অফিশিয়াল ট্রেইনিংয়ে ঢাকার তেজগাঁওয়ে আমাদের ট্রেনিং সেন্টারের হোস্টেলে ছিলাম। সেটা ১৯৯৩ সালের কথা। তিন মাসের ট্রেইনিং শেষে আমার বাড়ি ও কর্মস্থল রাজশাহী ফেরার এক সপ্তাহ আগের ঘটনা। ফার্মগেট ওভারব্রিজে একজন ভাসমান বিক্রেতার কাছ থেকে এক বোয়ম হরলিকস কিনে ঠকেছিলাম।
তখন কাঁচের বোয়মে হরলিকস বিক্রি হতো। বিক্রেতা মধ্যবয়সী। পরনে জীর্ণ পোশাক। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সে একটা কাপড়ের পুটলি থেকে এক বোয়ম হরলিকস বের করে হাতে নিয়ে আমার সাথে সাথে হাঁটছিল আর অত্যন্ত করুণ স্বরে সেটি কেনার জন্য আমাকে বার বার অনুরোধ করছিল। সে বলছিল, দোকানে এই হরলিকসের দাম একশো ষাট টাকা। একশো টাকা পেলেই সে হরলিকসটি আমাকে দিয়ে দেবে।
আমি মাঝে মধ্যে হরলিকস কিনতাম বলে দাম জানা ছিল। বিক্রেতার কথা ঠিক। দোকানে এটির দাম একশো ষাট টাকাই। তাই বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘তুমি এতো কম দামে দিচ্ছ কিভাবে?’ উত্তরে কাঁদো কাঁদো হয়ে সে যা বললো, তা’এরকমঃ সে গুলিস্তানের একটি কনফেকশনারি দোকানে চাকরি করে। বেতন খুবই কম। সেই বেতনও দোকান মালিক ঠিকমতো দিতে চায় না। ফলে পরিবার ও ছেলেমেয়ে নিয়ে তার অনাহারে থাকার দশা। তাই বাধ্য হয়ে দোকানের স্টক থেকে সে এক বোয়ম হরলিকস চুরি করে বিক্রি করতে নিয়ে এসেছে। বেতন পেলে এক বোয়ম হরলিকস বিক্রি দেখিয়ে মহাজনের ক্যাশ আবার সে পূরণ করে দেবে। অভাবে স্বভাব নষ্ট আর কি!
আমি হরলিকসের বোয়ম পরখ করে কোন অস্বাভাবিকতা দেখলাম না। খাপ খুলে দেখলাম বোয়মের মুখ যথাযথভাবেই এ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে সিল করা আছে। কম দামে হরলিকস কেনার লোভ হলো। তা’ ছাড়া লোকটির দুর্দশা দেখে তার প্রতি সহানুভূতিও হচ্ছিল। বললাম, ‘ষাট টাকায় দেবে?’ চোরাই মাল, যত কম দামে কেনা যায়! চুরির ওপর বাটপাড়ি আর কি!
আমার দাম শুনে লোকটি প্রায় কেঁদে ফেললো। চোরাই মাল যথাসম্ভব দ্রুত বিক্রি করে কেটে পড়ার জন্য সে তাড়াহুড়ো করছিল। আর সন্ত্রস্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। আমি তার এই অসহায় অবস্থার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। শেষে দর দাম করে আশি টাকায় রফা হলো। লোকটি অতি দ্রুত হরলিকসের বোয়ম আমার হাতে গছিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে গেল।
একশো ষাট টাকার মাল আশি টাকায় পাওয়া গেল। আমার তৃপ্তির শেষ ছিল না। আমার হাসিমুখ দুই কান পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল।
কিন্তু এই হাসিমুখ গোমড়া হতে এক বেলার বেশি সময় লাগলো না। হরলিকস কিনেছিলাম সকাল দশটার দিকে। বিকেলে ট্রেইনিং সেন্টারের হোস্টেল রুমে ফিরে এক কাপ হরলিকস বানিয়ে খাওয়া যাক ভেবে হিটারে পানি গরম করলাম। কিন্তু বোয়মের খাপ খুলে এ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের সিল খুলতে গিয়ে দেখলাম সেটি আপনা থেকেই খুলে আমার হাতে চলে এলো। এ রকম তো হবার কথা নয়। ব্যাপার কী? বোয়মের ভেতর উঁকি মেরে দেখলাম হরলিকস ঠিকই আছে। বোয়মের গায়ে লেখা মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখও ঠিক আছে। তাহলে এ রকম হলো কেন? নিশ্চয় কারখানায় সিল করার সময় ফয়েলটি কারিগরি ত্রুটির কারণে ঠিকমতো লাগেনি। যাক গে,এটা তেমন কোন সমস্যা নয়।
এক কাপ গরম পানিতে দুই চামচ হরলিকস আর এক চামচ চিনি মিশিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখলাম,হরলিকস পানির সঙ্গে ঠিকমতো মিশছে না। কাপের নিচে স্তূপ হয়ে জমে থাকছে। আর চিনি গুলে গিয়ে ওপরের পানি সামান্য ঘোলা দেখাচ্ছে। ব্যাপার কী? কাপে চুমুক দিয়ে পরখ করতে গিয়ে আমি বেকুব। আঁশটে গন্ধ আর কষযুক্ত স্বাদে আমার বমি হওয়ার উপক্রম। থু থু করে মুখ থেকে সেগুলো জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে ভালো পানি দিয়ে কুলি করলাম। তারপর কাপের পানি ফেলে দিয়ে নিচে জমে থাকা হরলিকস(?)চামচে তুলে পরখ করে দেখলাম, সেগুলো বিস্কিট কালারের কাঠের গুঁড়ো বা ঐ জাতীয় কিছু।
ঠিক এই সময় আমার রুমমেট কুষ্টিয়া থেকে আসা ট্রেইনি শহিদুল্লাহ সাহেব রুমে ঢুকে শার্ট খুলতে খুলতে বললেন, ‘কী হেনা সাহেব,হরলিকস খাচ্ছেন বুঝি?’ আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার দশা। কারণ একা তো খাওয়া যায় না। শহিদুল্লাহ সাহেব যখন দেখেই ফেলেছেন, তখন তাকেও এক কাপ দিতে হয়। আমি হড়বড় করে বললাম, ‘না, মানে বাড়ি যাওয়ার আগে আমার বাচ্চার জন্য এক বোয়ম কিনলাম তো। একটু টেস্ট করে দেখছিলাম আর কী!’
