‘হাকিম’ আর ‘হেকিম’ এই দুটো শব্দের অর্থ আমি অনেক বড় হয়েও মাঝে মধ্যে গুলিয়ে ফেলতাম। হল্যান্ড আর নেদারল্যান্ডস যে একই দেশ সেটা জানা না থাকায় একবার স্কুলে ইংরেজি স্যারের কাছে ভীষণ উত্তম মধ্যম খেয়েছি। আবার কী ব্যাড লাক দেখুন, ডাচরা যে সেই হল্যান্ডেরই লোক তাও জানতাম না। এ জন্য ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে ইতিহাসের স্যার ক্লাস নাইনে আমাকে নিল ডাউন করিয়ে রেখেছিলেন। লজ্জায় মাথা কাটা যাবার মতো অবস্থা।
অংকে যাচ্ছে তাই ছিলাম বলে অংক টিচার যাচ্ছে তাই ভাষায় আমাকে গালি গালাজ করতেন। সবগুলো গালি বলা যাবে না, তবে দু’চারটা বলি। দু’চোখ দিয়ে পড়ে দু’কান দিয়ে বের করে দেবেন। যেমন- ‘খবিশ’, ‘গাধা’, ‘খচ্চর’, ‘পাঁঠা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সবগুলোই ইতর শ্রেণীর প্রাণী। হাতের লেখা সামান্য সাফ–সুতরো ছিল বলে বাংলা স্যারের কাছে অতটা হেস্ত নেস্ত হতে হয়নি, তবে মাইকেলের মেঘনাদ বধ কাব্য বুঝতে না পেরে একবার কাব্যটিকে ‘জঘন্য’ বলায় স্যারের কাছে মৃদু কানমলা খেতে হয়েছে।
১৯৭০ সালে এস,এস,সিতে আমার উর্দু ছিল। অন্য সব বিষয়ে ধস্তাধস্তি করে ষাট বাষট্টি পেলেও উর্দুতে পেয়ে গেলাম আঠাত্তর। দুই কম লেটার মার্ক। মাতৃভাষায় বাষট্টি, আর উর্দুতে আঠাত্তর? সবাই অবাক এবং বেকুব। কিন্তু তারা তো জানেনা, আবুহেনা বাজারের পয়সা চুরি করে কতোগুলো উর্দু সিনেমা দেখেছে? উর্দু ছবি ও নায়ক নায়িকাদের নাম তার মুখস্থ। এমনি এমনি উর্দুতে আঠাত্তর পাওয়া যায় না।
তবে আমাদের ক্লাসে আমার চেয়েও রদ্দিপচা মাল আরো একটি ছিল। তার নাম আকবর। আজকের গল্প সেই আকবরনামা থেকে।
আকবরের বাবা শহরের নাম করা ব্যবসায়ী। টাকা পয়সা তার হাতের ময়লা। কিন্তু পড়ালেখায় ক-অক্ষর গোমাংস। এমন লোকের ছেলে যে মাঝে মাঝে ফেল করবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। আমি যখন ক্লাস এইটে উঠে আকবরকে ধরে ফেললাম, তখন নিচের ক্লাসগুলোতে তার তিন চারবার ফেল করা হয়ে গেছে। ক্লাস এইটেও সে সেকেন্ড হ্যান্ড মাল। ফলে তার পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি দেহের পাশে আমরা চার ফুট দশ এগারো মাপের সহপাঠীরা নেহাতই বেমানান।
এই আকবরের সাথে কিভাবে যে আমার বটের আঠার মতো গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গেল, সে রহস্য আজও রহস্যই থেকে গেছে। হয়তো রতনে রতন চেনে, শুয়োরে চেনে কচু-এ জাতীয় কোন শানে নজুল আছে। আকবরের পকেটে অঢেল টাকা। আর সেই টাকা সে খই মুড়ির মতো ওড়ায় (আজকাল অবশ্য খই মুড়ি আর অত ফালতু জিনিষ নয়। ভুট্টার খই তো পপ কর্ণ নাম ধারণ করে রীতিমতো জাতে উঠে গেছে)। আকবরের রাজকীয় খাই-খরচা দেখে সহপাঠীরা তাকে বাদশা আকবর বলে ডাকে। এই ডাক শুনে আকবর খুশিই হয়। তার কথাবার্তা তখন রাজা বাদশাদের মতো হয়ে যায়।
যাই হোক, জিন্নাহর ছবিওয়ালা একশো টাকার নোট আকবরের কাছেই আমি প্রথম দেখি। আমার জীবনে যা কিছু প্রথম, তার অনেকগুলোই আকবরের কাছে দেখা ও শেখা। যেমন, দুপুরবেলা টিফিন আওয়ারে ক্লাস থেকে পালিয়ে সিনেমা হলে ম্যাটিনী শো দেখতে যাওয়া, স্কুলের পেছনে সীমানা প্রাচীরের আড়ালে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট ফোঁকা, রাস্তায় স্কুল ফেরত মেয়েদের দেখলে টিজ করা (যদিও ঐ বয়সে আমি টিজ করার মধ্যে আনন্দের কিছু পাইনি। এই কুকর্মটি আকবরের দেখাদেখি করা)।
এসব করতে গিয়ে ধরা পড়লে আকবরের বিশেষ কিছু হতো না, কিন্তু আমার যা হতো তা’ কহতব্য না। স্কুলে স্যারদের হাতে বেত্রাঘাত, বাসায় মায়ের হাতে চপোটাঘাত, এমনকি টিজের শিকার হওয়া এক দুঃসাহসী মেয়ের চপ্পলাঘাত পর্যন্ত সবই কপালে জুটেছে। ঘটনার সময় আকবর তার লম্বা লম্বা পায়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। চিৎকার করে বলে, ‘হেনা, পালা রে, পালা।’ কিন্তু আমি মেয়েটির পা থেকে স্যান্ডেল খোলা দেখেও বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকি। আকবর দূর থেকে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে ভাঙ্গা গলায় দুঃখের গান গায়, “ আমি কেন পাগল হইলাম না, মনের মতো পাগলি পাইলাম না।” মেয়েটি তার দিকে স্যান্ডেল তাক করে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, ‘এদিকে আয়, কুকুর!’
