দুবলা পাতলা কল্পনা বিয়ের দু’বছরের মধ্যে মোটা হয়ে গেল। স্বামী সুশীল কুমার পাল হ্যাংলা একহারা গড়নের হওয়ায় শোবার চৌকিতে স্থান সংকুলানের তেমন সমস্যা ছিল না। কিন্তু আরও এক বছর পর চৌকির প্রস্থ আর কল্পনার দেহের প্রস্থ প্রায় এক হয়ে যাওয়ায় সমস্যা হলো। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিল তিন মাসের শিশুকন্যা ইন্দ্রাণী। মা কল্পনা চৌকিতে কাত হয়ে না শুলে মেয়ে ইন্দ্রাণীর জায়গা হয় না।
অগত্যা কল্পনাকে বহু কষ্টে কাত হয়ে শুয়ে রাত পাড়ি দিতে হয়। আর সুশীলের জন্য বরাদ্দ ঘরের মেঝে। সেখানে মাদুরের ওপর কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে সুশীল রাত কাটায়। নলের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট এক চিলতে ঘর। অতিরিক্ত একখানা চৌকি রাখার জায়গা নেই। তা’ ছাড়া চৌকি কেনার সামর্থ্যও নেই সুশীলের। গঞ্জের হাটে ছোট পরিসরে তার মাটির হাঁড়ি পাতিলের দোকান। অল্প পুঁজির ব্যবসা। আয় রোজগারও কম। এদিকে বউয়ের রাক্ষুসে ক্ষুধা। ঘরে চাল থাকলে সে তিন বেলাই ভাত খায়। সুশীল ও তার মা গৌরীবালা দু’জন মিলে যা খায়, কল্পনা একা একবেলাতেই তা’ খেয়ে ফেলে। গৌরীবালা বিড় বিড় করে বউয়ের মুণ্ডপাত করে। হাভাতে ঘরের বেটি। এভাবে খেলে সংসার তো লক্ষ্মীছাড়া হবেই। বাস্তুভিটা ছাড়া সুশীলের এক কানি আবাদি জমি নেই। চাল কিনতে কিনতে তার ফকির হওয়ার দশা। কিন্তু উপায় কী? বউকে তো আর উপোষ রাখা যায়না।
আশেপাশে আরো দশ বারো ঘর কুমারের বাস। তারা সুশীলকে দেখলে অহেতুক দাঁত কেলিয়ে হাসে। নাদুস নুদুস বউয়ের পাটখড়ি স্বামী। সুশীল লজ্জা পায়। কিন্তু কিছু বলতে পারেনা। সে মাথা নিচু করে চলাফেরা করে। গ্রামের এই অংশটি অনাদিকাল থেকে পালপাড়া নামে পরিচিত। যদিও পালেরা এখন অনেকেই পৈতৃক ব্যবসা থেকে সরে গেছে। দিনরাত পশুর মতো খেটেও এ পেশায় ভাত জোটে না। এ্যালুমিনিয়াম, স্টীল, মেলামাইন, সিরামিক আর প্লাস্টিক এসে মাটির তৈরি হাঁড়ি পাতিল ও তৈজসপত্রের ব্যবসা কেড়ে নিয়েছে। গ্রামের মানুষরাও আজকাল আর মাটির হাঁড়ি পাতিল কিনতে চায় না। সাত পুরুষের ব্যবসা আঁকড়ে পড়ে থেকে লাভ কী? তাই পালদের অনেকেই এখন খালে বিলে মাছ ধরে আর ক্ষেতমজুরী করে। সুশীলের মতো দু’চারঘর পাল টিকে আছে কোনমতে। মাটির তৈরি হাঁড়ি পাতিল, কলস, সরাই, ঢাকনা, সানকি এসবের বিক্রি প্রায় নেই বললেই চলে। মাটির পুতুল, মাটির ব্যাংক, হাতি, ঘোড়া, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এইসব বেঁচে কোনরকমে পেট চলে। গরমের সময় সরাই, কলস কিছু বিক্রি হয়। তবে দুর্গাপূজার সময় সুশীলের