লান্ত। পরের দিন মাধবপুর লেকের সৌন্দর্য ভালোভাবে উপভোগ করতে চাই বলে দ্রুত শুয়ে পড়লাম। আমাদের কটেজ থেকে এর দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। কিন্তু রাস্তা তেমন ভালো না বলে পৌঁছতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগে গেল। তবে রাস্তার দুই পাশের চা-বাগানের (নূরজাহান এবং মাধবপুর চা-বাগান) প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের বেশ মুগ্ধ করে। তাই হয়তো ভেসে ওঠে গান ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’। ‘আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ’।
এভাবে আরও কিছু গান আর গল্প করে করে আমার পৌঁছে যাই লেকে। লেকের স্বচ্ছ পানি, সাদা ও বেগুনি শাপলা ফুল আর এর বিশালত্ব আমাদের অন্য রকম আনন্দ দেয়, যে আনন্দ গত দুদিনে আর কোথাও পাইনি। তাই ফিরে আসার সময় অনেকের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল ‘আবার আসতে হবে’।