পরে দেখা হলে আমি আকবরকে বলি, ‘আমাকে রেখে তুই নিমক হারামের মতো পালিয়ে গেলি কেন?’ আকবর খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলে, ‘পালাবো না কার ভয়ে? তুই ব্যাটা আহাম্মক নাকি? কলাগাছের মতো দাঁড়িয়ে ছিলি! তোকে পালাতে বললাম না!’
ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষায় পাস করে আমরা সবাই নাইনে উঠে গেলাম। আকবর যথারীতি ফেল করে এইটেই থেকে গেল। আমার কপাল ভালো যে সে ফেল করেছিল। তা’ না হলে আমার জিন্দেগি ফানা ফিল্লা হয়ে যেতো। আকবরের বন্ধু বদল হল। আমার মতো আর একটি রত্ন জুটিয়ে নিয়ে সে চুটিয়ে তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে লাগলো। রত্নটির নাম আবার রতন। আকবর আর রতনকে প্রায়ই দেখা যেত স্কুলের মাঠে ঠা ঠা রোদের মধ্যে দুই কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। স্কুলের এই এক নিয়ম। গুরুতর অপরাধ করলে হেডমাস্টার স্বয়ং এই শাস্তির ব্যবস্থা করতেন। মাঠের তিন দিকের ক্লাসরুম গুলো থেকে স্কুলের সব ছাত্র এই শাস্তি দেখে যেন সতর্ক হয়ে যায় এবং শাস্তি পাওয়া ছাত্রটিও লজ্জা পেয়ে যাতে ভবিষ্যতে আর অমন কুকর্ম না করে, সে জন্য হেড স্যারের এই ব্যবস্থা। বদমাশ ছাত্রকে লজ্জা দেওয়ার জন্য ব্যবস্থাটি মন্দ না। তবে আকবর লজ্জা পেলে তো! তাকে লজ্জা দেওয়া এত সহজ না। তার বাবাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে তার হাতে ছেলের পকেট থেকে উদ্ধার করা সিগারেটের প্যাকেট ও দিয়াশলাই তুলে দেওয়া হলে বাবার চড় থাপড় খেয়ে আকবর টিচার্স রুমের বাইরে এসে খ্যাক খ্যাক করে হাসে। বলে, ‘আমার বাবা একটা রামছাগল। দোকানে কী ঐ এক প্যাকেট সিগারেটই ছিল? কী রে রতন, কোম্পানি কী ঐ এক প্যাকেট সিগারেটই বানিয়েছে?’ রতন বলে, ‘নো, মানে না। এক প্যাকেট বানিয়ে কোম্পানির পেটে ভাত হবে না।’ তারপর দু’জনের সে কী হাসি! খ্যাক খ্যাক খ্যাক, হা হা হা, ঠা ঠা ঠা!