আয় রোজগার ভালো। পালপাড়ার কুমারদের মধ্যে সুশীলের হাতের কাজের সুনাম আছে। এই গাঁয়ের দুটো বারোয়ারী পূজার প্রতিমা তাকেই তৈরি করতে হয়। আশেপাশের গ্রাম গুলো থেকেও অর্ডার আসে। সুশীল তার মা আর বউকে নিয়ে তখন সারা দিন রাত কাজ করে। মোটা বউটা হাঁসফাঁস করতে করতে মাটিতে জল মিশিয়ে কাদা ছানে। বৃদ্ধা গৌরীবালা সুতো দিয়ে কানে ঝোলানো মোটা কাঁচের চশমা পরে প্রতিমার গায়ে আঁকিবুকি কাটে। ভুল হলে ছেলের কাছে ধমক খায়।
সুশীল ছোটবেলায় তার বাবার হাত ধরে কাজ শিখেছে। তখন এই গ্রামসহ আশেপাশের প্রায় এক কুড়ি গ্রাম ছিল হিন্দুপ্রধান। ছিল জমিদার লোকনাথ চৌধুরীরা তিন ভাই। সার্বজনীন পূজার পাশাপাশি জমিদার বাড়িতেও জাঁকজমকের সাথে পূজা হতো। আর শুধু কি দুর্গাপূজা? লক্ষ্মী, স্বরস্বতী, গনেশসহ সব রকম প্রতিমা তৈরির কাজ পেত সুশীলের বাবা। আশ্বিন মাসে জমিদার বাড়িতে তার ডাক পড়তো। প্রতিমা তৈরির বায়না বাবদ জমিদার পত্নীর কাছ থেকে একজোড়া ধূতি, একখানা গামছা, এক ভাঁড় রাবড়ি আর পাঁচ সিকে পয়সা পেয়ে সুশীলের বাবা আভূমি মাথা ঠেকিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতো। বাবার দেখাদেখি আট দশ বছরের সুশীলও তাই করতো। সেসব দিন কোথায় গেল, কে জানে? জমিদারী উঠে গেল। লোকনাথ চৌধুরী মারা গেল। তার দুই ভাই বিশ্বনাথ ও ভোলানাথ চৌধুরী সপরিবারে হিন্দুস্তান চলে গেল। তাদের আগে পরে বাড়িঘর জায়গা জমি বেঁচে ও বিনিময় করে বহু হিন্দু পরিবার ওপারে চলে গেল। সুশীলদের মতো যাদের নেহাত কোথাও যাবার কোন উপায় নেই, শুধু তারাই কপালে সংখ্যালঘুর তকমা ঝুলিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে রইল। সুশীলের বাবা ক্ষয়রোগে ভুগে দেশ স্বাধীন হবার আগেই মারা গেল। যুদ্ধের সময় সুশীলের যুবতী বোনটাকে গ্রামের রাজাকাররা ধরে নিয়ে গিয়ে আর্মি ক্যাম্পে দিয়ে এল। তাকে ফিরে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে সুশীল মাকে নিয়ে পালিয়ে গেল ভারতে। সেখানে নয় মাস শরণার্থী শিবিরে কাটিয়ে দেশ স্বাধীন হবার পর আবার ফিরে এল গ্রামে। পোড়া ভিটায় কোনমতে একখানা ঘর তুলে আবার মাটি পুড়িয়ে শুরু হল তার পেটের জ্বালা মেটানোর সংগ্রাম।
সুশীলের অনেক বয়স হলো, অথচ সে বিয়ে করছে না দেখে নানা জনে নানা কথা বলে। মানুষের কথার অত্যাচারে শেষে বিয়ে করা হলো। কিন্তু বউটা মোটা হয়ে যাওয়ায় কথার অত্যাচার পিছু ছাড়ে না। চালের দাম বাড়ছে কেন, সুশীলের ঘরে গিয়ে ওর বউকে দেখো। মেঝের মাটি দেবে যাওয়ায় বানের জল সুশীলের ঘরে ঢোকে। শুধু নুন ভাত খেয়েই এই দশা, ব্যঞ্জন পেলে আরো না জানি কী হয়!
