নারায়ণগঞ্জের একটি কমবয়সী মেয়ে আমার লেখা উপন্যাস ‘স্বপ্ন বাসর’ পড়ে একদিন আমাকে ফোন করে বললো, ‘আঙ্কেল, আপনি কী আমার জীবনের কাহিনী নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে পারবেন?’
আমি বললাম, ‘চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। আপনার জীবনের কাহিনী কী, বলুন।’
মেয়েটি কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে বললো, ‘না, থাক।’
আমি বললাম, ‘আপনি নিজেই লিখে ফেলুন না! আরো ভালো হবে।’
মেয়েটি বললো, ‘আমি লিখতে পারি না। আমার অসম্ভব বানান ভুল হয়। আমি লিখলে কোন প্রকাশক ছাপাতে রাজি হবে না।’
‘আপনার নাম কী?’
‘রোখসানা’
‘কী করেন? পড়াশুনা?’
‘করতাম। এক বছর আগে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছি।’
‘কেন?’
‘সে অনেক কথা। আপনাকে পরে বলবো। আজ রাখি আঙ্কেল। স্লামালেকুম।’
মেয়েটি ফোনের সংযোগ কেটে দিল। প্রিন্ট মিডিয়ার অনেক পাঠক প্রায় প্রতিদিনই আমাকে ফোন করে আমার লেখা নিয়ে আলোচনা করে। ঢাকার একটি পত্রিকায় আমি নিয়মিত লিখি, যেখানে লেখকের কনট্যাক্ট নম্বর ছাপা হয়। ফলে পাঠকদের কাছে আমি খুবই সহজলভ্য। তাদের কেউ কেউ আবেগপ্রবণ হয়ে নিজেদের জীবনের অনেক কথা আমাকে নির্দ্বিধায় খুলে বলে। নাম ঠিকানা গোপন রেখে তাদের জীবন-কাহিনী নিয়ে লেখারও অনুরোধ করে কেউ কেউ। তাদের সাথে আমার পরিচয় নাই, চেনা-জানা নাই, অথচ তারপরেও তারা কেন তাদের জীবনের এসব স্পর্শকাতর ঘটনা আমাকে বলে দেয়, আমি জানি না। এতে অবশ্য আমার লাভই হয়। তাদের সাথে কথাবার্তা বলে আমি লেখালেখির অনেক উপাদান খুঁজে পাই।
আমি প্রধানতঃ মানুষের জীবনের বাস্তবতা নিয়ে লেখালেখি করি বলে যে কোন মানুষের জীবন-কাহিনী শোনার প্রতি আমার ঝোঁক রয়েছে। এই মেয়েটি তার জীবন-কাহিনী বলতে গিয়েও বললো না দেখে ভাবলাম, এই কাহিনী আর শোনা হবে না। কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে মেয়েটি দু’দিন পর আবার ফোন দিল। বললো, ‘আঙ্কেল, আপনি কী সত্যিই আমার কাহিনী নিয়ে উপন্যাস লিখবেন?’ আমি বললাম, ‘উপন্যাস তো অনেক বড় ক্যানভাসে লিখতে হয়। আপনার কাহিনী কী, সেটা না জানলে তো বলা মুশকিল। উপন্যাস না হলেও ছোট গল্প লেখা যেতে পারে। আমি পত্রিকায় পাঠাবো। ছাপা হলে পড়তে পারবেন।’
মেয়েটি চুপচাপ। আমি একটু অপেক্ষা করে বললাম, ‘আপনি একটা কাজ করতে পারেন। মুখে বলতে অসুবিধা হলে সংক্ষেপে দু’তিন পৃষ্ঠার মধ্যে লিখে আমার ঠিকানায় পোস্ট করে দিন। ঠিকানা আমার উপন্যাসের প্রিন্টার্স লাইনে আছে। পড়ার পর লেখার উপযুক্ত মনে হলে আপনাকে আমি ফোন দিয়ে জানাবো। ঠিক আছে?’
মেয়েটি লাজুক কণ্ঠে বললো, ‘আঙ্কেল, আপনাকে তো আগেই বলেছি আমি বানানে খুব কাঁচা। আমার চিঠি পেলে আপনি বিরক্ত হয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেবেন। তাছাড়া কেমন করে লিখতে হয়, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’
মনে মনে সত্যিই একটু বিরক্ত হলাম। তবে মনের ভাব প্রকাশ না করে বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে থাক।’
মেয়েটি অপ্রস্তুত হয়ে হড়বড় করে বললো, ‘সেটাই ভালো। আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম আঙ্কেল। কিছু মনে করবেন না।’
আমি বললাম, ‘না, না। ইট’স্ ওকে।’
আমার একটা অভ্যাস আছে। কোন পাঠক আমার উপন্যাস বা পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে ফোন করলে আমি তার নাম ও নম্বর ফোনবুকে সেভ করে রাখি। রোখসানার নাম ও নম্বরও সেভ করা ছিল। কিন্তু মেয়েটি দীর্ঘ প্রায় তিন মাস আমার সাথে আর কোন যোগাযোগ করেনি। আর ব্যস্ততার কারণে আমার পক্ষেও পাঠক পাঠিকাদের সাথে উপযাচক হয়ে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে নারী পাঠকদেরকে আমি কখনোই ফোন করিনা।
রোখসানা প্রায় তিন মাস পরে আমাকে ফোন দিল। আমি বললাম, ‘কেমন আছেন?’
‘ভালো নেই আঙ্কেল। আমার জন্য দোয়া করবেন।’
‘নিশ্চয় দোয়া করবো।’
অনেক পাঠক পাঠিকা ফোনে কথা শেষ করে দোয়া চায়। রোখসানার দোয়া চাওয়াকে আমি সেরকমই ভেবেছিলাম। কিন্তু তার সাথে এই সর্বশেষ ফোন যোগাযোগের তিন দিন পর আমি ডাকযোগে একটা চিঠি পেলাম। খুলে দেখি, রোখসানার চিঠি। সে সংক্ষেপে তার জীবন-কাহিনী লিখে পাঠিয়েছে। অসংখ্য ভুল বানানে লেখা এই চিঠিতে কাহিনীর শুরু কোথায়, আর শেষ কোথায় কিছুই বোঝা যায় না। অনেক ধস্তাধস্তি করে যেটুকু উদ্ধার করা গেল, তা’ এরকমঃ
মেয়েটি ঢাকার একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়াশুনা করতো। ভার্সিটির নাম কী, ডিসিপ্লিন কী কিছুই উল্লেখ নাই। তার দু’জন সহপাঠী অর্ণব ও সোহেল তাকে ভালোবাসতো। কিন্তু রোখসানা সোহেলকে পছন্দ করতো না। সে ক্লাস আওয়ারের বাইরে অর্ণবের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশা করতো, যা সোহেল মোটেই পছন্দ করতো না। এ নিয়ে সোহেলের সাথে রোখসানার বেশ কয়েকবার বাক বিতণ্ডা হয়। সোহেল অর্ণবকেও শাসায়। পরিস্থিতি খুব উত্তপ্ত হয়ে উঠলে এক পর্যায়ে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। অর্ণব ও রোখসানা একদিন সন্ধ্যের পর এক চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে খাওয়া দাওয়া করে বের হবার সময় সোহেল রোখসানার মুখে এসিড ছুঁড়ে মেরে পালিয়ে যায়। দেড় বছর আগের এই ঘটনায় রোখসানার মুখের বেশির ভাগই পুড়ে যায়। একটা চোখও নষ্ট হয়ে যায়। এক চোখ ও কপালের একাংশ ছাড়া তার পুরো মুখমণ্ডলই মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়।