তো সেই আকবরের সাথে আমাদের চিরতরে সম্পর্কচ্ছেদ হল আরও একবছর পর। আমরা তখন ক্লাস টেনে। আর আকবর হাঁচরে পাঁচরে কোন রকমে ক্লাস নাইনে ওঠার পর এক গুরুতর অপরাধে (বলতে লজ্জা হচ্ছে) স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে ফোর্স টি, সি দিয়ে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিল। আকবরের লেখাপড়ার সেখানেই ইতি।
এরপর অনেকদিন তার সাথে আর কোন যোগাযোগ ছিলনা। কালে ভদ্রে দেখা হতো। বাবার মৃত্যুর পর সে তার পৈতৃক ব্যবসার হাল ধরেছিল এটুকু জানতাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চাকরি জীবনে প্রবেশ করার পর প্রায় কুড়ি বছর তার সাথে মোটেও দেখা হয়নি। তারপর একদিন দেখা হল। সেটা ২০০০ সালের কথা। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঝোলানো সাদা জোব্বা, মাথায় টুপি, মুখে কাঁচাপাকা লম্বা দাড়ি এসবের আড়ালে আকবরকে চেনাই যায়না। কিন্তু সে আমাকে ঠিকই চিনে ফেলেছে।
‘কী রে হেনা, কেমন আছিস?’
আমি অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে শেষে চিনতে পেরে বললাম, ‘আরে আকবর, তুই? কেমন আছিস?’
কথায় বলে, বাঁদর বুড়ো হলেও গাছে ওঠে। আকবর বললো, ‘আমার আর থাকা! তোরা হলি অবিচার (অফিসার) মানুষ, আমাদের মতো দুই কানদার (দোকানদার) লোকেরা কী আর তোদের মতো ভালো থাকতে পারে? এই আছি জোড়াতালি দিয়ে আর কী!’ তারপর সে আমাকে একরকম জোর করে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে বসালো। দেখলাম, জোড়াতালির কথা বললেও আসলে তার ব্যবসা রমরমা। বিভিন্ন কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ ও ডিলারশিপের মহাযজ্ঞ। ট্রাকের পর ট্রাক মাল আসছে আর যাচ্ছে। গোডাউন আর শো রুমে শতাধিক কর্মচারী দিন রাত ব্যস্ত। এই যদি হয় জোড়াতালি দিয়ে চলা তো তাহলে ভালোভাবে চলা কাকে বলে কে জানে?
যাই হোক, আকবর তার কর্মচারীদের হুকুম করে আমার জন্য শিঙ্গাড়া, মাংসের চপ, মিষ্টি, দু’তিন রকম ফল, এসপ্রেসো কফি, কোক আর এক প্যাকেট বেনসন আনিয়ে দিল। আমি বললাম, ‘তোর সেই ধুম ধাড়াক্কা খরচের অভ্যাস এখনো যায়নি দেখছি।’ আকবর দুঃখের সাথে বললো, ‘খরচ আর করতে পারছি কই দোস্ত? ব্যাংক লোণে ডুবে আছি। সেই দুধ দিয়ে কুলি করার দিন আর নাই।’
খেতে খেতে গল্প গুজব হল। আকবরের এক মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়েটির বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। আকবরের মতোই ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারে। জামাই-মেয়েকে বারিধারায় প্রায় এক কোটি টাকা দিয়ে এক আলিশান ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে আকবর। দুই ছেলের বড়টি অস্ট্রেলিয়ায় পি এইচ ডি করছে। আর ছোটটি বুয়েটে পড়ে। কর্মচারীরা যাতে শুনতে না পায়, সে জন্য আকবর আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে ফিস ফিস করে বললো, ‘আমার দুই ছেলের কেউ ব্যবসা করতে চায়না। তারা অনেক লেখাপড়া করে তোদের মতো অবিচার (অফিসার) হতে চায়। কিন্তু আমার মতো লেখাপড়ায় ডাব্বা মারা লোকের ছেলেদের এই ঘোড়ারোগ হলো কিভাবে বুঝতে পারছি না। এ তো ডুমুর গাছে আঙুর ধরার মতো ব্যাপার! আচ্ছা দোস্ত, ওরা সত্যিই আমার ছেলে তো? আমার কিন্তু সন্দেহ হয়।’
আমি আলগোছে আকবরকে একটা ঘুষি মেরে বললাম, ‘ছি ছি, তোর সেই খাসলত আর গেলনা! তোর মুখে নারকেলের ছোবা ঘষে দেয়া দরকার। আলেমের ঘরে জালেম আর জালেমের ঘরে আলেম কী জন্মায় না? খুব জন্মায়। তুই এখন মৌলবি মুন্সি মানুষ। তোর মুখে এসব কী কথা? এমন কথা আর কখনো বলবি না আকবর।’
মসজিদে জোহরের আজান শুনে আকবর উঠে পড়লো। বললো, ‘চল্ দোস্ত, নামাজ পড়ে আসি। তারপর দু’জন মিলে ডিনার খেতে যাবো, ঠিক আছে?’
আমি বললাম, ‘না, ঠিক নাই। ওটা ডিনার হবে না, লাঞ্চ।’
‘ওই হলো। চল্ ওঠ।’
বাদশা আকবরের সাথে সেদিন আর আমার দুপুরবেলা ডিনার (?) খাওয়া হয়নি। জরুরী কাজ থাকায় চলে এসেছিলাম।
**********************************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১২:০২