ইতিহাস বলে, বৃটিশ লুটেরাদের শাসনাধীন সময়ে কিংবা তারও আগে এ অঞ্চলে একেবারে শিশু বয়সেই কন্যাশিশুদের বিয়ের পিড়িতে বসতে হত। যখন একজন শিশু ঠিকমত সম্পর্কও অনুধাবন করতেও পারত না। পাঁচ বা ছয় বছর বয়সেও বিয়ে হয়ে যেত। বিয়ের দিনে কনেকে কোলে করে বরের বাড়িতে নিয়ে গেছে, এরকম নজিরও কোথাও কোথাও পাওয়া যায়। সাধারণত বর বা স্বামী বা পুরুষ থাকত প্রাপ্তবয়সী।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, এত কম বয়সে বিয়ে হলে শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী ঘটত? কেউ কেউ হয়ত বিষয়টা জানেন যে, একটা রেওয়াজ ছিল, বয়সন্ধির পূর্ব পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে রাত্রিযাপন বা শারীরিক সম্পর্ক থেকে দূরে রাখা হত।
তবু কোন কোন ক্ষেত্রে যে পরিণত বয়সী স্বামী শারীরিক সম্পর্কের চেষ্টা করত না, তা কিন্তু নয়। স্বামীদের যৌনা চাহিদার কারণে সে সময়ে অনেক মেয়ে কম বয়সে মারা গেছে-এরকম নজিরও ইতিহাসে বিদ্যমান। যখন বৃটিশরা দেখল, মেয়েরা অল্প বয়সে বিয়ে হবার কারণে মা হবার সময় মারা যাচ্ছে, কিংবা স্বামীর সঙ্গে সহবাস করতে গিয়ে মারা যাচ্ছে কিংবা অল্প বয়সে বিধবা হচ্ছে তখন তারা কম বয়সে বিয়ে রদ করে আইনও করেছিল। কিন্তু আইনতো আর সবাই মানে না। তাছাড়া গ্রামীণ পর্যায়ে আইন বাস্তবায়ন করাও সে সময় সম্ভব ছিল না।
বর্তমানের মত আধুনিক যুগেও বাল্যবিবাহ নিরোধ করতে প্রণীত আইন সর্বক্ষেত্রে বিশেষত গ্রামীণ পর্যায়ে প্রয়োগ সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না। এখনও গ্রামে ৫০ভাগের মত কন্যাশিশু বাল্যবিবাহের শিকার বলে তথ্য জেনে অবাকই হতে হয়।
অপরিণত বয়সে অর্থাৎ শিশু বয়সে যে বিয়ে হলেই বলা হয় বাল্যবিবাহ। কখনো কখনো বর পরিণত বয়সী কিন্তু কনে অপরিণত বয়সী। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে বর-কনে দু'জনই অপরিণত বয়সী। বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বলা যায়, কন্যাশিশুরাই বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বেশী। যেহেতু শিশু বয়সের বিয়েকে বাল্যবিবাহ বলা হয় তাই শিশু কারা এটিও জানা আবশ্যক বলে মনে করি। ১৯৮৯ সালে প্রণীত জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে বলা হয়, ১৮ বছরের কম বয়সী সকলেই শিশু। যদিও শিশু আইন সংশোধন প্রক্রিয়াধীন। যেখানে ১৬ বছর পর্যন্ত শিশু হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
১৯২৯ সালে তৎকালীন বৃটিশ প্রশাসন কর্তৃক প্রণীত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন (১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সংশোধিত)টি বাংলাদেশে প্রচলিত। এ আইনের 'ধারা ২' এ বলা হয়, নাবালক ও অপরিণত বলতে তাকে বুঝাবে যে ছেলের বয়স ২১ বছরের কম ও যে মেয়ের বয়স ১৮ বছরের কম। সম্পর্ক স্থাপনকারী যে কোন এক পক্ষ নাবালক হলে সে বিয়েকে বাল্যবিবাহ বলা হয়।
'ধারা ৪' এ বলা হয়, ২১ বছরের উর্ধ্বে কোন ছেলে অথবা ১৮ বছরের উধের্্ব কোন মেয়ে যদি কোন নাবালককে বিয়ে করে তাহলে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড বা ১০০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
'ধারা ৫' এ বলা হয়, কোন ব্যক্তি বাল্যবিবাহের ব্যবস্থা বা পরিচালনা করলে এক মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা ১০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
'ধারা ৬' এ বলা হয়, কোন পিতামাতা অর্থাৎ অভিভাবক যদি বাল্যবিবাহের শিকার নাবালকের উপর কর্তৃত্ব সম্পন্ন হয়ে উক্ত বিবাহ কার্য সম্পন্ন করণার্থে কোন কাজ করলে বা সম্পন্ন করার অনুমতি দান করলে বা নিজ গাফলতির কারণে উক্ত বিবাহ বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে এক মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা ১০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
বাল্যবিবাহ সংঘটিত হবার পর এ দেশে তা মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে-এমন নজির নেই বললেই চলে। বাল্যবিবাহের অনাকাঙ্খিত পরিণাম সম্পর্কে অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানের মানুষ বেশী সচেতন হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে এখনো অহরহ বাল্যবিবাহ সংঘটিত হচ্ছে। সচেতনতা বৃদ্ধি সত্বেও বাল্যবিবাহের হার আশানুরূপ কমেনি।