‘ও আচ্ছা।’
চোরের ওপর বাটপাড়ি, তার ওপর আবার একগাদা মিথ্যে কথা। মানুষ ঘুষ দিয়ে চাকরি না পেলে বা পরীক্ষার সময় ফাঁস হওয়া ভূয়া প্রশ্নপত্র কিনে প্রতারিত হলেও কেন সে কথা অন্যকে বলতে পারেনা,সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। যত যাই হোক, নিজেকে তো আর অন্যের সামনে আহাম্মক হিসাবে হাজির করা যায় না!
এই হরলিকস বাড়ি নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু বোয়মটা ফেলবো কোথায়? বোয়ম হাতে হোস্টেল থেকে বেরনোর সময় কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে,হরলিকস নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? তখন কী জবাব দেব? অহেতুক আবার কিছু মিথ্যে কথা বলতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। শহিদুল্লাহ সাহেব যখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন, তখন পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে হোস্টেলের ছাদে পানির ট্যাঙ্কের আড়ালে হরলিকসের বোয়ম রেখে এলাম। সহজে কারো চোখে পড়বে না। ঘরে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে আশি টাকা গচ্চা যাওয়ার দুঃখটা ভুলতে চেষ্টা করলাম। তবে টাকা গচ্চা যাওয়ার চেয়ে এই কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়েই বাঁকি রাত আর ঘুম হলো না। হাজার হলেও মান সম্মান বলে একটা কথা আছে না!
ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে এ দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের প্রধান ছিলেন ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট(ডিএম)। তারা সবাই ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। একবার ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিল থেকে প্রত্যেক ডিএমের কাছে আলাদা আলাদাভাবে একটা করে চিঠি এলো। চিঠিতে সংশ্লিষ্ট ডিএমের প্রশাসনাধীন এলাকার স্থানীয় অধিবাসীদের স্বভাব চরিত্র ও মন মানসিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডে পাঠানোর নির্দেশ ছিল। ভারতবর্ষকে শক্ত হাতে শাসন করার জন্য এ দেশের মানুষজনের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের প্রয়োজন থেকেই ব্রিটিশ রাজের এই নির্দেশ। তবে চিঠি ছিল মোস্ট কনফিডেনশিয়াল। এক জেলার ডিএম জানতেন না যে অন্য জেলার ডিএমকেও একই চিঠি দেয়া হয়েছে। তথ্যানুসন্ধান শেষে ডিএমরা রিপোর্ট পাঠালেন ইংল্যান্ডে। দেখা গেল কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বর্ধমান, মালদা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোর, নোয়াখালী, রংপুর, দিনাজপুর ইত্যাদিসহ অবিভক্ত বাংলার প্রায় সব জেলার রিপোর্টে দারুণ মিল। চুরি-ডাকাতি করা, মিথ্যা কথা বলা, বিশ্বাসঘাতকতা করা, প্রতারণা করা, অন্যের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করা ইত্যাদি অপকর্ম প্রায় সব জেলার মানুষের সাধারণ প্রবণতা। সামান্য অর্থ বিত্ত বা প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জনের লোভে এখানকার লোকেরা যে কোন খারাপ কাজ করতে পারে।
ডিএমদের পাঠানো এই রিপোর্ট এ দেশের মানুষের স্বভাব চরিত্র ও মন মানসিকতার বিশ্লেষণে হয়তো অতিরঞ্জিত ও একপেশে হতে পারে। কেননা নেটিভদের তারা ঘৃণা করতো বলে তাদের কাছে হয়তো আমাদের চরিত্রের অন্ধকার দিকটিই প্রাধান্য পেয়েছে। তাছাড়া পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তারের নিষ্ঠুর অভিযানে ইংরেজদের চেয়ে বেশি কুকর্ম অন্য কোন জাতি করেছে বলে ইতিহাসে লেখা নাই।
তারপরেও তাদের তৎকালীন একজন ডিএমের রিপোর্টে লেখা এই মন্তব্যটির প্রতি খেয়াল করুন- “এরা প্রতারণা করতে যেমন সিদ্ধহস্ত, প্রতারিত হতেও তেমনি সমান পারদর্শী।”
পঁয়ষট্টি বছর আগে ব্রিটিশরা চলে গেছে। কিন্তু আমাদের মনোজগতে প্রতারণার অবস্থান সম্পর্কে প্রায় আড়াইশো বছর আগে তাদের একজন ডিএমের মন্তব্য আজও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। আমরা আজো ধুমসে প্রতারণা করে যাচ্ছি এবং প্রতারিত হয়ে চলেছি। জাত হিসেবে আমাদের তুলনা নেই।
********************************************************************************************************************
এই লেখাটি মাসিক মৌচাকে ঢিল পত্রিকার সেপ্টেম্বর/২০১২ সংখ্যায় (প্রতারণা সংখ্যা) প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম।
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪৬