কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন আমেরিকার নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞার অন্তহীন তরঙ্গ চীনের জন্য বিশাল উপহার। আবার অনেকেই মনে করেন এটা ভবিষ্যতে চীনা অর্থনীতির জন্য অন্তহীন সমস্যার সৃষ্টি করবে।
যারা আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাকে চীনের জন্য উপহার মনে করেন তাদের যুক্তি হচ্ছে:
১. চীনের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ:
আমেরিকা যখন কোন দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে তখন নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়ে পরে। এই সুযোগে তখন সেই দেশটির প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠে চীন। এই পরিস্থিতিতে চীন নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত দেশগুলির সাথে ব্যবসা বাণিজ্য বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পায়। বাণিজ্যিক দিক ছাড়ো নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত দেশগুলির সাথে আমেরিকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়। পরিস্থিতির এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে চীন নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত দেশগুলির সাথে শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
২. কৌশলগত জোট:
নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত দেশগুলিকে চীন সহজেই তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর দিকে আকৃষ্ট করতে পারে। এতে অর্থনৈতিক সহায়তা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চীনের কৌশলগত অবস্থান আরো দৃঢ় হয় এবং বিশ্বব্যাপী চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পায়। উপরন্তু এই দেশগুলিকে আর্থিক সহায়তা, ঋণ প্রদান এবং বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে চীন তার নরম শক্তি (সফট পাওয়ার) প্রয়োগ করতে পারে এবং নিজেকে ঐ দেশগুলির কাছে আমেরিকার চেয়ে আরও নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসাবে উপস্থাপন করতে পারে।
৩. অর্থনৈতিক সুবিধা:
নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত দেশগুলি তাদের প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদ নিষেধাজ্ঞার কারণে অন্য দেশে রফতানি করতে না পারায়, চীন তা সহজ শর্তে ক্রয় করে। এতে চীন কম মূল্যে এবং সহজ শর্তে তেল-গ্যাস সহ অনেক ধরণের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারে। এতে চীনের শিল্প এবং অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠে।
আবার যারা আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাকে চীনের জন্য সমস্যা মনে করেন তাদের যুক্তি হচ্ছে:
১. বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত:
বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্য পরস্পরের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাগুলি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলকে ব্যাহত করতে পারে। ফলে কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্যের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার বা সরবরাহের ঘাটতি হওয়ার কারণে চীনা শিল্প এবং ব্যবসাগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে। উপরন্তু নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত দেশগুলিতে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা চীনা বিনিয়োগের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
২. রাজনৈতিক ঝুঁকি:
নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত দেশগুলির সাথে চীনের ঘনিষ্ঠতা আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা এবং রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে। এরফলে চীনা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আমেরিকা এবং তার মিত্রদের কাছ থেকে সম্ভাব্য দ্বিতীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীনের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৩. অর্থনৈতিক নির্ভরতা:
নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত দেশগুলির সাথে বাণিজ্যের উপর খুব বেশি নির্ভর করলে চীনের ঐ দেশগুলির উপর এক ধরণের অর্থনৈতিক নির্ভরতা তৈরি করতে পারে যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নাও হতে পারে। এসব দেশে আর্থিক অস্থিতিশীলতা চীনা স্বার্থকে নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
সবদিক বিবেচনা করলে:
সবদিক বিবেচনা করলে খুব সহজ সরল ভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা সম্ভব না। পরিস্থিতিটি ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি জটিল সমীকরণ। একদিকে, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞাগুলি চীনের জন্য নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত দেশগুলিতে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। আরেক দিকে, চীনের জন্য উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনাও সূচনা করতে পারে। বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ আন্তঃসংযুক্ত। নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তঃ সংযোগে সৃষ্ট ব্যাঘাত চীনের উপর নেতিবাচক প্রভাব সহ সুদূরপ্রসারী পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
সারসংক্ষেপ:
আমেরিকার নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞার অন্তহীন তরঙ্গ চীনের জন্য বিশাল উপহার না সমস্যা, তা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এবং বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করবে। যদিও আমেরিকার নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞার ফলে বর্তমানে চীনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুবিধা হচ্ছে, কিন্তু একই সাথে ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকি এবং সম্ভাব্য প্রতিকূল ফলাফলও রয়েছে। অতএব নিষেধাজ্ঞা উপহার, না কি সমস্যা, সেটা নির্ভর করবে ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের গতিশীল কর্মকাণ্ডের উপর।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:২৪