দেহ কমানোর জন্য যে যা বলে, কল্পনা তাই খায়। শেকড় বাকড়, তেলাকুচার পাতা, নিমের রস, তুলসী পাতার ছেঁচা। কিছুতেই কিছু হয় না। একবেলা না খেয়ে থাকলে অন্যবেলা হাঁড়িতে দু’মুঠো চাল বেশি নিতে হয়। উপোষ থাকা মানে কল্পনার অর্ধেক মরে যাওয়া। ঘর ঝাড়ু দিতে ওর কষ্ট হয়। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে। দু’হাঁটুতে ভীষণ ব্যথা। একটানা দু’মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে। বারো হাত শাড়িতেও শরীরটা ঠিকমতো ঢাকে না। অথচ এমন মায়ের বুকে দুধ নেই। মেয়েটার জন্মের পর মাসখানেক অল্প স্বল্প দুধ পেয়েছিল। তারপর আর নেই। কলমির শাক, শাপলার ডাঁটা, অনন্তমূল, নিশিন্দার পাতা এত কিছু খেয়েও কল্পনার বুকে দুধ আসেনা। ইন্দ্রাণী ক্ষিধের জ্বালায় কুন কুন করে কাঁদে আর বুড়ো আঙুল মুখে পুরে চুষতে থাকে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কল্পনার ভারি কষ্ট হয়। মায়ের মন! নিজের শুকনো বুকে মেয়ের ক্ষুধার্ত মুখটা বার বার চেপে ধরে। কিন্তু ইন্দ্রাণী দুধ না পেয়ে মুখ সরিয়ে নেয়। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।
গোষ্ঠ পালের পাঁঠীটা বাচ্চা বিয়ানোর পর ওর বউ দু’একদিন পর পর মাটির খুরিতে করে যৎসামান্য দুধ দিয়ে যেতো। এখন সে দুধও বন্ধ হয়ে গেছে। পাঁঠী আর দুধ দেয় না। ইন্দ্রাণীর কান্না শুনে কল্পনা চোখে অন্ধকার দেখে। জল ঢেলে ভাতের মাড় পাতলা করে মেয়েটাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে সে। ইন্দ্রাণী খেতে চায় না। হাত পা ছুঁড়ে তারস্বরে চিৎকার করে।
সুশীলের বেচাকেনা নেই। সামান্য যা হয়, তা’ চাল কিনতেই শেষ। সেই চালে দু’বেলাও তিনটি পেট ভরে না। পূজা পার্বণ থাকলে মেয়েটার এত কষ্ট হতো না। গঞ্জের হাটে গরুর দুধ বিক্রি হয়। কিন্তু তারা বাঁকি দিতে চায় না। বাঁকিতে দুধ বেচলে নাকি গরুর দুধ দেওয়া কমে যায়। তাছাড়া ওদের ঘরেও অনেক গুলো মুখ হাঁ করে থাকে। দুধ বিক্রি হলে তবে ওদের অন্ন জোটে। বাঁকিতে দুধ দেবে কী করে? গাঁয়ে যাদের গরু আছে, তারা সুশীলের ছায়া মাড়াতে চায় না। পালপাড়ায় কারো গরু নেই। তাদের অবস্থা আরো করুণ। মুসলমানদের কাছে দুধ চাইতে সুশীলের লজ্জা করে, ভয়ও লাগে।
কল্পনার পেট পুরে খাওয়া জোটে না। মেয়ে ইন্দ্রাণীর মতো তারও ক্ষিধের কষ্ট। কিন্তু তার ঢবঢবে মোটা শরীর দেখে কে বলবে যে সে অর্ধাহারে অনাহারে আছে? সবাই শুধু ঠাট্টা করে। কল্পনা ঘরে বসে আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। নিজের কষ্ট সহ্য হয়, কিন্তু তিন মাসের শিশুকন্যা ইন্দ্রাণীর কষ্ট যে তার সহ্য হয়না। মেয়েটার কান্না শুনতে শুনতে সুশীল অস্থির হয়ে যায়। বিরক্ত হয়ে সে অনেক রাত পর্যন্ত মেম্বার মতি মিয়ার বাঁশের ঝাড়ের পাশে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। বাঁশের ঝাড়ের গা ঘেঁষে মতি মিয়ার কামলা মনসুরের একচালা ছনের ঘর। ক’দিন আগে তার বউয়েরও বাচ্চা হয়েছে। কিন্তু তার বাচ্চার কান্না শোনা যায়না। মনসুরের অবস্থা সুশীলের চেয়ে ভালো নয়। একমুঠো এনে আধামুঠো খাওয়া। তার বউটাও পেট ভরে খেতে পায় না। সুশীল রাতের আকাশে মিটমিটে তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো মনে মনে ভগবানকে খোঁজে সে। তার যে কিছু নালিশ আছে ভগবানের কাছে! তিনি ছাড়া তার নালিশ আর কে শুনবে?
