আতাউর মামা। পিতা পুত্র সবারই মামা। তাকে ডাকার প্রয়োজন হলে ছোট বড় সবাই ‘মামা’ বলে ডাকে। এই ডাকের উৎপত্তি কীভাবে হল, কেউ জানে না। যারা তাকে এই নামে ডাকে, তারা কেউ তার ভাগ্নে নয়। আতাউর মামার কোন বোন নেই। তার ভাগ্নে আসবে কোত্থেকে? আগের জেনারেশন ‘মামা’ বলে ডেকে গেছে, বর্তমান জেনারেশনও ‘মামা’ বলে ডাকছে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, আতাউর মামার বয়স অনেক। আশির কাছাকাছি তো বটেই। কিন্তু মামার দেহে কোন রোগ ব্যাধি নেই। এখনো তিনি উদ্দেশ্যহীনভাবে শহরের ভেতর বাইরে মাইলের পর মাইল হাঁটেন। আর তাকে চেনে না, এমন লোক এই শহরে প্রায় নেই বললেই চলে। পাতলা একহারা শরীর। মুখে সাদা দাড়ি। মাথার সামনের দিকে টাক, পেছন দিকে অবিন্যস্ত পাকা চুল। এই বয়সেও তার হাঁটার গতি অবিশ্বাস্য রকমের দ্রুত।
আতাউর মামা এক সময় ব্যবসা করতেন। ঠিকাদারি আর ইট ভাটার ব্যবসা। এই ব্যবসা করে তিনি অঢেল টাকা পয়সা রোজগার করেছেন। সেই টাকায় তিনি তার মহল্লায় বিরাট আলিশান বাড়ি করেছেন। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন রাজকীয় ভাবে। ধুম ধাম করে নিজেও আর একটা বিয়ে করেছেন। প্রথম বউয়ের পুত্রসন্তান ছিল না। দ্বিতীয় বউ দুটি পুত্রসন্তান উপহার দিয়েছে তাকে। এতে আতাউর মামা ছোট বউয়ের ওপর খুব খুশি। কিন্তু আশ্চর্য কী জানেন? ভালোবাসা যদি দাঁড়িপাল্লায় মাপা যেত, তাহলে বড় বউয়ের দিকের পাল্লাই ভারী হতো। বড় বউ মারা যাবার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে আতাউর মামার চাল চলনে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিল। তিনি ব্যবসাপাতি সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে শহরের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিলেন। লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরে খালি পায়ে তিনি বিরামহীন হেঁটে বেড়ান। কখনো কখনো বিড় বিড় করে নিজের সাথে নিজেই কথা বলেন। আর সব চেয়ে অবাক করা ব্যাপার যেটা ঘটলো, তা’ হল বিনা আমন্ত্রণে তিনি যে কোন বিয়েবাড়ি, খৎনা বা আকিকার অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে যান। সেখানে পেট পুরে খেয়ে দেয়ে তিনি আবার পথে নেমে পড়েন।
মামার ছেলেরা বড় হয়ে ব্যবসার হাল ধরেছে। ছেলে ও জামাইরা মামার এই বেহায়াপনায় ভীষণ লজ্জা পায়। বহুবার নিষেধ করেও মামাকে তারা এ কাজ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। মহল্লার লোকজন এ নিয়ে টীকা টিপ্পনী কাটলে তারা অসহায়ভাবে বলে, ‘কী করবো বলেন? শেকল দিয়ে তো আর বাড়িতে বেঁধে রাখা যায় না! উনি চাইলে বাড়িতে প্রতিদিন পোলাও মাংস রোস্ট রেজালা রান্না করে দেওয়া যায়। অনেকবার করাও হয়েছে। কিন্তু উনি তো ওসব ছুঁয়েও দেখেন না। আমরা কী করবো বলেন? মানুষের বাড়িতে খাওয়ার মধ্যে যে কী আনন্দ আছে, তা’ একমাত্র উনি আর আল্লাহ জানেন!’
আতাউর মামাকে ঠিক পাগল বলা যায় না। অবিরাম হাঁটা আর মানুষের বাড়িতে বিনা নিমন্ত্রণে খাওয়া ছাড়া তার আচার আচরণে কোন অস্বাভাবিকতা নাই। তিনি কাউকে গালি গালাজ করেন না। কথাবার্তাতেও ভারসাম্যের অভাব নাই। শান্ত শিষ্ট নিরীহ মানুষ। তার কথাবার্তা গুলো লক্ষ্য করুনঃ
‘আচ্ছা মামা, এই যে আপনি দাওয়াত ছাড়া মানুষের বাড়িতে খেয়ে বেড়ান, এতে আপনার লজ্জা লাগেনা?’
‘লজ্জা তো লাগেই। তবে আমার চেয়ে আমার ছেলেরা আর মেয়ে জামাইরা বেশি লজ্জা পায়।’
‘তারা লজ্জা পায় কেন? তারা তো আর খেতে যায় না!’
‘বোকা ভেবে আমার সাথে ইয়ার্কি করছো?’ আতাউর মামা ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘আমি বিনা দাওয়াতে এখানে ওখানে খেয়ে বেড়াচ্ছি, আর আমার পরিবারের লোকেরা লজ্জা পাবেনা?’
কারো কথাবার্তা পছন্দ না হলে আতাউর মামা কোন রকম হৈ চৈ না করে সেখান থেকে নিরবে চলে যান। ছেলে বুড়ো অনেকেই পাগল ঠাউরে মামাকে ধোঁকা দেয়। যেমন কেউ হয়তো বলে, ‘মামা, ঐ যে বাড়িটাতে লাল নীল মরিচ বাতি জ্বলছে, ওখানে আকিকার খাওয়া দাওয়া হচ্ছে। বিরিয়ানি, রোস্ট, রেজালা, কাবাব। সাথে বুরহানি আর দই মিষ্টি আছে।’
আতাউর মামা সরল বিশ্বাসে জিজ্ঞেস করেন, ‘সত্যি বলছো?’
