তখন আমি ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ি। আমাদের স্কুলে একদিন এক যাদুকর এলেন যাদু দেখাতে। ক্লাসে ক্লাসে নোটিশ গেল স্কুল ছুটির পর কমনরুমে যাদু দেখানো হবে। তখনকার দিনে অধিকাংশ যাদুকরের নামের শেষে সরকার টাইটেলটি থাকতো। সম্ভবত সে সময়ের বিখ্যাত ভারতীয় যাদুকর পি, সি, সরকারের নামের সাথে মিল রেখে এমনটা করা হতো অথবা হয়তো নামের এই মিল ছিল নেহাতই কাকতাল মাত্র।
যতদূর মনে পড়ে আমাদের যাদুকরের নাম ছিল বি, এ, সরকার। স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের মতো আমারও যাদু দেখার প্রতি ছিল তীব্র আকর্ষণ। যাদুকরের আজব আজব সব কর্মকাণ্ড দেখে আমরা থ’ বনে গেলাম। তিনি তাঁর মাথায় পরা হ্যাটের ভেতর থেকে আস্ত পায়রা বের করে আনলেন, অথচ হ্যাটটি পরার আগে আমাদের সবাইকে সেটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেতরটা ফাঁকা দেখিয়েছিলেন। তাহলে পায়রাটি এলো কোত্থেকে? এরপর তিনি টেবিলের ওপর গ্লাস ভর্তি পানি উল্টে দিলেন, অথচ একফোঁটা পানিও পড়লো না। ক্লাস এইটের এক ছাত্রকে ডেকে নিয়ে তার পশ্চাদ্দেশ থেকে তিনি গুনে গুনে এক ডজন মুরগির ডিম বের করে আনলেন। আমরা সবাই হেসে খুন। ছেলেটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে রইল। যাদুকর এক ছাত্রের একটি দু’আনা দামের ষোল পৃষ্ঠার খাতা চেয়ে নিয়ে সবার চোখের সামনে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে শুন্যে উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার! টুকরোগুলো মঞ্চের ওপর পড়ে প্রতিটি টুকরো এক টাকার নোট হয়ে গেল। যাদুকর তার সহকারী সহ নোট গুলো কুড়িয়ে টেবিলের ওপর স্তূপ করে রেখে সেই স্তূপের ওপর একটা কালো রুমাল দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর মাত্র এক সেকেন্ড। রুমালটি সরিয়ে নিতেই দেখা গেল, টাকাগুলো গায়েব হয়ে গেছে। পরিবর্তে ছাত্রটির সেই খাতা সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় টেবিলের ওপর পড়ে আছে। খাতাটি ঝেড়ে মুছে তিনি ছাত্রটিকে ফেরত দিলেন। এরপর খালি টিনের কৌটা থেকে আস্ত তাজা মাছ বের করে আনা, নিজের দু’কান থেকে লম্বা রঙ্গিন ফিতে টেনে বের করা, নানারকম তাসের খেলা, সহকারী ছেলেটির সামনে কালো পর্দা ধরে মুহূর্তের মধ্যে তাকে অদৃশ্য করে দেওয়া এরকম আরও অনেক যাদু দেখালেন তিনি। আমরা হাঁ করে সেসব যাদু দেখে অবাক হয়ে গেলাম। অভ্যাস না থাকায় আমরা কেউ হাততালি দিচ্ছিনা দেখে খেলা শেষে যাদুকর হ্যাট খুলে মাথা নুইয়ে বললেন, ‘হাততালি, প্লিজ!’
আমরা বিপুল বিক্রমে হাততালি দিলাম ঠিকই, কিন্তু তাতেও কয়েক সেকেন্ড দেরি হয়ে গেল। কারণ হ্যাট খোলার পর যাদুকরের মাথা ভর্তি চুল গায়েব হয়ে গিয়ে সেখানে চকচকে টাক দেখে সে দৃশ্য হজম করতে আমাদের এই কয়েক সেকেন্ড দেরি হয়ে গেল।
যাদুকরের সবগুলো যাদুর মধ্যে কাগজের টুকরোগুলোর টাকা হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি অনেক দিন আমার মনে স্থায়ীভাবে গেঁথে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে সরকারী চাকরিতে ঢোকার পরেও বি, এ, সরকারের এই যাদুর রহস্য নিয়ে ভাবতাম। নিজ চোখে দেখেছি, সুতরাং অবিশ্বাস করি কিভাবে? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? সাদা কাগজের টুকরোগুলো মুহূর্তের মধ্যে টাকা হয়ে গেল। আবার টাকাগুলো গায়েব হয়ে গিয়ে ফিরে এলো আগের সেই খাতা। অদ্ভুত ব্যাপার!
বয়স ও অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে বি, এ, সরকারের এই যাদুর রহস্য আমার কাছে একটু একটু করে পরিস্কার হতে লাগলো। বুঝলাম, তার এই যাদু মোটেই কোন অদ্ভুত ব্যাপার নয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই এই যাদু জানে। সম্ভবত তারা এই যাদু দেখানোর বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়েই জন্মেছে। তিনটি ঘটনার কথা বলি। তাহলেই আপনারা বুঝতে পারবেন যে বি, এ, সরকারের মতো অনেক যাদুকর আমাদের সমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
১) স্কুল জীবন থেকে জামান আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একই মহল্লায় থাকি এবং একই স্কুলে পড়ি। জামানরা দুই ভাই এক বোন। অল্প বয়সে স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের মা ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের মহল্লায় তাঁর বড় ভাইয়ের বাড়িতে থাকেন। চরম অর্থকষ্ট ও মামা মামির লাঞ্ছনা গঞ্জনার মধ্যে জামানরা তিন ভাইবোন মানুষ হচ্ছিল। এস এস সি পাশ করার পর জামান আমাদের মতো কলেজে ভর্তি না হয়ে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তি হল। সেখান থেকে সে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা করে আমাদের মধ্যে সবার আগে সরকারী চাকরিতে ঢুকে গেল। সাব এ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার থেকে এ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পর তার অফিসে আমার একবার যাওয়ার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। দুর্ভাগ্য বলছি এই কারণে যে, তার কথা বলার সময় নাই। নিজের অফিস রুমে টেবিলের ওপর গাদা গাদা ফাইল পত্রের মধ্যে সে সব সময় ডুবে থাকে আর ঠিকাদাররা তাকে মৌমাছির মতো চারদিক থেকে ঘিরে রাখে। তখনও অফিসে অফিসে ডেস্কটপ আসেনি। নথিপত্রের মধ্যে থেকে মাথা বের করে জামান আমাকে দেখে ‘একটু বস্’ বলে পিওনকে আমার জন্য চা দিতে বলে আবার কাগজপত্রের মধ্যে ডুবে গেল।
এই কাগজপত্রকে জাদুমন্ত্রবলে টাকা বানিয়ে জামান এখন অনেক সম্পদের মালিক। ঢাকার বারিধারায় দেড় কোটি টাকায় সে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছে। রাজশাহীতে বিশাল মার্কেট বানিয়ে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা ভাড়া তুলছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও ব্যাংক ব্যালান্সের কথা সে আমাকে বলে না। এখন বলুন,কাগজপত্রকে টাকা বানানোর যাদু বি, এ, সরকার কি শুধু একাই জানে?
২) আমার আর এক স্কুল ফ্রেন্ড আলমের কথা বলি। পুরো নাম বদিউল আলম চৌধুরী। নামের শেষ অংশ পড়ে বুঝতেই পারছেন যে সে জামানের মতো হতদরিদ্র ঘরের সন্তান নয়। বাবা নাম করা ডাক্তার। আলম নিজেও মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে বিদেশে গিয়ে ইংরেজি হরফের এ টু জেড কি কি সব ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে এলো। মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি একটা চারতলা বিল্ডিং এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে তার প্রাইভেট প্র্যাকটিসের চেম্বার। একবার আমার অসুখ হওয়ায় চিকিৎসার জন্য আলমের চেম্বারে গেলাম। দেখলাম, চেম্বারের বাইরে হলরুমের মতো একটা ঘরে চল্লিশ পঞ্চাশ জন রোগী চেয়ারে বসে কাতরাচ্ছে আর চেম্বারের ভেতরে আলম একজন রোগীর পরীক্ষা নিরিক্ষার কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে রোগী ও তার আত্মীয় স্বজনকে কঠিন ভাষায় ধমকাচ্ছে। বন্ধু হওয়ার কারণে সিরিয়াল ব্রেক করে আলম আমাকে দেখলো এবং অপেক্ষাকৃত নরম ভাষায় আমাকেও ধমকা ধমকি করে রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষাসহ এক্স রে করার জন্য একটা কাগজে কি কি সব লিখে একই বিল্ডিং-এর তিন তলায় চলে যেতে বলল। আলমের ভিজিট পাঁচশো টাকা। বন্ধু হওয়ায় আমার কাছে সে তিনশো টাকা নিল। কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে জানা গেল, প্রতিদিন দু’বেলা সে গড়ে সত্তর আশিজন রোগী দেখে। তিন তলার ল্যাব থেকেও সে ৪০% কমিশন পায়। আমি এ্যাকাউন্টেন্ট মানুষ। মনে মনে হিসাব করে দেখলাম, কমিশন ও অধ্যাপনার বেতন ভাতা ছাড়া আলম এক বছরে শুধু রোগী দেখেই এক কোটি ছাব্বিশ লক্ষ থেকে এক কোটি চুয়াল্লিশ লক্ষ টাকা আয় করে।
তাহলে দেখুন, রক্ত ও মলমূত্র পরীক্ষার রিপোর্ট, এক্স রে রিপোর্ট, আলট্রাসনোগ্রাফি ও এম আর আই রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন এই সব নানারকম কাগজপত্রকে কি অবলীলায় কোটি কোটি টাকায় রূপান্তর করে চলেছে আলম। আশ্চর্য না, বলুন?
৩) আজিম মিয়া কাঁচা বাজারের নৈশ প্রহরী। রাতে বাজার পাহাড়া দেয় আর দিনে একই বাজারে বসে পেঁয়াজ মরিচ আদা রসুন বিক্রি করে। বিদ্যার দৌড় টিপসই পর্যন্ত। তবে সে চালাক চতুর লোক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই লোক কিভাবে কিভাবে যেন রাজশাহীর সারদা ক্যাডেট কলেজে নানারকম মশলা ও লাকড়ি সরবরাহের কাজ পেয়ে গেল। পরের বছর সে ক্যাডেট কলেজের পাশাপাশি সারদা পুলিশ একাডেমীতেও একই কাজ বাগিয়ে নিল। দুটো বড় বড় প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ টাকার সরবরাহ কাজ। টেন্ডার থেকে শুরু করে ইনভয়েস, সাপ্লাই সিডিউল, ব্যাংকের কাগজপত্র এসব কাজের জন্য আজিম মিয়া বেতন দিয়ে একজন শিক্ষিত যুবককে নিয়োগ করলো। খাদ্য বিভাগের লোকজনকে ঘুষ দিয়ে সে বিভিন্ন গোডাউন ও সাইলোতে ফুড ক্যারিংএর কাজ পেয়ে গেল। বড় বড় ভোগ্য পন্য কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ পেয়ে তার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠলো। ক্যারিংএর সুবিধার জন্য সে হাফ ডজন ট্রাক কিনে ফেললো। যত ব্যবসা, তত কাগজপত্র। আর যত কাগজপত্র, তত ব্যবসা। আজিম মিয়া লেখাপড়া জানা আরো লোকজন নিয়োগ দিল। তারা ব্যবসার কাগজপত্রের পাশাপাশি ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার কাগজপত্র তৈরি করতে করতে পেরেশান হয়ে গেল। আজিম মিয়া তাদের একজনের কাছ থেকে বহু ধস্তাধস্তি করে নাম স্বাক্ষর করা শিখে নিল। শত শত কাগজপত্রে টিপসই দিতে তার এখন লজ্জা লাগে। আজিম মিয়ার যত কাগজ, তত টাকা। কি চমৎকার যাদু, তাই না? বি, এ, সরকারের চেয়ে তার যাদু কম কিসের?
তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছেন কি? এরা কাগজকে টাকা বানানোতে ওস্তাদ, কিন্তু বি, এ, সরকারের মতো ঐ টাকাকে আবার কাগজ বানাতে মোটেই উৎসাহী নয়। এরা মরে গেলে এদের কারো কারো ছেলে মেয়ে বা আত্মীয় স্বজনরা টাকাকে আবার কাগজ বানানোর যাদু দেখাতে পারদর্শী হয়ে ওঠে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস থেকে কাট ছাঁট করে ক’টা সংলাপ বলি। শ্রীকান্ত বর্মা মুলুকে যাচ্ছে চাকরির আশায়। জাহাজে তার গ্রাম সম্পর্কীয় এক কাকাবাবুর সাথে দেখা। কাকাবাবু বললেন, ‘শ্রীকান্ত, জীবনে তুমি কি করলে বাবা! তোমারই গ্রামের অমুক বাবু মারা যাওয়ার আগে অতো বিঘে জমি রেখে গেল, অতো টাকা ব্যাংকে রেখে গেল, অতো ভরি সোনা রেখে গেল। আর তুমি তার চেয়ে বংশীয় ঘরের ছেলে হয়েও কিচ্ছু করতে পারলে না। সারাজীবন শুধু ভবঘুরের মতো ঘুরেই বেড়ালে!’
শ্রীকান্ত মুচকি হেসে বলল, ‘ও, অমুকবাবু ওসব রেখে গিয়েছেন? নিয়ে যেতে পারেন নি? জানিনা তো!’
******************************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৬ দুপুর ১২:৫২