দীর্ঘ চার মাস চিকিৎসা করার পর ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরে ভয়াবহ বিকৃত চেহারা নিয়ে রোখসানা স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী হয়ে থাকে। খুব জরুরী প্রয়োজন না হলে সে ঘরের বাইরে যায় না। গেলেও বোরকা পরে পরিবারের একজন সদস্যকে সাথে নিতে হয়। ঘটনার পর থেকে তার পড়াশুনার পাট চুকে গেছে।
ঘটনার পর অর্ণব একবার মাত্র দশ মিনিটের জন্য তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিল। এরপর আর তার দেখা পাওয়া যায়নি। সিম বদলে ফেলায় বহু চেষ্টা করেও রোখসানা তার সাথে ফোনে কথা বলতে পারেনি। তার ক্লাসের দু’তিনজন ছাত্রী তাকে দেখতে গেলে রোখসানা অর্ণবের কথা জিজ্ঞেস করায় উত্তর পেয়েছে, ‘ওকে ভুলে যা।’
রোখসানার চিঠি পড়ার পর পরই আমি ফোন দিলাম তাকে। আমার ভেতর একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। রোখসানার সাথে কথা বলা দরকার। তাকে সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। প্রায় অপাঠ্য একটা চিঠি তার সাথে আমার সম্পর্কটাকে মুহূর্তের মধ্যে বদলে দিয়েছে। লেখক ও পাঠকের সম্পর্ক উধাও হয়ে গিয়ে বাবা ও মেয়ের সম্পর্ক সামনে চলে এসেছে। আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাই।
কিন্তু ফোন রিসিভ করলো একটি পুরুষ কণ্ঠ। বললো, ‘আপনি কী আবুহেনা সাহেব বলছেন?’
‘জি বলছি। আপনি কী রোখসানার বাবা?’
‘জি না, আমি ওর বড় ভাই। আপনার ব্যাপারে সে আমাকে বলে গেছে। ওর ফোন বুকে আপনার নাম ও নম্বর সেভ করা আছে।’
আমি বিচলিত বোধ করলাম। উৎকণ্ঠিত গলায় বললাম, ‘বলে গেছে মানে? সে এখন কোথায়?’
যুবক শান্ত গলায় বললো, ‘রোখসানাকে নিয়ে বাবা তিন দিন আগে জার্মানি চলে গেছেন। সেখানে রোখসানার কসমেটিক সার্জারি হবে।’
ওফ্, মনে হলো আমার অস্থির হৃৎপিণ্ডটা যেন একটু শান্ত হলো। কয়েক সেকেন্ড ধকল সামলে নিয়ে বললাম, ‘আপনি কী করেন?’
‘আমি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। রোখসানা তো ঘরের বাইরে যেত না। আপনার উপন্যাসটা বার বার পড়ে সে সময় কাটাতো। আপনি ফোন করেছিলেন, সে কথা ওকে বলবো। ও খুশি হবে। দেশে ফিরলে নিশ্চয় সে আপনার সাথে কথা বলবে।’
আমি ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিলাম। আমার বেডরুমের জানালার ওপাশে একটা নিম গাছ আছে। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আমি নির্বাক তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। বেডরুমের ভেন্টিলেটারে বাসা বেঁধেছে দুটো চড়ুই পাখি। ওরা কিচির মিচির করতে করতে একবার উড়ে গিয়ে নিম গাছের ডালে বসছে, পরক্ষণেই আবার উড়ে এসে বাসায় ঢুকছে। আমি মনোযোগ দিয়ে দেখছি ওদের। নিম গাছের ডালে বসে পাখি দুটো একে অন্যের ঠোঁটে ঠোঁট ঘষে আদর করছে। তারপর ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে যাচ্ছে অন্য দিকে। কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার ফিরে আসছে ওরা। এই কুৎসিত দুনিয়ায় এত সুন্দর দৃশ্য কত দিন দেখি না!
রচনাঃ ১৪/০৮/২০১৩
**********************************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:১৭