ভগবান বোধহয় সত্যি সত্যিই একদিন তার নালিশ শুনলেন। সেদিন হাট থেকে ফিরতে সুশীলের বেশ রাত হয়ে গেল। বেচাকেনা একটু ভালো হওয়ায় সেদিন সে মাটির ভাঁড়ে ইন্দ্রাণীর জন্য দশ টাকার দুধ নিয়েছে। এক কেজি চাল আর আধা কেজি আলু কিনে গামছায় বেঁধে ঘাড়ে ফেলে দুধের ভাঁড় হাতে লম্বা লম্বা পা ফেলে সুশীল ঘরে ফিরলো। দেখলো চারদিক একেবারে শান্ত। ইন্দ্রাণীর কান্নার আওয়াজ নেই। অবশ্য ক’দিন থেকে ইন্দ্রাণী দিনের বেলা এক আধটু কাঁদলেও রাতে আর মোটেও কাঁদে না। কেন কাঁদে না, কে জানে? বৃদ্ধা গৌরীবালা মাটির বারান্দায় দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু ঘরে কল্পনা বা ইন্দ্রাণী কেউ নেই। ব্যাপার কী? ওরা গেল কোথায়?
মায়ের ঘুম ভেঙ্গে যাবে বলে সুশীল সাড়া শব্দ না করে গামছার পোঁটলা ও দুধের ভাঁড় ঘরের মেঝেতে নামিয়ে রেখে চিন্তিত মুখে ওদের সন্ধানে বের হলো। রাতের পালপাড়া নির্জন নিস্তব্ধ। কোন ঘরে কোন আলো নেই। আশেপাশে কোথাও ওদের খুঁজে না পেয়ে সুশীল ঘাবড়ে গেল। এমন তো কোনদিন হয় না! শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় মতি মিয়ার বাঁশের ঝাড়ে মৃদুমন্দ বাতাসের ঢেউ। কী ভেবে সেদিকে খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত নিল সুশীল। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বাঁশের ঝাড় পেরিয়ে পুকুরের কাছাকাছি আসার পর চাঁদের আলোয় দু’জন নারীর অবয়ব চোখে পড়লো ওর। পুকুর পাড়ে একটা খেজুর গাছের পাশে বসে রয়েছে ওরা। কিন্তু ওরা কারা? এত রাতে কি করছে ওখানে? সুশীল ওদের পেছন থেকে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে দেখলো, ওর বউ কল্পনা আর মনসুরের বউ সালেহা ঘাসের ওপর পাশাপাশি বসে ফিস ফিস করে কথা বলছে। সে অবাক হয়ে দেখলো, ইন্দ্রাণীকে বুকে নিয়ে সালেহা পরম মমতায় দুধ খাওয়াচ্ছে আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চাঁদের আলোয় কল্পনার আধখানা মুখে তৃপ্তির হাসি। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। জোনাকিরা উড়ে উড়ে আলো ছড়াচ্ছে বাঁশ ঝাড়ে। কোথাও কেউ নেই। সুশীলের মনে হলো, শুধু ঈশ্বর আছেন এখানে, যিনি দৃশ্যমান না হয়েও সব জায়গায় থাকেন। এত সুন্দর দৃশ্য তিনি কী আর দেখছেন না?
*******************************************
এই গল্পটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস প্রফেসর ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘নতুন দিগন্ত’ – এর ত্রয়োদশ বর্ষ এপ্রিল-জুন ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত। গল্পটি অনেক আগে সামু ব্লগেও প্রকাশিত হয়েছে। ব্লগার বন্ধুদের মধ্যে যারা এটি পড়েননি, তাদের জন্য গল্পটি পুনরায় পোস্ট দিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৪৭