কোন পার্টি বা অনুষ্ঠানে যাবার সময় স্ত্রী নিজে সম্পূর্ণ রেডি হয়ে বসে আছেন আর স্বামীকে রেডি হতে ঘন ঘন তাগাদা দিচ্ছেন-এমন দৃশ্য কি আপনারা দেখেছেন কোন দিন? মনে হয় না। বরং এর উল্টোটা দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। স্বামী প্রস্তুত, অথচ স্ত্রীর সাজগোজ তখনো প্রাথমিক অবস্থায়। তিন চারটা শাড়ি বদলানো হয়ে গেছে। তারপরেও শাড়ি নিয়ে স্ত্রীর অসন্তুষ্টি যাচ্ছে না। শাড়ির সাথে অর্নামেন্ট ম্যাচ করছে না। মেকআপ বক্স খুলে স্ত্রী বেকুব হয়ে বসে আছেন। আই লাইনার, লিপস্টিক, লিপজেল, ফেস পাউডার ইত্যাদি (আমি মেয়েদের সাজগোজের সব উপকরণের নাম জানি না) মানানসই হচ্ছে না। স্ত্রীর বিরক্তি চরমে। অনুষ্ঠানের সময়ও যাই যাই অবস্থায়। স্বামীও বিরক্ত। ‘তাড়াতাড়ি করো’ ছাড়া স্ত্রীকে বেশি কিছু বলতে তিনি সাহস পাচ্ছেন না। সাধারনত এমনটা দেখে বা শুনেই আমরা অভ্যস্ত।
কিন্তু হাবিব সাহেবের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। তিনি আমার প্রতিবেশী। ব্যাংকে উঁচু পদে মোটা বেতনে চাকরি করেন। বাড়ি গাড়ি সবই আছে। অফিসের এ্যানুয়াল ডিনার, অফিসিয়াল পিকনিক, ফেয়ারওয়েল, বার্থ ডে, ম্যারেজ ডে, আত্মীয়স্বজনের বিয়ে শাদী ইত্যাদি বারো মাসে তাঁর তিন তেরো উনচল্লিশ পার্বণ। আজ হাবিব সাহেবের প্রোগ্রাম হল একমাত্র শ্যালকের গোপন বিয়েতে স্বাক্ষী হিসাবে স্ত্রীসহ কাজী অফিসে হাজির হওয়া। শ্যালক তার ব্যাচমেট এক শ্যামলা মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু হাবিব সাহেবের শশুর শাশুড়ি ছাত্রাবস্থায় তাদের এই বিয়েতে রাজি নন। তার ওপর মেয়ে কালো, মেয়ের বাবা প্রাইমারী শিক্ষক, মেয়েরা অনেক ভাইবোন এসব আপত্তি তো আছেই। কিন্তু শ্যালকের মন শ্যামলা মেয়ের প্রেমে টইটুম্বুর। ‘কালো? তা’সে যতই কালো হোক/ দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ’ অনেকটা এ ধরনের মহান ভালোবাসা। তাই সে গোপনে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলার জন্য স্বাক্ষী হতে তার বোন দুলাভাইকে হাত পা ধরে রাজি করিয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের পারস্পরিক সম্মতিতে বিয়ে হতে কোন বাধা নেই। তবে অভিভাবক শ্রেণীর দু’জন সে বিয়েতে স্বাক্ষী থাকলে বিয়েটা আরো মজবুত হয়। এ ক্ষেত্রে বোন দুলাভাইকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। শ্যালকের বুদ্ধি সুদ্ধি প্রথম শ্রেণীর।
হাবিব সাহেবের স্ত্রী শাড়ি গয়না পরে চোখে মুখে ফাইনাল টাচ্ দিয়ে পুরোপুরি প্রস্তুত। কিন্তু হাবিব সাহেবের তখনো কিছুই হয়নি। দু’তিনটা প্যান্ট বদলানো হয়ে গেছে। তারপরেও প্যান্টের রঙ মনপছন্দ না হওয়ায় সেটা খুলে ফেলে শুধু আন্ডারওয়্যার পরে তিনি বেডরুমে দাঁড়িয়ে আছেন। স্ত্রীর ধমকে শেষ পর্যন্ত প্যান্টের একটা গতি হল। সমস্যা বাধলো শার্টের সাথে টাই ম্যাচ করা নিয়ে। হাবিব সাহেবের একচল্লিশটা টাই। দেশে বিদেশে যেখানে গেছেন একটা টাই অন্তত কিনেছেন। ফলে মেয়েরা দোকানে গিয়ে একসাথে অনেক শাড়ি বা থ্রি-পিছ দেখে যেমন এটা দেখি, ওটা দেখি বলে আঙ্গুল ঘোরাতে ঘোরাতে আঙ্গুল ব্যথা করে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত আর কেনা হয় না, তেমনি হাবিব সাহেবও একচল্লিশটা টাই বিছানার ওপর ফেলে ট্যারা চোখে (তাঁর বাঁ চোখ সামান্য ট্যারা) যাচাই বাছাই করতে করতে শেষে ক্লান্ত হয়ে স্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। এদিকে মোবাইল ফোনে শ্যালকের দু’তিনবার তাগাদা দেওয়া হয়ে গেছে। সে তার হবু স্ত্রীকে নিয়ে কাজী অফিসে বসে আছে।
মিসেস হাবিব যে টাইটা পছন্দ করেছেন, সেটা হাবিব সাহেবের পছন্দ হচ্ছেনা। বাবার এই দুর্দশা দেখে পাশের ঘর থেকে মেয়ে বর্ণা এসে হাজির। মা এবং মেয়ে যৌথভাবে যে টাইটা পছন্দ করলো, অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো করে সেটা হাবিব সাহেব গলায় ঝোলালেন বটে, তবে সমস্যা ফুরালো না। টাইয়ের সিঙ্গেল নটে তাঁকে মানাচ্ছে না, আবার ডাবল নট বাঁধলে ফাঁসির দড়ি গলায় ঝোলানোর মতো মনে হচ্ছে। মাঝামাঝি তো কিছু নেই। হাবিব সাহেবের ছেলে শিহাব কলেজ থেকে ফিরে বাবার এই সমস্যা দেখে সহজ সমাধান বাতলে দিল। সে তার মানিব্যাগ থেকে একটা কয়েন বের করে টস্ করে জানিয়ে দিল ‘ডাবল নট’। অতএব, ফাঁসির দড়িই সই। হাবিব সাহেব মনমরা হয়ে টাইয়ের ডাবল নট বেঁধে আলমীরা খুলে কোট বাছাই করতে লাগলেন। তাঁর হাফ ডজন কোট। কিন্তু শার্ট ও টাইয়ের সাথে মানানসই হয় এমন একটাও কোট এর মধ্যে আছে বলে তাঁর মনে হচ্ছে না। তাহলে কি কোট ঠিক রেখে শার্ট ও টাই বদলে ফেলবেন? নাকি শার্ট ও টাই ঠিক রেখে কমপ্লিট স্যুট পরে ফেলবেন? স্যুট পরা যায়, তবে স্যুটের রঙটা ম্যাড়মেড়ে ঘিয়ে রঙয়ের। বানানোর সময় থেকেই স্যুটটা তাঁর অপছন্দ। এই সমস্যার সমাধান হল কাজের বুয়া ফেলানির মায়ের কথায়, ‘খালুজান, ওই কালা কোটটা পইরা হেইদিন আপনারে যা মানাইছিল না! ফরসা শইলে কালা কোট পরলে আপনারে এম পি সাবের মতো দেহায়।’ আচ্ছা হল। কোটের সমস্যা গেল। কিন্তু জুতার ব্যাপারে হাবিব সাহেব কোন কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নন। চার জোড়া জুতার মধ্যে একজোড়া কালো জুতা তাঁর পছন্দ হল। কিন্তু সে জুতা পালিশ করা নাই। মা এবং মেয়ে মিলে জুতা পালিশ করতে বসে গেল। মেয়ের পালিশ করা বাঁ পায়ের জুতায় কালি হয়ে গেল বেশি, আর মায়ের পালিশ করা ডান পায়ের জুতায় কালি হয়ে গেল কম। হাবিব সাহেব এনার্জি সেভিং বাল্বের আলোয় জুতা জোড়া অন্তত পাঁচ ছয়বার উল্টে পাল্টে দেখেও সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। এর মধ্যে আবার শ্যালকের ফোন। হাবিব সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আরে, এ শালা তো অস্থির হয়ে গেছে দেখছি। বিয়ের জন্যে কেউ এভাবে পাগল হয়? আমরা বিয়ে করিনি?’ বলে ফোন রেখে দিয়ে তিনি নিজেই জুতা পালিশ করতে বসে গেলেন।
জুতা পালিশ শেষ হলে মোজা ম্যাচিং নিয়ে কিছু ঝামেলা হল। মোজার রঙ কালো, তবে জুতার মতো কুচকুচে কালো নয়। আটার গুনে রুটি, আর বাবার গুনে বেটী। বর্ণা বললো, ‘বাবা, তুমি প্যান্টটা একটু নামিয়ে পরো, তাহলে আর মোজা দেখাই যাবে না।’
মেয়ের কথা হাবিব সাহেবের মনে ধরলো। তিনি প্যান্টটা নিচের দিকে নামিয়ে পরলেন। কিন্তু অনভ্যাসের কারণে হাঁটার সময় প্যান্ট খুলে পড়ে যাচ্ছে বলে তাঁর মনে হতে লাগলো। এবার বুদ্ধি করে তিনি নিজেই সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। বেল্টের একটা ফুটো কমিয়ে দিয়ে প্যান্টের কোমর টাইট করে বেঁধে বর্ণার মাকে বললেন, ‘বুদ্ধি থাকলে শশুরের গোলামী করতে হয় না, বুঝেছ?’