এক্ষেত্রে ইউনিসেফ প্রকাশিত 'বাংলাদেশের কিশোরীদের অবস্থা' শীর্ষক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়, আদম শুমারী অনুযায়ী ১৯৬০ সালে বাল্যবিবাহের হার ছিল ৩২ শতাংশ। ১৯৯৭ সালে এ হার এসে দাঁড়ায় ২৬.৫ শতাংশে।
সর্বশেষ ২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী, ২০-২৪ বছর বয়সী যেসব মেয়ের উপর ইউনিসেফ জরিপ পরিচালনা করেছে সারাদেশে, তার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ কন্যাশিশু বয়স, ১৫ বছরের মধ্যেই পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ ভাগ কন্যাশিশু ১৮ বছরের মধ্যে গর্ভবতী হয়।
আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি, কিংবা শহরে বসবাস করি তাদের কাছে এ তথ্য অনেকটা প্রশ্নসাপেক্ষ হতে পারে। কিন্তু গ্রামের চিত্র ভিন্ন। তাছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের ৪০ভাগ মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। যেসব পরিবারে মেয়ের বয়সন্ধির পরপরই বিয়ে দিয়ে অভিভাবকরা নিশ্চিত হতে যায়। মূলত সামাজিক নিরাপত্তার অভাব থেকেই বাল্যবিবাহ এখনো কমেনি।
বাল্যবিবাহের ফলে কন্যাশিশুরাই বেশী পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু শারীরিক-মানসিকভাবেই নয়, কন্যাশিশুরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হয়। ইউনিসেফের গবেষণায় বলা হয়, বাল্যবিবাহের ফলে মাত্র ৫ শতাংশ কন্যাশিশুর লেখাপড়া অব্যাহত থাকে।
"দরিদ্র রিকশা চালক আবদুস সালামের কন্যাশিশু নাজমা। সে যখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী তখন বিয়ে হয় ২৫ বছর বয়সী এক যুবকের সাথে। মাস যেতে না যেতেই কন্যাশিশু নাজমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। কাবিননামায় নাজমার বয়স ছিল ১৮ বছর। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নাজমা আজ পরের বাড়িতে ঝি'এর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে।" বাল্যবিবাহের ফলে নাজমার অনিশ্চিত জীবনের জন্য দায়ী কে? এ প্রশ্নের উত্তর সে নিজেও জানে না।
বাল্যবিবাহ অপরাধ জেনেও কেন অভিভাবকরা তাদের কন্যাশিশুকে বিয়ে দিচ্ছেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জাতীয় কন্যাশিশু এডভোকেসি ফোরাম এর সম্পাদক, সংগঠক নাসিমা আক্তার জলি বেশ ক'বছর আগে একটি প্রবন্ধ লেখেন। কন্যাশিশুদের উন্নয়ন ও তাদের মানসিক বিকাশে নিবেদিত নাসিমা আক্তার জলি তাঁর প্রবন্ধে বলেন, বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ দারিদ্র। এছাড়া নিরাপত্তার অভাব, দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্খা, জন্ম নিবন্ধীকরণ না হওয়া, যৌতুকের লোভে কম বয়সী মেয়ে বিয়ের প্রবণতা, সম্পত্তি পাওয়া বা রক্ষার জন্য, বহু বিবাহ প্রথা, সামাজিক কুসংস্কার ও চাপ, আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও উদাসীনতা, যৌতুক কম দেয়ার আকাঙ্খা, লেখাপড়ার সুবিধার অভাব, অপবাদের ভয়- ইত্যাদি কারণে বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে।
বাল্যবিবাহের ফলে কন্যাশিশুদের সন্তান ধারণ করতে হয়। অজ্ঞতা ও অপরিণত শরীরী গড়নের কারণে কিশোরী মায়েদের মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। যে কারণে কিশোরী মাতা ও সন্তানদের মধ্যে মৃতু্যহার বেশী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০ বছর বা তার উধ্ব বয়সী নারীদের তুলনায় ১৮ বছর বয়সের প্রসূতিদের মৃতু্যর সম্ভাবনা প্রায় ৫ গুণ বেশী।
অল্প বয়সী মায়েদের মৃতু্যর প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- "রক্তে বিষক্রিয়া, গর্ভপাত এবং বাধাগ্রস্ত প্রসব(অপরিণত প্রসবনালীর কারণে)। বাল্যবিবাহ ও অপরিণত বয়সে মাতৃত্ব গ্রহণের ফলে মেয়েদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের সামর্থ কমিয়ে দেয়। কিশোর মায়ের নিজের বৃদ্ধির জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন ও তেমনি গর্ভের সন্তানের জন্যও খাদ্যের প্রয়োজন, যা তারা পায় না।
বাল্যবিবাহ রোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানাবিধ উদ্যোগের কথা শোনা যায়। তবু মনে হয়, এখনো গেল না আঁধার। কারণ বাল্যবিবাহ এখনও হচ্ছে। তবু মানুষ বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছে। আশা করা যায়, এ দশকের মধ্যেই বাল্যবিবাহ কমে আসবে।