‘আপনাকে মিথ্যে বলবো, মামা? ছিঃ ছিঃ। আমি এইমাত্র খেয়ে এলাম। বিশ্বাস না হলে আমার হাত শুঁকে দেখেন!’
আতাউর মামার চোখ দুটো চক চক করে ওঠে। বলেন, ‘যাবো তাহলে?’
‘অবশ্যই যাবেন। দেরি করলে কিন্তু খাবার ফুরিয়ে যাবে, মামা!’
আতাউর মামা স্বভাবসুলভ দ্রুত গতিতে ছুটে যান বাড়িটার দিকে। কিন্তু সেখানে খাওয়া দাওয়ার কোন ব্যাপার নাই। হয়তো কোন এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন বা জেলা সমিতির জয়ন্তী উৎসব চলছে। নির্ধারিত সংখ্যক লোকজন। অনেক ভারী ভারী কথাবার্তা শেষে কেক-কোকের ব্যবস্থা। আর নয়তো বড়জোর হালকা পাতলা প্যাকেট ডিনার। বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। গেটের দারোয়ানের কাছে ধমক খেয়ে লুঙ্গি পরা আতাউর মামাকে চলে আসতে হয়। কিন্তু তিনি ধোঁকাবাজ ভাগ্নেকে না খুঁজে নির্বিকার চিত্তে অন্য পথে হাঁটা দেন।
আতাউর মামা এই বয়সেও বিস্তর খেতে পারেন। কমিউনিটি সেন্টারে খাওয়া দাওয়া হলে নির্ধারিত প্লেটে তার পোষায় না। কিন্তু বাড়িতে খাওয়া দাওয়া হলে তার পুষিয়ে যায়। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে ‘মামা, আর কত খাবেন? এবার ওঠেন তো!’ বলে প্রথম ব্যাচে খেতে বসা আতাউর মামাকে দ্বিতীয় ব্যাচ থেকে টানা হ্যাঁচড়া করে উঠিয়ে দিতে হয়েছে। মামা অবশ্য এতে বেশ লজ্জা পান। তবে কাউকে কিছু বলেন না। বিব্রত মুখে চুপচাপ উঠে পড়েন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আতাউর মামার মানুষ চেনার ক্ষমতা কমে যেতে লাগলো। নিজের ছেলে মেয়েদেরও অনেক সময় ঠিক মতো চিনতে পারেন না। নিজের বাড়ি মনে করে পাশের বাড়ির কলিং বেল টিপে দেন। এই শহরেই তার বড় জামাইয়ের বাড়ি। একদিন জামাইয়ের মেয়ের বিয়েতে মেহমানদের সাথে মিশে তিনি চুপি চুপি খেয়ে চলে এলেন। জামাই দূর থেকে সবই দেখলো। কিন্তু মেহমানদের মধ্যে লুঙ্গি পরে বসে শ্বশুরকে খেতে দেখে জামাই লজ্জায় আর সেদিকে গেল না।
আতাউর মামার ভাগ্নেরা, বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলে ছোকরারা আরও বেশি করে মামাকে উত্যক্ত করা শুরু করলো। তারা আড়াল থেকে ইটের খোয়া বা নুড়ি পাথর ছুঁড়ে পালিয়ে যেতে লাগলো। এতে মামার শরীরে সামান্য খাম জখম হলেও তার কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। তিনি বরাবরের মতো দুরন্ত স্পীডে সারা শহর চষে বেড়াতে লাগলেন। খানাপিনার গন্ধ পেলে তিনি সে বাড়িতে ঢুকে পড়েন। আগে কেউ বাধা না দিলেও ইদানিং অনেক বাড়ি থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর কমিউনিটি সেন্টারে ভিক্ষুক মনে করে তাকে ঢুকতেই দেওয়া হয় না। লুঙ্গি পরা, খালি পায়ের উস্কোখুস্কো চুলওয়ালা একটা আপদ কিসিমের লোককে তারা ঢুকতে দেবেই বা কেন? আতাউর মামার দাওয়াত খাওয়া দিনে দিনে সীমিত হতে লাগলো। একদিন তো তাকে আহাররত অবস্থায় এক অনুষ্ঠান থেকে কয়েকজন যুবক টেনে হিঁচড়ে তুলে গলাধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দিল। মামা খুবই শরমিন্দা হলেন। লজ্জায় মুখ নিচু করে দ্রুত সেখান থেকে তিনি পালিয়ে গেলেন।
উপায়ান্তর না দেখে ছেলেরা তাদের বাবাকে পাবনার পাগলা গারদে রেখে এল। এ ছাড়া আর কিই বা করা যেত? আতাউর মামার জন্য তার ছেলে মেয়ে জামাই নাতি সবাই অপদস্থ হয়। এভাবে আর কত দিন?
মামা পাগলা গারদে অন্যান্য পাগলদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এই শোনো, আমি কিন্তু পাগল না। আসল ঘটনা কী জানো? আমি আকলিমার (মৃত বড় বউ) হাতের রান্না খাই, সেটা সালেহার (ছোট বউ) ছেলেদের পছন্দ নয়। তাই তারা আমাকে এখানে বন্দী করে রেখে গেছে। আমি এখান থেকে বেরিয়ে আবার আকলিমার হাতের রান্না খাবো।’
আতাউর মামার সেই কল্পনাপ্রসূত সৌভাগ্য আর হয়নি। পাগলা গারদেই তার মৃত্যু হয়।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
********************************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ৯:২২