‘বুঝেছি, এখন চল তো! ওরা কাজী অফিসের বারান্দায় এতিমের মতো বসে আছে।’
হাবিব সাহেবের চুলে কলপ দেবার অভ্যাস। এক সপ্তাহ আগে চুলে কলপ দেবার কারণে এখন চুলের গোড়াগুলো সাদা দেখা যাচ্ছে। বর্ণা তার বাবাকে সে কথা স্মরন করিয়ে দিল। হাবিব সাহেব আয়নার সামনে ঘুরে ফিরে দেখে বললেন, ‘তাই তো রে, মা।’
কিন্তু এখন কলপ করার সময় কই? ও কাজ করতে গেলে তো কোট প্যান্ট টাই জুতা সব খুলে এক মহাযজ্ঞে বসতে হবে। হাবিব সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। এই সময় আবার শ্যালকের ফোন, ‘বুবু, তোমাদের এত দেরি হচ্ছে কেন? কাজী সাহেব তো আর একটু পর উঠে চলে যাবেন।’
মিসেস হাবিব মহা ত্যক্ত। স্বামীর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তিনি বললেন, ‘এই লোকটা মেয়ে মানুষেরও অধম। পুরুষ মানুষের রেডি হতে এত দেরি হয়? জবর লোকের পাল্লায় পড়েছি, বাবা!’
স্ত্রীর টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত মন খারাপ নিয়েই কাজী অফিসে রওনা দিতে হল হাবিব সাহেবকে। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল তাঁর শ্যালকও নেই, শ্যালকের সাথে যে মেয়ের বিয়ে হবার কথা ছিল সেও নেই। ব্যাপারটা কেমন হল? মিসেস হাবিব মোবাইলে তার ভাইকে বললেন, ‘তোরা কোথায়?’
‘তোমাদের দেরি দেখে আমরা তো বিয়ে করে ফেলেছি, বুবু!’
‘কী বলছিস তুই? স্বাক্ষী পেলি কোথায়?’
‘ওসব ম্যানেজ করে ফেলেছি, বুবু। তোমার আর দুলাভাইয়ের নাম ঠিকানা লিখিয়ে অন্যদের দিয়ে সই করিয়ে নিয়েছি।’
‘কী সব আবোল তাবোল কথা বলছিস তুই? তাই কখনো হয় নাকি?’
‘তুমি যে কী বল না বুবু! টাকা দিলে মাছের দুধও পাওয়া যায়, আর এ তো স্বাক্ষীর সই। কাজী অফিসের ভেতর বাইরে দেখো কত কোট টাই, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা পুরুষ আর শাড়ি পরা মহিলা দালাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখে মনে হয়না এরা দালাল। টাকা দিলে এরা পাত্র পাত্রির চাচা চাচি, মামা মামী, বোন দুলাভাই সেজে সই করে দেয়। এখন কী করবো বল? তোমাদের জন্য আর কত দেরি করবো? বেকার লাইফে ক’টা টাকা গচ্চা গেল আর কী!’
মিসেস হাবিব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘এখন তোরা কোথায়?’
‘তোমাদের বাড়িতে। বর্ণা আর শিহাব ওদের মামীকে দেখে খুশিতে পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েছে। ওরা এখন আমাদের বাসরঘর সাজাতে ব্যস্ত।’
মিসেস হাবিব মাথা চেপে ধরে কাজী অফিসের বারান্দায় একটা বেঞ্চের ওপর বসে পড়লেন। তাঁর সামনেই দুই তরুণ তরুণী হাবিব সাহেবের হাত ধরে স্বাক্ষী হবার জন্য কাকুতি মিনতি করছে।
‘আরে, আমি তোমাদের চিনি না, জানি না। আমি তোমাদের স্বাক্ষী হতে যাবো কেন?’
তরুণ একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে হাবিব সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার হবে তো? কাজী সাহেবের সামনে বলবেন, আপনি আমার ফুপা। নাম...........’
মিসেস হাবিব স্বামীর হাত থেকে টাকাটা ছিনিয়ে নিয়ে দলা পাকিয়ে তরুণের মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘এই লোকটার জন্য মান সম্মান আর কিছু থাকলো না। এখানে আর এক মিনিট নয়। চলো, এখুনি বাড়ি চলো।’
হিড় হিড় করে স্বামীর হাত ধরে টানতে টানতে তিনি কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে চড়া গলায় ড্রাইভারকে বললেন, ‘বাড়ি চলো। কুইক।’
‘জি, ম্যাডাম।’
হাবিব সাহেব গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে নিজের মাথার চুলগুলো বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে দেখতে দেখতে বললেন, ‘বুঝলে বর্ণার মা, আসলে কলপ দেওয়ার কারণেই চুল বেশি পেকে গেছে। আমার এক কলিগ চুলে কলপ দিতে নিষেধ করেছিল। ইশ্,ওর কথা যদি শুনতাম!’
******************************************************************************************************************
ছবিঃ নেট
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ১১:৪৬